Dr Fahmida Khatun summarises Bangladesh’s potentials and drawbacks for drawing FDI, published in The Daily Ittefaq on Tuesday, 9 September 2014.
অর্থনীতি
বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ
ফাহমিদা খাতুন
সম্প্রতি জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগ করার আশ্বাস দিয়ে গেছেন। কিছুদিন আগে সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশ বিজনেস ফোরাম অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো। সেখানেও বাংলাদেশে বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য অনেক বক্তব্য দেয়া হয়েছে। এই সবই বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য সুখবর। কেননা বিশ্বায়নের এই যুগে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের একটি অন্যতম উপায় হলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ প্রবাহ সচল রাখা। অনেক ক্ষেত্রেই স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) দাতা এবং গ্রহীতা উভয় দেশের জন্যই লাভজনক। গ্রহীতা দেশগুলো এফডিআইয়ের মাধ্যমে মূলধন এবং প্রযুক্তি গ্রহণের সুযোগ পায়। এর মাধ্যমে এই দেশগুলো বিভিন্ন বিদেশি ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। অন্যদিকে এফডিআইয়ের মাধ্যমে দাতা দেশগুলো খুব সহজেই অন্য দেশের বাজারে প্রবেশের সুযোগ পায়। সেইসঙ্গে তারা পায় প্রয়োজনীয় কাঁচামালের সহজলভ্যতা, বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায় প্রবেশ ও উত্পাদনের উত্কর্ষতা বাড়ানোর সুযোগ। একই সঙ্গে রপ্তানিজনিত বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের সুযোগ পাওয়া যায়, যেমন — পরিবহন খরচ হ্রাসের সুযোগ। এছাড়াও আছে নিজ দেশে অর্থ পাঠানো এবং তা নিজ মুদ্রায় পরিবর্তনের সহজ সুযোগ।
একটি দেশে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য বাজার সম্প্রসারণ, মজুরি, বাণিজ্যের পরিমাণ এবং অবকাঠামো নির্মাণ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। বাংলাদেশে ১৯৮০ সাল থেকেই এফডিআই বান্ধব নীতি চালু রয়েছে। যেটি অন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে অনেক আগে প্রণয়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রবর্তন এবং সংরক্ষণ নীতি ১৯৮০ অন্যতম। বিদ্যমান নিয়ন্ত্রণ কাঠামো যথেষ্ট সহনশীল ও বিনিয়োগ উপযোগী, যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহী করে তোলার জন্য উপযোগী। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর মওকুফ, দক্ষ জনশক্তির ওয়ার্ক পারমিট এবং তাদের বেতনের প্রায় অর্ধেক নিয়ে যাওয়ার সহজ সুযোগ প্রদান।
তবে কিছু বিদেশি বিনিয়োগের আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে এখনো কয়েকটি বড় বাধা রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো অবকাঠামোগত সুবিধার স্বল্পতা, দক্ষতার অভাব এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা।
অবকাঠামোর ক্ষেত্রে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত্ ও গ্যাসের যোগান এবং উন্নত রাস্তাঘাট অপরিহার্য। জনশক্তির ক্ষেত্রে যদিও বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তির ব্যাপক অভাব রয়েছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা দেখতে চায় তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থের নিরাপত্তা কতটুকু রয়েছে, বিনিয়োগ করে তারা অর্থ ফেরত পাবে কি না। তাছাড়া আর একটি উল্লেখযোগ্য সীমাবদ্ধতা রয়েছে তা হচ্ছে বাংলাদেশে জমির অভাব এবং জমি পেতে অনেক বিলম্ব হওয়া। একদিকে যেমন জমির স্বল্পতা, অন্যদিকে জমির স্বচ্ছ রেকর্ড ব্যবস্থা দুর্বল। একটি আধুনিক পদ্ধতিতে জমির মালিকানায় স্বচ্ছতা থাকা একান্ত অপরিহার্য। আরেকটি বড় সীমাবদ্ধতা হলো, সুশাসনের অনুপস্থিতি। সস্তা শ্রম এবং সেবাখাতে অন্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশে সুবিধা বেশি পাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা এই দেশকে লাভজনক বলে মনে করছেন। তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রিতা এবং স্বচ্ছতার অভাবের মতো পরিস্থিতির জন্যও এফডিআই প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এফডিআইয়ের পরিমান বাড়ানোর পাশাপাশি এফডিআই বহুমুখী করাও গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৯০ সালের দিকে পূর্ব এশিয়া এবং ইউরোপের দেশগুলো বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ব্যবসাবান্ধব উপাদানগুলোর সার্বজনীনতা এবং বিশ্ব শ্রমবাজারের তুলনায় সস্তা শ্রমের কারণে তারা আগ্রহী হয়। সমপ্রতি দেখা গেছে এফডিআই প্রধানত প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহন, গুদামজাত, যোগাযোগ, বাণিজ্য-বিপণন, জ্বালানি, গ্যাস ও পেট্রোলিয়ামের মত ক্ষেত্রগুলোতে বেশি আসছে। কৃষি, নির্মাণ ও সেবাখাতে এএফডিআইয়ের ভূমিকা এখনো স্বল্প।
স্থানীয়ভাবে পণ্য উত্পাদন, কাঁচামালের যোগান, স্বচ্ছতার সঙ্গে সেবা প্রদান এবং কর্মসংস্থানের ওপর এফডিআই নির্ভর করে। স্থানীয় ব্যবসায়ের সমপ্রসারণ ঘটলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও তাদের অর্থ বিনিয়োগ করতে ভরসা পায়। এফডিআই বাড়ানো এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জনে পর্যাপ্ত অর্থায়নের মাধ্যমে স্থানীয় ব্যবসা সমপ্রসারণও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বর্তমানে অর্থনৈতিক কূটনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনাও গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হচ্ছে। এই কাজটি সরকার এবং বেসরকারী খাতের প্রতিনিধিরা মিলে করতে পারেন।
কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে এফডিআইয়ের প্রভাব বাড়াতে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগের জন্য বিনিয়োগকারীদের আগ্রহী করে তুলতে হবে। অধিক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয় এমন খাতগুলোতে এফডিআই প্রয়োজন। অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিদেশি বিনিয়োগ বিশেষভাবে প্রয়োজন। কারণ এ খাতের ওপরই নির্ভর করছে বাংলাদেশের উন্নয়ন। দুর্বল অবকাঠামো সুবিধার কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। তবে এটিও বিনিয়োগের অন্যতম খাত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তৈরি পোশাক শিল্প ছাড়াও সিরামিক্স, হিমায়িত খাদ্য, চামড়া, কৃষিজাত পণ্য, ওষুধ এবং জাহাজ নির্মাণ শিল্পেও বিদেশি বিনিয়োগ হতে পারে।
নানা রকম বাধা-বিপত্তি এবং সমস্যা, যেমন- প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহার, রাজনৈতিক অস্থিরতা, উত্পাদনের উপকরণের স্বল্পতা ইত্যাদিতে জর্জরিত থাকার পরও বাংলাদেশ বেশকিছু ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা অর্জন করেছে। কৃষি, রেমিটেন্স এবং তৈরি পোশাক শিল্পের মতো বলিষ্ঠ খাত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল চালিকা শক্তিতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থানকে আরো উন্নত করতে চাইলে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাব বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের পথে অন্যতম বাধা।
বিশ্বে সবচেয়ে কম মজুরির দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। জনাধিক্যের এই দেশে অধিক মুনাফা অর্জনের একটি বড় বাজার রয়েছে। বিগত চার দশকে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে একটি সাহায্যনির্ভর দেশ থেকে বাণিজ্যনির্ভর দেশে পরিণত হচ্ছে। দেশের জিডিপিতে বিদেশী সাহায্যের পরিমান কমছে, আর বাণিজ্যের অংশ বাড়ছে। আমদানী, রফতানী, রেমিটেন্স প্রবাহ, এফডিআই ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা বিশ্ব অর্থনীতির সাথে ক্রমশ অধিক হারে যুক্ত হচ্ছি। এফডিআইয়ের জন্যও যথেষ্ট সম্ভাবনাময় একটি দেশে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সম্ভাবনার কথা বর্তমানে দেশে-বিদেশে স্বীকৃত। যেমন গোল্ড ম্যান স্যাকস্ আগামীতে এগারটি সম্ভাব্যতাময় দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি হিসাবে উল্লেখ রয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও আগ্রহ দেখাচ্ছে, নীতিনির্ধারকদের এই সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া অপরিহার্য।
লেখক : গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ