Dr Khondaker Golam Moazzem on crucial aspects for determining RMG minimum wage

Dr Khondaker Golam Moazzem writes on some crucial aspects for determining RMG minimum wage, published under Op-ed in Banik Barta on Tuesday, 24 September 2013.

উপসম্পাদকীয়: তৈরি পোশাকশিল্পে ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণে বিবেচ্য বিষয়াবলি

ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

পোশাকশিল্প শ্রমিকদের জন্য গঠিত ন্যূনতম মজুরি বোর্ডে বর্তমানে ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণের কাজ চলছে। এরই মধ্যে মজুরি বোর্ড চারটি বৈঠক সম্পন্ন করেছে, যার মাধ্যমে শ্রমিক ও মালিকপক্ষের মজুরি প্রস্তাবনা সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি। শ্রমিকপক্ষের প্রস্তাবনায় সপ্তম গ্রেডের জন্য ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার ১১৪ এবং মালিকপক্ষের প্রস্তাবনায় ৩ হাজার ৬০০ টাকা বলা হয়েছে। এ থেকে স্পষ্ট যে, শ্রমিকপক্ষের প্রত্যাশা ও মালিকপক্ষের প্রস্তাবনার মধ্যে বিস্তর ফারাক বিদ্যমান।
মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে দুই পক্ষই শ্রম আইন ২০০৬ (সংশোধিত শ্রম আইন ২০১৩)-এ বর্ণিত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে নিজেদের যুক্তি উপস্থাপন করার কথা বলেছে। দুঃখজনক হলো, বিবেচিত বিষয়গুলোর দু-একটি ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য তথ্য-উপাত্ত নেই। ফলে দুই পক্ষের উত্থাপিত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণপূর্বক মজুরি প্রস্তাবনা নিয়ে বাস্তবভিত্তিক আলোচনা করা প্রায় দুরূহ।
ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে বিদ্যমান সমস্যা: পোশাক খাতের মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে তিন ধরনের সমস্যা রয়েছে। প্রথমত. ন্যূনতম মজুরির সুস্পষ্ট কোনো সংজ্ঞা নেই। শ্রম আইন ২০০৬ বা সংশোধিত শ্রম আইন ২০১৩-এ ন্যূনতম মজুরির ক্ষেত্রে কোন কোন বিষয় বিবেচনা করা হবে তা বলা হলেও এর কোনো সংজ্ঞা দেয়া হয়নি। অবশ্য মজুরির সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা রয়েছে। এদিক থেকে ন্যূনতম মজুরি সংজ্ঞায়িত করার বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া দরকার।
দ্বিতীয়ত. ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে কোন গাণিতিক সংজ্ঞা অনুসরণ করা হবে, তাও সুস্পষ্ট নয়। এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট গাণিতিক সংজ্ঞা ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। অন্যান্য দেশে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট গাণিতিক নিয়ম ব্যবহার করতে দেখা যায়, যা বাংলাদেশেও বিবেচনা করা যেতে পারে।
তৃতীয়ত. ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে আইনগতভাবে বিবেচ্য বিষয়-সম্পর্কিত তথ্যের ঘাটতি রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, মজুরির ক্ষেত্রে শ্রম উৎপাদনশীলতা, শ্রমিকের জীবনযাত্রার মান ও ব্যয়, কারখানার ক্ষমতা বা শিল্প খাতের সক্ষমতা ইত্যাদি বিবেচনায় রাখার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এসব বিষয়ে জাতীয় কোনো তথ্যভাণ্ডার নেই। প্রায়ই মজুরি বৃদ্ধিজনিত চাপ মোকাবেলায় কারখানাগুলোর সক্ষমতার তারতম্যের কথা বলা হয়। অথচ সক্ষমতার তারতম্য বিচারের জন্য পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত নেই। ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে তথ্যের ঘাটতি একটি গুরুত্বপূর্ণ অন্তরায়।
এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণে নিম্নোক্ত বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন।
ন্যূনতম মজুরির সংজ্ঞা: আইএলওর কনভেনশন ১৩১-এর আলোকে পোশাকশিল্পে ন্যূনতম মজুরির সংজ্ঞা নির্ধারণ করা যেতে পারে। ওই কনভেনশন অনুসারে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে শ্রমিক ও তার পরিবারের মানসম্পন্ন ন্যূনতম জীবনধারণ এবং নির্দিষ্ট পরিমাণ সঞ্চয় বিবেচনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে শুধু শ্রমিক নয়, শ্রমিকের পরিবারও ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হবে। আবার পরিবারে একাধিক উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ব্যয় ভাগাভাগি করে নেন বলে এর সংখ্যাও বিবেচনায় নেয়া গুরুত্বপূর্ণ।
ন্যূনতম মজুরির প্রকৃত মাত্রা: ন্যূনতম মজুরির ক্ষেত্রে ন্যূনতম বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত শ্রমিকের পরিবারের ন্যূনতম জীবনমান নিশ্চিত করা। শ্রমিকের জীবন ব্যয় পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তাদের বর্তমান আয় ন্যূনতম জীবনযাপনের জন্য পর্যাপ্ত নয়। এক্ষেত্রে ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। অন্তত শ্রমিকের মজুরি তার পরিবারের সার্বিক ব্যয় মেটানোর জন্য যথেষ্ট হওয়া উচিত। নীতিগতভাবে একমত হলে ন্যূনতম মজুরি বোর্ড ন্যূনতম মজুরির সংজ্ঞায়নের প্রস্তা্ব দিতে পারে।
শ্রমিকের আয়-ব্যয়: সম্প্রতি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) থেকে দেশের তিনটি এলাকায় গার্মেন্ট শ্রমিকদের আয়-ব্যয়-সংক্রান্ত নমুনা জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে। জরিপে দেখা গেছে, শ্রমিকদের আয়-ব্যয় ও জীবনমান-সম্পর্কিত তথ্য জাতীয়ভাবে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত থেকে অনেকাংশে ভিন্ন। বিশেষ করে শ্রমিকের পরিবারের খাদ্য এবং খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় প্রায় কাছাকাছি। খাদ্যবহির্ভূত ব্যয়ের মধ্যে রয়েছে বাড়িভাড়া, শিক্ষা ও চিকিত্সা ব্যয়, সেলফোন বিল ইত্যাদি। সুতরাং খাদ্য-সংক্রান্ত ব্যয় প্রাধান্য দিয়ে এবং খাদ্যবহির্ভূত ব্যয়কে পর্যাপ্তভাবে বিবেচনায় না নিয়ে শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ অসম্পূর্ণ বলে বিবেচিত হতে পারে। দ্বিতীয়ত. জরিপে দেখা গেছে, একজন শ্রমিকের জীবনে তার পরিবার গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। বিবাহিত ও অবিবাহিত উভয়েই পূর্ণ বা আংশিকভাবে পরিবারের দায়িত্বভার নিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে কোনো শ্রমিক অবিবাহিত হলে তাকে পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কহীনভাবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। এছাড়া গ্রেড ৭-এর শ্রমিকদের একটা বড় অংশ বিবাহিত হিসেবে জরিপে পাওয়া গেছে। সুতরাং গ্রেড ৭ পর্যায়ে শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণে তার পরিবার বিবেচনায় নেয়া গুরুত্বপূর্ণ।
মজুরি কাঠামো: দেখা গেছে, শ্রমিকরা সাকূল্যে ওভারটাইম এবং অন্য সুবিধাদি নিয়ে ন্যূনতম মজুরির চেয়ে বেশি পাচ্ছেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তারা আইনগতভাবে তাদের প্রাপ্য অংশটুকু (যেমন ৪০ শতাংশ বাড়িভাড়া) ঠিকমতো পাচ্ছেন না। শ্রমিকরা মাস শেষের বেতন নিয়ে বেশি দুর্ভাবনায় থাকেন বলে আইনগতভাবে প্রাপ্য অংশ সম্পর্কে সচেতন নন। অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিককে নিম্ন গ্রেডে কাজ করানোর প্রবণতা রয়েছে। এক্ষেত্রে আইনগত মজুরি সম্পর্কে তাদের সচেতনতা বৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ।
শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা: ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বিবেচনায় নেয়ার কথা আইনগতভাবে বলা আছে। কিন্তু ন্যূনতম মজুরি আলোচনায় বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত থাকছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, কোটাব্যবস্থা উঠে যাওয়ার পর ২০০৫ সাল থেকে কারখানা পর্যায়ে শ্রমিক-যন্ত্রপাতি অনুপাত যেমন কমে এসেছে, তেমনি শ্রমিকের ঘণ্টাপ্রতি উৎপাদন বেড়েছে। মেশিনপ্রতি উৎপাদনও বেড়েছে। কাঁচামাল ব্যবহারের ক্ষেত্রেও অনেক সাশ্রয় হচ্ছে এখন। সবকিছুই আসলে প্রকারান্তে কারখানাপর্যায়ে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়। এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই মজুরি নির্ধারণের বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন। ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণের ক্ষেত্রে শ্রমিকের উৎপাদনশীলতার বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন।
কারখানার সক্ষমতা: তবে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশের সব কারখানা একই ধরনের সক্ষমতা নিয়ে গড়ে ওঠেনি। উপযুক্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের ভিত্তিতে কারখানার সক্ষমতা বিষয়েও আলোচনা হতে পারে।
আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের করণীয়: ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণের কারণে বাড়তি ব্যয়ের চাপ মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের নিজেদের করণীয় ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই। বিশেষত রানা প্লাজা ও তাজরীনের দুর্ঘটনার পর বৃহৎ ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো যখন বাংলাদেশের পোশাক খাতের সামাজিক ও ভৌত কমপ্লায়েন্স উন্নত করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখন আন্তর্জাতিক ক্রেতারা মালিকদের পর্যাপ্ত সহযোগিতা করবেন এটাই প্রত্যাশা।
আশা করছি, সব পক্ষের সম্মিলিত উদ্যোগে শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম জীবনমানসম্পন্ন ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ সম্ভব হবে।
লেখক: অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক, সিপিডি