Published in The Daily Inquilab on Tuesday, 9 September 2014.
জাপানের প্রধানমন্ত্রী সফর : ঘরে তুলতে হবে সুফল
তাকী মোহাম্মদ জোবায়ের ও হাসান সোহেল
জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো অ্যাবের বাংলাদেশ সফরে বিপুল বিনিয়োগের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে সুফল ঘরে তুলতে হবে। এই সফরে জাপান ত্বরিত লাভবান হলেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারলে বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদে লাভবান হবে। জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সফরকে এভাবেই মূল্যয়ন করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জাপানি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের জন্য প্রস্তুত। বাংলাদেশকে এখন বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। বাংলাদেশকে কোনভাবেই এই অপার সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মধ্যআয়ের দেশ হতে জিডিপি’র ৩৪ শতাংশ বিনিয়োগ দরকার। বিনিয়োগ বাড়াতে হলে প্রচুর বিদেশি বিনিয়োগ আনতে হবে। আর জাপান এই বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় উৎস হতে পারে। তবে, এজন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে বলে মত দিয়েছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। পাশাপাশি জাপানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কৌশলগত অবস্থানের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন তারা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সফরে সফল হয়েছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী। যেসব উদ্দেশ্য নিয়ে ঢাকা এসেছিলেন সবই পেয়েছেন। ঢাকা জাতিসংঘে অস্থায়ী নিরাপত্তা পরিষদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ২০১৬-১৭ মেয়াদের জন্য নির্বাচন হবে চলতি সাধারণ অধিবেশনে। জাপান এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীনভাবে আসনটি নিশ্চিত করতে চেয়েছিল। জাপানের প্রধান সংবাদপত্র আসাহি সিম্বুন জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সফরের পেছনে আরেকটি কারণ উল্লেখ করেছে। অ্যাবে’র বাংলাদেশ সফর নিয়ে সংবাদপত্রটি বলেছে, এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলা অ্যাবের সফরের অন্যতম লক্ষ্য। আর এ লক্ষ্যেও জাপানি প্রধানমন্ত্রী সফল হয়েছেন বলে সংবাদপত্রটি বলেছে।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, শিনজো অ্যাবে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে সচেষ্ট। আর জাতিসংঘের অস্থায়ী নিরাপত্তা পরিষদ এই ভূমিকা পালনের একটি বড় প্লাটফর্ম। অন্যদিকে জাপান এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নীতি সমর্থনকারী দেশ। এজন্য এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলা করতে চায় জাপান। পাশাপাশি চীনের সঙ্গে সম্প্রতি সামিরক উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ায় নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য পদটি জাপানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এজন্যই সদস্যপদটি নিশ্চিত করতে সচেষ্ট তিনি।
বাংলাদেশের সঙ্গে এই পদটি নিয়ে জাপানের অভিজ্ঞতা তিক্ত। ১৯৭৮ সালে জাপানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বাংলাদেশ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যপদ লাভ করে। এই অতিত অভিজ্ঞতা থেকে জাপান চাইছিল বাংলাদেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় না আসুক। এই লক্ষ্যে সফল হয়েছেন অ্যাবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জাপান ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আলোচনা শেষে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, নিরাপত্তা ও শান্তি ইস্যুতে যৌথ সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য ২৫ অনুচ্ছেদের একটি ইশতেহার ঘোষণা করা হয়েছে। এতে জাপানি নতুন কোন তহবিল বা সহায়তার ঘোষণা নেই। তবে, বাংলাদেশ তার প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় নতুন সহায়তা আশা করেছিল। এই আশার জবাবে অ্যাবে বলেছেন, জাপানের উদ্যোক্তারা চায় বিনিয়োগের জন্য অবকাঠামো, নিñিদ্র যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ এবং সকল শিল্পে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা সম্প্রসারণ। পূর্বের প্রতিশ্রুত ৬ বিলিয়ন ডলারের সহায়তার ঘোষণা পুনর্ব্যক্ত করে অ্যাবে বলেছেন, স্বল্পমেয়াদে যেসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয় সে রকম প্রতিশ্রুতি জাপান দেবে না।
ইশতেহারে বলা হয়েছে, জাপানি বিনিয়োগ আকর্ষণে উপযুক্ত স্থান, প্রতিযোগিতামূলক প্রণোদনা, অবকাঠামো উন্নয়ন ও দক্ষ শ্রমিক সরবরাহের নিশ্চয়তা চেয়েছে জাপান। এতে বিশেষভাবে বিদেশি বিনিয়োগ কর্তৃপক্ষের উন্নত সেবা ও প্রাথমিক জ্বালানি ও বিদ্যুতের নিশ্চয়তার ওপর বেশি জোর দেয়া হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন কর্তৃপক্ষকে।
জতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হারুন উর রশিদ বলেন, বাংলাদেশের প্রয়োজন বিনিয়োগ সুবিধা তৈরি করা। জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলো চায় কার্যকরি, দ্রুত এবং দক্ষ ওয়ান স্টপ সার্ভিস। অর্থাৎ বিনিয়োগ বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংক, বেপজা, বেজা এক ছাদের নিচে নিয়ে আসতে হবে যেখানে বিনিয়োগকারীদের জন্য উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার থাকবে। এর সঙ্গে সুশাসন, স্বাধীন বিচার বিভাগ, বিনিয়োগবান্ধব আইন, তাদের প্রধান চাহিদা । এসব না হলে তারা বিনিয়োগ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে বলে উল্লেখ করেন এই বিশ্লেষক।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগের আগে জাপানি বিনিয়োগকারীরা যেসব প্রশ্নের উত্তর চাইবে তার মধ্যে রয়েছে, রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল কি না; মানবসম্পদ কতটা দক্ষ; উন্নত সড়ক ও পরিবহন ব্যবস্থা আছে কি না; বন্দর ব্যবস্থা উন্নত কি না; বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ সুস্থ ব্যস্টিক অর্থনৈতিক নীতিমালা আছে কি না; সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই আইনে পরিবর্তন আসবে কি না; ব্যবসা পরিচালনায় কেমন সময় লাগে।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সিঙ্গাপুরে একটি নতুন ব্যবসা চালু করতে ৫ থেকে ৮ দিন সময় লাগে। আর বাংলাদেশে ন্যূনতম ৩৫ দিন সময় লাগে। সম্প্রতি সিপিডি বিদেশি বিনিয়োগের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দুর্নীতি ও নিয়ন্ত্রণমূলক শ্রম আইনকে চিহ্নিত করেছে।
সম্প্রতি ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই) বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এতে সংগঠনটি উল্লেখ করেছে, সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো অদক্ষ ও কার্যত ক্ষমতাহীন। আমলারা সিদ্ধান্ত দিতে অহেতুক দীর্ঘ বিলম্ব করেন। এদেশের উন্নয়নে আমরা আরও বেশি কাজ করতে চাই। কিন্তু সরকারকে সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
পাওয়া-না পওয়ার হিসাব
বিনিয়োগ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, অ্যাবের এই সফরের মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ক নতুন মাত্রা পেয়েছে। এতদিনের দাতা-গ্রহীতার সম্পর্ক এখন অংশীদারিত্ব ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে রূপান্তরিত হয়েছে। তবে এই সুযোগ কাজে লাগাতে বাংলাদেশকে দ্রুত প্রস্তুতি নিতে হবে। সেই সঙ্গে কৌশলগত অবস্থানও জরুরি।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, জাপানের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি এখানে অবকাঠামো খাতে সহায়তার কথা বলেছেন। বঙ্গোপসাগর ঘিরে অর্থনৈতিক অঞ্চলের ওপর নজর দিয়েছেন। আর এটা হলে বঙ্গোপসাগরের আশপাশের দেশগুলোর থেকে বাণিজ্য পাবে বাংলাদেশ। তার মতে, চীন থেকে নিজেদের নির্ভরশীলতা কমানোর কৌশল নিয়েছে জাপান। সেক্ষেত্রে চীনের বিকল্প হতে পারে বাংলাদেশ। আর এই সুযোগ বাংলাদেশ নিতেই পারে। এ ছাড়া জাপান স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে যে ঋণ দেয়, সেই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। তিনি বলেন, তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই চীন, জাপান, ভারত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ বিষয়ে কৌশলগত অবস্থান ঠিক করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য জাপান যে আগ্রহ দেখাচ্ছে তা অত্যন্ত ইতিবাচক। এই আগ্রহের প্রেক্ষাপট হিসেবে বেশকিছু বিষয় আছে। চীনে জাপানের যে বিনিয়োগ আছে তার পাশাপাশি নতুন একটি স্থান খোঁজা হচ্ছে। চায়না প্লাস ওয়ান নামে যে পলিসি জাপান নিয়েছে তার অংশ হিসেবেই এই ধরনের সিদ্ধান্ত। তারা এ জন্য বাংলাদেশকে একটি সম্ভাবনাময় স্থান হিসেবে নিয়েছে। আগেও তারা বাংলাদেশের বিষয়ে এ ধরনের আগ্রহ দেখিয়েছে। কিন্তু নানা ধরনের বাধার কারণে তা সম্ভব হয়নি। এখন সেই সমস্ত বাধা কতটা দ্রুত দূর করা সম্ভব, তাই দেখার বিষয়। তাদের চাহিদা মোতাবেক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করাটাই বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জ।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, চৌদ্দ বছর পর কোনো জাপানি প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে এসেছেন। জাপান আমাদের বড় সহায়তাকারী দেশ। জাপানি বিনিয়োগে মেট্রোরেল ও মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিভিন্ন প্রকল্পে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও আরও অনেক প্রকল্প হতে পারে যেগুলোতে বাংলাদেশের নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বিশাল সুযোগ হবে। বিগ-বি ছাড়াও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ইতিবাচক উদ্যোগ। সবমিলিয়ে এ কথা বলাই যায়, জাপানের প্রধানমন্ত্রীর এই সফর বাংলাদেশের সম্ভাবনার ইঙ্গিত বহন করে।
জাইকা প্রধান গত জুনে জানিয়েছেন, বিগ-বি’র অধীনে মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক নির্মাণ করবে জাপান। এর ফলে বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার গেটওয়ে হওয়ার সুযোগ রয়েছে। বিগ-বি বাস্তবায়িত হলে ভুটান, নেপাল, উত্তর-পূর্ব ভারতের ৭ কোটি মানুষের বাজার বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার সুযোগ রয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য আরাস্তু খান বলেন, বিনিয়োগের বিষয়ে জাপানের অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে। জাপানের অনেক ব্যবসায়ী রয়েছেন যারা চীনে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। তবে সম্প্রতি চীনের কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপড়েনের পাশাপাশি উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগের নতুন জায়গা খুঁজছে। এজন্য তারা ফিলিপাইন, কম্বোডিয়া ও বাংলাদেশকে সম্ভাব্য স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে। জাপান বিনিয়োগ করলে অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। এটা আমাদের অর্থনীতির জন্য সুখকর। জাপান অনেক বিনিয়োগও করছে। দ্রুততা, সততা নিশ্চিতের পাশাপাশি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করতে পারলে প্রচুর জাপানি বিনিয়োগ পাওয়া সম্ভব হবে। এতে আমরা দীর্ঘমেয়াদে লাভবান হবো। জাপানি বিনিয়োগ আকর্ষণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোকে নির্দেশ দিয়েছেন।
বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের ভাইস প্রেসিডেন্ট হুমায়ুন কবির বলেন, শিনজো অ্যাবে বাংলাদেশ সফরকালে নিশ্চিতভাবেই একটি বড় উপহার পেয়েছেন। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যপদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে ঢাকা সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। তিন যুগ আগে ১৯৭৮ সালে জাপান এ পদে প্রার্থী হয়ে বাংলাদেশের কাছে পরাজিত হয়েছিল। টোকিওর কাছে সে স্মৃতি অবশ্যই তিক্ত। সঙ্গত কারণেই তারা বিশ্ব সংস্থার নির্বাচনে আরেকবার ঝুঁকি নিতে চায়নি। বাংলাদেশ কী পেল- এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফরকালেই ৬ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব পেয়েছিলেন। শিনজো অ্যাবে বলে গেলেন, প্রয়োজনে এর পরিমাণ আরও বাড়ানো হবে। অর্থাৎ উন্নয়নের সম্ভাবনার উন্মোচিত দিগন্ত আরও স্পষ্ট হয়ে গেল। দ্বিতীয় যে বিষয়টি বলব সেটা হলো, বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্ট (বিগ-বি নামে যা পরিচিত) উদ্বোধনের ঘোষণা। জাপানের একটি প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা ও ভারতকে নিয়ে এমন একটি অর্থনৈতিক বলয় সৃষ্টি, যেখানে তার জন্য বড় বাজারের সুযোগ মিলবে। শিনজো অ্যাবে ঢাকায় বলেছেন, তার দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করার জন্য বাংলাদেশ গুরুত্ব¡পূর্ণ। বহু দশক ধরে জাপান যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পণ্য রফতানি করে আসছে। কিন্তু এখন তাকে ভিন্নভাবে রফতানি ও বিনিয়োগের বিষয়টি ভাবতে হচ্ছে এবং বাংলাদেশকে এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে গণ্য করতে তাদের যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে।
তিনি বলেন, বিনিয়োগ বোর্ড, জাপানি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নের আহ্বান জানিয়েছেন। অর্থাৎ আমরা যেখানে রয়েছি, সেটা সন্তোষজনক অবস্থান নয়। আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো যথেষ্ট দুর্বল। তিনি বলেন, জাপান এমন শ্রমিক পেতে চান যারা হবেন সুদক্ষ ও সৃজনশীল। কেবল সস্তা শ্রমের ধারণা নিয়ে থাকলে চলবে না। একই সঙ্গে জাপান ও চীনের প্রতিশ্রুত সহায়তা পেতে হলে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বর্তমানের তুলনায় অচিরেই অন্তত ১১ গুণ বাড়াতে হবে।
জাপানের সহায়তা বাড়ছে
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা যায়, সরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশে জাপানের বিনিয়োগ প্রতিবছর বাড়ছে। সদ্য সমাপ্ত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশটি বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ৩৬ কোটি ডলার সহায়তা দিয়েছিল। এর মধ্যে ঋণ ছিল ৩৪ কোটি ডলার আর বাকি দুই কোটি ডলার ছিল অনুদান। এর আগের বছর দেশটি থেকে ৩৫ কোটি ডলার পেয়েছিল সরকার। তারও আগের বছর পাওয়া গেছে ২৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ প্রতিবছরই ঋণের পরিমাণ বাড়ছে।
ইআরডি জানায়, অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও দেশ থেকে যেসব ঋণ নেওয়া হয়, তার সঙ্গে জাপানের ঋণের কোনো মিল নেই। কারণ, জাপানের ঋণে সুদের হার খুবই কম। এই হার শূন্য দশমিক ১ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের ঋণের সুদের হার দশমিক ৭৫ পয়সা। আর এডিবির ক্ষেত্রবিশেষে দুই থেকে তিন শতাংশ। চীনের ঋণের সুদের হারও তিন থেকে চার শতাংশ। এ ছাড়া ওই সব ঋণের ক্ষেত্রে অনেক শর্ত জুড়িয়ে দেয়া হয়, যেটা জাপানের ক্ষেত্রে হয় না। দেশটি প্রতিবছর ঋণের একটা অংশ মওকুফ করে দেয় যেটা অন্য কোনো দেশ বা সংস্থা করে না। এজন্য জাপানের ঋণ বাংলাদেশ আলাদা গুরুত্ব দেয়।
ইআরডির কর্মকর্তারা বলছেন, জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো অ্যাবের বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে দেশটির সহযোগিতার পরিমাণ আরো বাড়বে। তারা বলছেন, জাপানি বিনিয়োগকারীরা এ দেশে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করবে, যেখানে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে দেশটির অর্থায়নে গঙ্গা ব্যারাজ, যমুনা নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ, বঙ্গবন্ধু সেতুর পাশে সমান্তরাল আলাদা একটি রেলসেতুর মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব মোহাম্মদ মেসবাহ উদ্দিন বলেন, জাপানি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। জাপানি উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা বিনিয়োগ জোন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
Published in The Daily New Nation on Monday, 8 September 2014.
Withdrawal of UNSC candidature
No give-and-take policy: Japan Infrastructure crisis to ease: Experts
Shahidul Islam Shahid
Noted Foreign Policy experts and businessmen have expressed mixed reactions over outcomes of Prime Minister Shinjo Abe’s visit, particularly Bangladesh’s withdrawal of candidature from the UN Security Council (UNSC) membership in favour of Japan without getting anything in exchange.
All of them termed the Japanese Prime Minister’s visit to Bangladesh after 14 years ‘an important event for our nation in the field of economy and trade since it will trigger a new vista for rapid economic growth through massive Japanese investment in industry and infrastructure.
They, however, warned that the potential Japanese investment, which would also encourage foreign direct investment from other developed countries eventually would not come true if Bangladesh’s political leadership of both the ruling AL and opposition parties, including BNP, failed to create what they said, “An investment friendly atmosphere in the country through peace and political stability.” They said this while talking to The New Nation separately on Sunday evening after the Japanese Prime Minister’s departure for Sri Lanka, concluding his two-day visit to Bangladesh.
Meanwhile, The Japanese Foreign Affairs Ministry spokesperson Kuni Sato, however, said, “It’s because of long-term relations between Japan and Bangladesh. We will always consider Bangladesh as trusted friend even if Bangladesh continues to contest the election.” She conveyed the message while talking to a selected group of journalists at a breakfast briefing at city’s Sonargaon Hotel, where the Japanese Prime Minister Shinzo Abe was staying during his visit to Bangladesh.
“His coming to Bangladesh with chief executives of top companies of Japan was a signal to developed countries to attract large investment in this country. “Bangladesh can show the West that one of the G-7 member countries is coming to Bangladesh with trust in a bigger way,” said Sato.
Japan thinks the sudden upswing of relations is natural and purely driven by economic factors. The official also said the visit by the Japanese Prime Minister is very timely as the CEOs of top industries in Japan are very much keen to invest in Bangladesh as they found the country a very promising one in the days to come, she added.
Talking to The New Nation, leading Foreign Policy expert of the country, Prof Dr Imtiaz Ahmed of Dhaka University said, “Bangladesh had to concede the candidature of non-permanent membership to Japan without any give and take policy because our government was suffering from a “Governance and credibility crisis”, created after January 5 non-participatory general election.”
“Bangladesh ought to have get something important from Japan in exchange of the withdrawal of candidature to UNSC non-permanent membership election if there were no ‘Governance and credibility crisis’ of the country’s administration,” he said. Without contradicting the above observation directly, former Ambassador Mohammad Zamir, who is a member of the ruling Awami League (AL) Advisory Council, said, “The decision by Bangladesh to withdraw candidature in the election to the non-permanent membership of the UNSC will not diminish the importance of the profile of Bangladesh in the world community or the United Nations.
“He said, “Our participation in the United Nations’ Peace Keeping Operation has brought an imminent position for Bangladesh in that organization.” Prof Dr Shahiduzzaman of Dhaka University has said Bangladesh did not specifically get anything from Japan for withdrawal of UNSC candidature.
He asserted saying, “To my mind, the relations with Japan is more important to Bangladesh than that of the non-permanent membership of the UNSC’s importance is.
“Leading economist Executive Director of CPD Dr Mustafizur Rahman told this Correspondent that the main message of the Japanese Prime Minister’s visit to Bangladesh was: “Our country’s main problem for investment, growth and employment creation is the lack of infrastructure and that problem is going to be solved the potential massive investment from Japan.
Business leaders, including BGMEA President M Atiqul Islam, President of Japan-Bangladesh Chamber of Commerce and former leader FBCCI and BARVIDA Abdul Haque told The New Nation that both bilateral trade and Japanese investment in Bangladesh would significantly increased as an outcome of the Shinjo Abe’s visit.
Published in Bangladesh Pratidin
কী পেল বাংলাদেশ
ঢাকা ছাড়লেন জাপানি প্রধানমন্ত্রী আবে
জুলকার নাইন ও রুহুল আমিন রাসেল
বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম পরাশক্তি জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের ঢাকা সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশের সামনে বড় ধরনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। জাপানে দায়িত্ব পালন করা রাষ্ট্রদূত, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক, ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা এমনটিই মনে করছেন। তারা বলছেন, এতদিনের দাতা-গ্রহীতার সম্পর্কের বাইরে গিয়ে জাপানের সঙ্গে অংশীদারিত্ব ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ফলে নতুন মাত্রা পাবে। তবে এই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বাংলাদেশের দ্রুত প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন।
সেই সঙ্গে বর্তমান আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান নির্ধারণও জরুরি।জাপানে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত আশরাফ উদ দৌলা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘শিনজো আবের এই সফরে বাংলাদেশের সামনে বিরাট সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। পরীক্ষিত বন্ধু ও উন্নয়ন সহযোগী জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সমন্বিত অংশীদারিত্ব শুরু হয়েছে, তা এক নতুন যুগের সূচনা করতে যাচ্ছে।’ সাবেক এই কূটনীতিকের মতে, জাপানি প্রধানমন্ত্রীর সফর চারটি কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এক, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে শিনজো আবের এ সফর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বড় ধরনের কূটনৈতিক সফলতা। যার একটি প্রভাব নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আছে। দুই, লক্ষণীয় হলো, বাংলাদেশের সঙ্গে একই সময়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখছে ভারত, চীন ও রাশিয়া। সেখানে নতুন করে যুক্ত হচ্ছে জাপান। তিন, জাপানের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কের নতুন যাত্রা শুরু হওয়া। চার, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের গুরুত্ব বৃদ্ধি হওয়া।
আশরাফ উদ দৌলা বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে জাপান বাংলাদেশকে ১১ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে। আর ২০১৪ সালেই প্রায় ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রতিশ্রুতি এসেছে। আবার বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে জাপান সরকারের প্রস্তাবিত বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ (বিগ-বি) ইনিশিয়েটিভ বা বিগ-বি বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ হবে এই অঞ্চলের উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু। মূলত ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এলাকায় শিল্পায়নকে সামনে রেখে এই বিগ-বি উদ্যোগটির পরিকল্পনা করা হয়েছে। তখন পুরো উপমহাদেশের বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে এই বেল্টটি সামনে আসবে।’ সাবেক এ রাষ্ট্রদূতের মতে, বাংলাদেশের সামনে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
তবে শুধু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বড় বড় বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীরা ঢাকা সফর করেই যে বিনিয়োগ করবেন তা নয়। এর জন্য বাংলাদেশের দ্রুততার সঙ্গে বড় ধরনের প্রস্তুতি নিতে হবে। কারণ বাংলাদেশে বিনিয়োগের সম্ভাবনাগুলোর চেয়ে সমস্যাগুলোই বেশি করে খতিয়ে দেখবে বিনিয়োগকারীরা। তাই চিন্তা করতে হবে আমরা এই বিনিয়োগ গ্রহণে কতটা প্রস্তুত। বাস্তব বিবেচনায় বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি পেতে সংকটসহ নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে। তা দ্রুত দূর করতে হবে। নিতে হবে প্রস্তুতি।
আশরাফ উদ দৌলা বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে শ্রমিক আন্দোলনের একটি ঘটনায় ঢাকার ইপিজেডে অবস্থিত জাপানি একটি কারখানায় আগুন দেওয়া হয়। জাপানের ব্যবসায়িক মহলে তা ফলাও করে প্রচার পায়। স্বাভাবিকভাবেই এই ধরনের ঘটনায় যে নেতিবাচক বার্তা পৌঁছায়, তাতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দেয়। তাই সব দিক থেকেই আমাদের সতর্কতার প্রয়োজন আছে।’ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে অস্থায়ী সদস্য পদে জাপানকে সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ঘোষণাকে বেশ ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন আশরাফ উদ দৌলা। তার মতে, এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাংলাদেশ কূটনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছে। কারণ এতে জাপানের কাছে বাংলাদেশ যে আস্থার জায়গায় পৌঁছেছে তা অমূল্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য জাপান যে আগ্রহ দেখাচ্ছে তা অত্যন্ত ইতিবাচক। এই আগ্রহের প্রেক্ষাপট হিসেবে বেশ কিছু বিষয় আছে। চীনে জাপানের যে বিনিয়োগ আছে তার পাশাপাশি নতুন একটি স্থান খোঁজা হচ্ছে। চায়না প্লাস ওয়ান নামে যে পলিসি জাপান নিয়েছে তার অংশ হিসেবেই এই ধরনের সিদ্ধান্ত। তারা এ জন্য বাংলাদেশকে একটি সম্ভাবনাময় স্থান হিসেবে নিয়েছে। আগেও তারা বাংলাদেশের বিষয়ে এ ধরনের আগ্রহ দেখিয়েছে। কিন্তু নানা ধরনের বাধার কারণে তা সম্ভব হয়নি। এখন সেই সমস্ত বাধা কতটা দ্রুত দূর করা সম্ভব, তাই দেখার বিষয়। তাদের চাহিদা মোতাবেক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করাটাই বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জ।’ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে জাপানকে সমর্থন দেওয়ার দুটি দিক আছে বলে মনে করেন এই বিশ্লেষক। তার মতে, জাপানের মতো বন্ধুর জন্য আত্মত্যাগ করাটা হয়তো ইতিবাচক। তবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতিও এমন যে, এখানে এমন একটি সরকার আছে যে নিজে দেশের প্রতিনিধিত্ব করে নির্বাচন করে জয়লাভ করতে সক্ষম নয়। সেজন্য অন্যকে সমর্থন দিয়ে বন্ধুত্ব জোরালো করাকে সুচিন্তিত সিদ্ধান্তই বলা যায়।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘জাপানের প্রধানমন্ত্রীর এবারের বাংলাদেশ সফর বিভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি এখানে অবকাঠামো খাতে সহায়তার কথা বলেছেন। বঙ্গোপসাগর ঘিরে অর্থনৈতিক অঞ্চলের ওপর নজর দিয়েছেন। আর এটা হলে বঙ্গোপসাগরের আশপাশের দেশগুলোর কাছ থেকে বাণিজ্য পাবে বাংলাদেশ।’ বাজার অর্থনীতির এই বিশ্লেষকের মতে, চীন থেকে নিজেদের নির্ভরশীলতা কমানোর কৌশল নিয়েছে জাপান। সেক্ষেত্রে চীনের বিকল্প হতে পারে বাংলাদেশ। আর এই সুযোগ বাংলাদেশ নিতেই পারে। এ ছাড়া জাপান স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে যে ঋণ দেয়, সেই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই চীন, জাপান, ভারত আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ বিষয়ে কৌশলগত অবস্থান ঠিক করতে হবে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন বা এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, ‘চৌদ্দ বছর পর কোনো জাপানি প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে এসেছেন। জাপান আমাদের বড় সহায়তাকারী দেশ। জাপানি বিনিয়োগে মেট্রোরেল ও মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিভিন্ন প্রকল্পে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়াও আরও অনেক প্রকল্প হতে পারে যেগুলোতে বাংলাদেশের নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বিশাল সুযোগ হবে। বিগ-বি ছাড়াও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ইতিবাচক উদ্যোগ। সবমিলিয়ে এ কথা বলাই যায়, জাপানের প্রধানমন্ত্রীর এই সফর বাংলাদেশের সম্ভাবনার ইঙ্গিত বহন করে।’
ঢাকা ছাড়লেন শিনজো আবে : দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফর শেষে ঢাকা ছেড়েছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। গতকাল সকালে তিনি শ্রীলঙ্কার উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। এর আগের প্রায় ২২ ঘণ্টার সফরে শিনজো আবে দিয়েছেন বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি এবং পেয়েছেন বন্ধুত্বের প্রতিদান হিসেবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য পদে জাপানের প্রতি বাংলাদেশের সমর্থন।শনিবার দুপুরে ঢাকা এসে পৌঁছানো শিনজো আবে গতকাল স্ত্রী আকিয়ে আবেসহ ১৬৮ সদস্যের প্রতিনিধি দল নিয়ে সকাল সাড়ে ১০টায় বিশেষ বিমানে ঢাকা ত্যাগ করেন। তিনি শ্রীলঙ্কার উদ্দেশ্যে হযরত শাহজালাল (রহ.) বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। এ সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক তাকে বিদায় জানান। এর আগে সফরের দ্বিতীয় দিন সকালে শিনজো আবে দিনের এক মাত্র কর্মসূচি হিসেবে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে। সকাল সাড়ে ৯টায় শিনজো আবে সস্ত্রীক বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছানোর পর লাল গালিচা সংবর্ধনা পান। তাকে স্বাগত জানান উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। পরে প্রায় ২০ মিনিট সেখানে অবস্থানকালে জাপানি প্রধানমন্ত্রী চারুকলার দুটি গ্যালারি ঘুরে দেখেন। একটিতে ছিল জাপানের বৃত্তিপ্রাপ্ত বাংলাদেশি শিল্পীদের চিত্রকর্ম এবং অন্যটিতে চারুকলার শিক্ষার্থীদের শিল্পকর্ম। উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিক জানিয়েছেন, জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিল্পকলা অনেক পছন্দ করেন। তার বিশেষ আগ্রহের কারণেই এই পরিদর্শনের আয়োজন করা হয়েছে। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে জাপানের প্রধানমন্ত্রীকে সম্মানসূচক ক্রেস্ট এবং চারুকলা অনুষদের পক্ষ থেকে একটি চিত্রকর্ম উপহার দেওয়া হয়। সেখান থেকে সরাসরি বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন শিনজো আবে। শ্রীলঙ্কা গণমাধ্যমের তথ্যানুসারে দুপুরে কলম্বোর বন্দরনায়েকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান শিনজো আবে।মিতসুবিশি, তোশিবা, নিপ্পনের মতো জাপানের প্রায় সব কয়টি বড় কোম্পানির প্রধান নির্বাহীদের নিয়ে ঢাকা সফরে জাপানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকে যোগ দেওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বিজনেস ফোরামের বৈঠকে যোগ দেন। পাশাপাাশি রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ, বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম রওশন এরশাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। গিয়েছিলেন জাতীয় স্মৃতিসৌধে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে। তার সফরসঙ্গী ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। জাপানের প্রধানমন্ত্রী ও ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে তারা জোর দিয়েছেন বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতির দিকে। এই পরিবেশ উন্নয়নের জন্য জাপানের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তার প্রতিশ্রুতিও পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে গত মে মাসে প্রতিশ্রুত ৬ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তার নিশ্চয়তা। আর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জাপানকে দেওয়া হয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য পদের জন্য আগামী বছর নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে প্রার্থিতা প্রত্যাহার ও সমর্থন। বাংলাদেশের এই প্রার্থিতা প্রত্যাহারের ফলে এশিয়া প্রশান্ত অঞ্চলে একক প্রার্থী হিসেবে থাকল জাপান। আর বন্ধুর জন্য আত্মত্যাগ করে বাংলাদেশও জাপানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে নিয়ে গেল নতুন উচ্চতায়।