Dr Khondaker Golam Moazzem on sugar industry

Published in মানবকন্ঠ  on Saturday, 28  November 2015

 

সংকটে চিনি শিল্প

আসাদ জোবায়ের
আখ কেনা এবং তা থেকে চিনি উৎপাদনের ক্ষেত্রে কর্পোরেশনের অনেক অব্যবস্থাপনা রয়েছে। লোকসান কমাতে হলে সরকারকে এদিকে নজর দিতে হবে। এছাড়া উৎপাদন পর্যায়ে অতিরিক্ত শ্রমিক-কর্মচারী যদি কমানো যায়, তাহলে চিনিকলগুলোর উৎপাদন ব্যয় কমে আসবে। এর মধ্য দিয়ে লোকসানও কমে আসবে। শুল্ক বাড়িয়ে বিক্রি বাড়ানোর চিন্তাটি ঠিক না। এটি স্থায়ী সমাধান নয়। বাজারে প্রতিযোগিতা থাকবেই। এটিকে মাথায় নিয়েই উৎপাদন প্রক্রিয়া চলাতে হবে। কিভাবে চিনিকলগুলোকে লাভজনক করা যায় তা ভাবতে।
দেশের চিনিকলগুলোতে এক কেজি চিনি উৎপাদনে খরচ হয় প্রায় ৮০ টাকা। আর সরকার তা বিক্রি করছে ৩৭ টাকায়। লোকসান গুনতে হচ্ছে ৪৩ টাকা। অন্যদিকে আমদানিকৃত চিনি পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩৪ টাকায়। ফলে দেশি আখের চিনির চাহিদা কম। ডিলাররা চিনি কিনছেন না। ভারি হচ্ছে লোকসানের পাল্লা। এ অবস্থায় চিনিকল বন্ধ করে দেয়াও সম্ভব হচ্ছে না। কারণ এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে লাখ লাখ আখ চাষি। তাহলে এর থেকে বের হওয়ার উপায় কী? খাদ্য ও চিনি শিল্প কর্পোরেশন বলছে, চিনি আমদানিতে শুল্ক বাড়িয়ে দাম বাড়ানো হোক। কিন্তু অর্থনীতিবিগণ মনে করেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে শুল্ক বাড়ানো কোনো সমাধান নয়। এমনই এক সংকটে বন্দি হয়ে শিল্পটি আজ লোকসানের বোঝা বাড়িয়েই চলেছে।
এসব কারণে উৎপাদন অব্যাহত রাখলেও এর বিপরীতে চাষিদের অর্থ ঠিকমতো পরিশোধ করতে পারছে না সরকার। লোকসানে থাকায় পুরনো পদ্ধতি ও মেশিন বদলে নতুন মেশিনও স্থাপন করা যাচ্ছে না। এছাড়া আখের রস দিয়ে তৈরি চিনির উৎপাদন খরচ স্বাভাবিকভাবেই বেশি হওয়ায় ইউনিট প্রতি খরচও কমছে না। বরং বিভিন্ন কারণে তা দিন দিন বাড়ছেই। এছাড়া আখের চিনি গুণগতমানে আমদানিকৃত চিনির চেয়ে ভালো হলেও মানুষের মধ্যে সচেতনতা না থাকায় তা গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। এক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রচার-প্রচারণা চালানোর মতো সামর্থ্যও কর্পোরেশনের নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক্ষেত্রে সরকারকে বড় বিনিয়োগ করতে হবে এ খাতে। কারখানাগুলোকে আধুনিকায়ন করে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে হবে। আখের পাশাপাশি সুগারবিটের চিনি উৎপাদনে যেতে হবে কর্পোরেশনকে।  এছাড়া আখের চিনির গুণাগুণ জনগণের মধ্যে প্রচারের উদ্যোগ নিলে মানুষ একটু বেশি দাম দিয়ে হলেও এটি কিনত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কর্পোরেশনকে আধুনিক বিপণন ব্যবস্থায় আসতে হবে বলেও তারা মনে করেন।
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চিনির দাম কমেই চলেছে। এ অবস্থায় উৎপাদন ব্যয় কেজিতে ৮০ টাকা হলেও সরকার বারবার চিনির দাম কমিয়ে বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করছে। কিন্তু তারপরও দেশি চিনির চাহিদা সৃষ্টি করা যাচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে টন প্রতি র’ চিনি আমদানিতে ২ হাজার টাকা শুল্ক ও ৩২০ ডলারের ওপর ২০ শতাংশ রেগুলেটরি ট্যাক্স মিলে ৭ হাজার টাকার মতো পরিশোধ করে আমদানিকারকরা। আর সরাসরি রিফাইন চিনি আমদানিতে ৪০০ ডলার ভিত্তিমূল্য ধরে ২০ শতাংশ রেগুলেটরি ট্যাক্স ও ৪ হাজার টাকা শুল্ক মিলে ১০ হাজার টাকার মতো পরিশোধ করেন আমদানিকারকরা। এই শুল্ক দিয়েও তারা ৩৪ টাকায় চিনি বিক্রি করতে পারেন। দামের এই অসম প্রতিযোগিতার কারণেই বাজারে অবস্থান নিতে পারছে না দেশীয় চিনি। আর এ কারণেই বাড়ছে চিনির মজুদ।
এক হিসাব মতে, দেশে মোট ১৪ লাখ মেট্রিক টন চিনির চাহিদা রয়েছে। এই চাহিদার বিপরীতে গত বছর ১৬ লাখ টন চিনি আমদানি হয়েছিল। আর এ বছর তা বেড়ে ১৮ লাখে দাঁড়িয়েছে। কর্পোরেশনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী চলতি মৌসুমের আখ মাড়াই শুরু হয়েছে বেশ কয়েক সপ্তাহ হয়। এখনো গুদামে পড়ে আছে এক লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন চিনি। এ হিসাব সংরক্ষিত চিনির বাইরে। সংরক্ষিত রেশনের চিনি যোগ হলে এর পরিমাণ আরো বাড়বে। এর প্রধান কারণ লোকসানের অজুহাতে ডিলাররা চিনি তুলছেন না।
সূত্র জানায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে মাত্র ২৩ হাজার টন চিনি বিক্রি হয়। তখন ৫০ টাকা কেজি দরে সেনা ও নৌবাহিনী, পুলিশ এবং বিজিবি এই চিনি কেনে। এই সময়ে ডিলাররা কোনো চিনি তোলেননি। এ অবস্থায় গত বছর ৯ ফেব্রুয়ারি শিল্প মন্ত্রণালয় চিনির দাম কমিয়ে প্রতি কেজি ৪০ টাকা নির্ধারণ করে। কর্পোরেশন সূত্র বলছে, দাম কমানোর পর থেকে ওই বছর ১৩ জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত ৫৫ হাজার ৮৫৮ টন চিনি বিক্রি হয়েছে। এর একটি বড় অংশই বিক্রি হয়েছে ফ্রি সেলে। চিনি বিক্রি হচ্ছে না দেখে গতবছর মে মাসে শিল্প মন্ত্রণালয় ফ্রি সেলে এক লাখ টন চিনি বিক্রির অনুমতি দেয়। এর পর থেকে ৩৮ হাজার ৬৮০ টন চিনি বিক্রি হয়েছে। কিন্তু ডিলাররা কোনো চিনিই তোলেননি। সূত্রটি জানিয়েছে, গত অর্থবছরের পুরো সময়ে ডিলাররা মাত্র ৫৫৮ টন চিনি তুলেছেন।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ চিনি ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকার ৪০ টাকা দর বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু বাজারে চিনির পাইকারি দর ৩৪-৩৫ টাকা। তাহলে আমরা কিভাবে এই চিনিটা বিক্রি করব। তিনি জানান, দুই বছর ধরে সরকার চিনির যে দরই নির্ধারণ করে তার চেয়ে কম দামে বেসরকারি মিলগুলো তাদের চিনি বিক্রি করে। ফলে সরকারি চিনি তুললে লোকসান গুনতে হয় তাদের।
এ বিষয়ে কর্পোরেশনের সচিব এসএম আবদার হোসেন বলেন, লোকসান থেকে বেরিয়ে আসতে কর্পোরেশনের যতটুকো ক্ষমতা আছে তার মধ্যে চেষ্টা করছি। চিনি বিক্রি বাড়ানোর চেষ্টা করছি। ডিলাররা চিনি তুলছে না বলে আমরা ফ্রি সেলে (সবাই কিনতে পারবে) বিক্রিও শুরু করেছি, যেন কৃষকের উৎপাদিত আখে চলা দেশীয় চিনিকলগুলো টিকে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়ে এ লোকসান অন্য উপায়ে সমন্বয় করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
কর্পোরেশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এ কে এম দেলোয়ার হোসেইন মানবকণ্ঠকে বলেন, স্বাভাবিক অবস্থাতেই আমদানি শুল্ক কম হওয়ায় দামের দিক থেকে চরম প্রতিযোগিতায় ছিল। তার ওপর আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য কমে যাওয়ায় দেশে কম মূল্যে চিনি আমদানি করছে ব্যবসায়ীরা। এর বিপরীতে নানা কারণে আমাদের দেশীয় চিনির উৎপাদন খরচ কিছুটা বেশি। তাই এর প্রথম সমাধান আমদানি পর্যায়ে শুল্ক বাড়িয়ে চিনির মূল্য বাড়ানো। যখন শুল্ক কমানো হয়েছে তখন বেশি কমানো হয়েছিল। কিন্তু এখন যখন বাড়ানো দরকার তখন সে হারে বাড়ছে না। এখন তো সবকিছুর দামই বেশি। চিনিটাও না হয় বেশি দামেই খাবে মানুষ।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আখ কেনা এবং তা থেকে চিনি উৎপাদনের ক্ষেত্রে কর্পোরেশনের অনেক অব্যবস্থাপনা রয়েছে। লোকসান কমাতে হলে সরকারকে এদিকে নজর দিতে হবে। এছাড়া উৎপাদন পর্যায়ে অতিরিক্ত শ্রমিক-কর্মচারী যদি কমানো যায়, তাহলে চিনিকলগুলোর উৎপাদন ব্যয় কমে আসবে। এর মধ্য দিয়ে লোকসানও কমে আসবে। শুল্ক বাড়িয়ে বিক্রি বাড়ানোর চিন্তাটি ঠিক না। এটি স্থায়ী সমাধান নয়। বাজারে প্রতিযোগিতা থাকবেই। এটিকে মাথায় নিয়েই উৎপাদন প্রক্রিয়া চলাতে হবে। কিভাবে চিনিকলগুলোকে লাভজনক করা যায় তা ভাবতে।