Published in Samakal on Thursday, 9 April 2015.
রাজনীতির কারণে ক্ষতি অর্থনীতির
খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম
জানুয়ারি থেকে মার্চ_ এ বছরের প্রথম তিনটি মাস বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল চরমে। একটানা অবরোধ কর্মসূচি ছিল এ সময়ে, যা এখনও চলছে। ফেব্রুয়ারি থেকে অবরোধের পাশাপাশি শুক্র ও শনিবার বাদ দিয়ে ডাকা হয়েছে টানা হরতাল। সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে প্রতিটি কর্মদিবস গেছে ‘কর্মনাশা’। রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে এ ধরনের কর্মসূচি আহ্বান করা হলেও অর্থনীতিতে এর পড়েছে বিরূপ প্রভাব। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের বিভিন্ন চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশন হরতাল-অবরোধের কারণে নিজ নিজ খাতের ক্ষতির বিবরণ প্রকাশ করেছে। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির ক্ষতির চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। কিছু ক্ষতি হয়েছে, যাকে আমরা মৌসুমি বা সাময়িক বলতে পারি। আবার কিছু হয়েছে, যার প্রতিক্রিয়া এখন তেমনভাবে অনুভূত না হলেও দীর্ঘমেয়াদে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে তার বিরূপ প্রভাব পড়বেই। অনেকের শঙ্কা_ রাজনৈতিক শক্তিগুলো যদি সমঝোতায় আসতে না পারে, তাহলে এখন যে আপাত শান্ত অবস্থা দেখছি, সেটা বজায় রাখা কঠিন হবে। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এ দুর্ভাবনার বিষয়টি বিবেচনায় রাখছেন নিশ্চয়ই।
এটা জানা কথা যে, বিপর্যয় প্রাকৃতিক কিংবা মানবসৃষ্ট যে কারণেই ঘটুক না কেন রাষ্ট্রীয় খাতের যেমন ক্ষতি হয়, তেমনি ব্যক্তির ক্ষতি হয়। ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা অবশ্যই থাকে। গত তিন মাসে ব্যবসায়ীদের অন্তত ১৬টি সংগঠন ক্ষয়ক্ষতির চিত্র তুলে ধরেছে। কেউ কেউ বলছেন, দিনে ক্ষতির পরিমাণ গড়ে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি। একটি সংগঠন হিসাব আরও সুনির্দিষ্ট করেছে_ গড়ে দিনে ক্ষতি দুই হাজার ২৭৮ কোটি টাকা। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৫ ফেব্রুয়ারি বলেছেন, হরতাল-অবরোধে ক্ষতির পরিমাণ এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতের ক্ষতি হয়েছে এবং অনেক খাতের ক্ষতি অপরিমেয়। ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য সংশ্লিষ্ট খাতগুলোতে কী ধরনের নীতিগত এবং অন্যান্য সহায়তা প্রদান প্রয়োজন, সেটা নির্ধারণ করতে হলে এটা জানা অপরিহার্য। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনায় কোন খাতের সুরক্ষায় কতটা অগ্রাধিকার দিতে হবে, সেজন্যও এর প্রয়োজন রয়েছে। নিকট অতীতেও রাজনৈতিক কারণে অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি ঘটেছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনের আগের কয়েকটি মাস রাজনৈতিক অঙ্গন ছিল উত্তপ্ত। তখনও নিয়মিত বিরতিতে হরতাল ডাকা হচ্ছিল এবং তার প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতে। বর্তমানে হরতাল-অবরোধের কারণে অর্থনীতির ক্ষতির হিসাব চূড়ান্ত করতে ওই সময়ের ক্ষতির পরিমাণ এবং সেটা কাটিয়ে ওঠার অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো যেতে পারে।
ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠন যে হিসাব দিচ্ছে, সেটা কি অতিরঞ্জিত, এমন প্রশ্ন কেউ কেউ করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ঘটবে সাড়ে ছয় শতাংশ হারে। এটা মেনে নিলে এ বছর জিডিপিতে বাড়তি যুক্ত হবে ৫০ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। ব্যবসায়ীরা ক্ষয়ক্ষতির যে হিসাব দেখাচ্ছেন সেটা সঠিক হলে চলতি বছর প্রবৃদ্ধির হার হবে নেতিবাচক। কিন্তু এমন মন্দ অবস্থায় দেশ পড়ে যাবে, সেটা কেউ বলছেন না। বরং একটি বিষয় সন্তোষের সঙ্গেই উল্লেখ করতে হয় যে, রাজনৈতিক অঙ্গনে চরম অস্থিরতা বিরাজ করলেও সামষ্টিক অর্থনীতির অনেক সূচক যথেষ্ট স্থিতিশীল ছিল বা রয়েছে। যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে বলা হয়েছে, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি উভয় মাসেই মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ শতাংশের নিচে। মার্চে এর হার আরও কম। সরকারের রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি হতাশাব্যঞ্জক, সেটা কেউ বলছেন না। বরং অর্থমন্ত্রী অতিসম্প্রতি বলেছেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটের আকার প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা দাঁড়াবে। দেশের বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজও থেমে নেই। বলা যায়, আমরা মানিয়ে চলতে শিখছি। এ থেকে ভবিষ্যতের জন্যও শিক্ষা নিতে হবে।
হরতাল-অবরোধে কৃষি খাতের ক্ষতি হয়েছে। কৃষকের ক্ষতি হয়েছে আরও বেশি। যেসব কৃষক শীতকালের সবজি সময়মতো বাজারে পাঠাতে পারেননি, তাদের ক্ষতির মাত্রা বেশি। যিনি ধান বিক্রি করতে চেয়েছেন, কিন্তু হরতালের কারণে হাট-বাজারে সেটা নিয়ে যেতে পারেননি, তার সামনে বিকল্প ছিল। যেমন, কিছুদিন অপেক্ষা করা। এতে ধান মজুদে ধান নষ্ট হবে না। কিন্তু সবজি ঘরে মজুদ করে রাখা যায় না। এ ক্ষেত্রে করণীয় হচ্ছে দুটি_ মজুদ ক্ষমতা সৃষ্টির জন্য পর্যাপ্ত হিমাগার বা এ ধরনের সুবিধা সৃষ্টি। দুই. সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখায় সর্বাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ। এ চেইন কেবল কৃষিপণ্যের জন্য নয়, অর্থনীতির অন্যান্য শাখার জন্যও প্রযোজ্য। গ্রাম থেকে শহর এবং শহর থেকে গ্রাম_ দুইভাবেই এটা সচল রাখা চাই। কৃষকের পণ্য যেমন শহরে পেঁৗছাতে হয়, তেমনি শিল্প এলাকায় উৎপাদিত পণ্যও পাঠাতে হয় গ্রামে। আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যের জন্যও এ চেইন গুরুত্বপূর্ণ। এবারের আন্দোলনে ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামের সড়কপথ মোটামুটি সচল রাখা সম্ভব হয়েছে। সম্ভবত ২০১৩ সালের বিভিন্ন সময়ে এ পথে যেসব বিঘ্ন ঘটেছে তার শিক্ষা এবার কাজে লেগেছে।
এবারের আন্দোলনের সময়টি ছিল শীতকাল এবং এ কারণে পর্যটন খাতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এ খাতের জন্য সড়ক, রেল ও নৌপথ নির্বিঘ্ন রাখার পাশাপাশি সার্বিক পরিবেশ নিরাপদ রাখা গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রেও সম্ভবত ২০১৩ সালের অভিজ্ঞতা কাজে লেগেছে। সে সময়ে কক্সবাজার ও রাঙামাটিতে দিনের পর দিন শত শত পর্যটক আটকা পড়েছিল। এবারে তেমনটি শোনা যায়নি। পরিবহন খাতেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাস ও ট্রাক পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে কিংবা ভাংচুর হয়েছে। মালিকদের ক্ষতি হয়েছে দুই ধরনের_ স্বল্প ও দূরপাল্লার যাত্রী ও পণ্য ভাড়ার আয় থেকে অনেকে বঞ্চিত হয়েছেন। অনেক যানবাহনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকার থেকে যানবাহন মালিকদের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, এটা ভালো দিক। এ সময় ট্রেন ও লঞ্চ চলাচল মোটামুটি স্বাভাবিক ছিল। বলা যায়, অর্থনীতির চাকা সচল রাখায় নৌ ও রেলপথ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ভবিষ্যতে যে কোনো বিপর্যয়ে এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে। আন্দোলনের প্রথম দিকে রেলগাড়ির সময়সূচি রক্ষা দুরূহ হয়ে পড়ে। কিন্তু ক্রমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের যোগাযোগ রক্ষায় পানগাঁওয়ের টার্মিনাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু গত তিন মাসে সেটা তেমনভাবে দেখা যায়নি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ওই টার্মিনালে ঢাকা শহর এবং শিল্প-বাণিজ্যের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ এলাকা থেকে যাতায়াতের পথ মোটেও সহজ নয়। এ পথ প্রশস্ত করার পাশাপাশি যানজট নিরসনে অনেক কিছু করার রয়েছে।
সরকার ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দিতে চেয়েছে এবং ইতিমধ্যেই কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এজন্য প্রথমেই গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে পরিমাণ নির্ধারণ। প্রাথমিক হিসাবে দেখা যায়, কৃষি, পোলট্রি, চিংড়ি ও হিমায়িত খাদ্য, তৈরি পোশাকশিল্প, প্লাস্টিক, পরিবহন, পর্যটন, ব্যাংক ও বীমা, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, রিয়েল এস্টেট, শ্রম প্রভৃতি খাতের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে এ সময়। এসব খাত থেকেই জিডিপির প্রায় ৬০ শতাংশ আসে। এ পর্যন্ত যে হিসাব পাওয়া যায় তা থেকে বলতে পারি যে, জানুয়ারি থেকে পরবর্তী আড়াই মাসে (মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত) রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এসব খাতে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় চার হাজার ৯০০ কোটি টাকা, যা জিডিপির ০.৫৫ শতাংশ। আমরা বলতে পারি যে, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কৃষি, তৈরি পোশাক, ব্যাংক ও বীমা প্রভৃতি খাতে ক্ষতির মাত্রা ছিল মধ্যম মাত্রার বা মডারেট। কিন্তু পোলট্রি, চিংড়ি, পরিবহন, পর্যটন, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা প্রভৃতি খাতে ক্ষতির মাত্রা উল্লেখযোগ্য। রিয়েল এস্টেট খাতে ক্ষতি তুলনামূলক কম। তবে এ ব্যবসায় সাম্প্রতিক সময়ে মন্দা চলছে। ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে গিয়ে বাস্তবতা বিবেচনায় রাখা হবে, সেটাই প্রত্যাশিত। আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত বিভিন্ন খাতের সবার কথা সঠিকভাবে তুলে ধরার মতো উপযুক্ত কাঠামো বর্তমানে অনুপস্থিত। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের রয়েছে বিভিন্ন চেম্বার। কোনো কোনো খাতের কণ্ঠস্বর আমরা সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের সূত্রে নিয়মিত জানতে পারি। আবার কৃষকের কথা বলার মতো সংগঠন তেমন নেই। এবারে কৃষি খাতের ক্ষতি তুলনামূলক কম। কিন্তু অনেক কৃষক বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। তারা উৎপাদিত ফসল আদৌ বিক্রি করতে পারেননি কিংবা আংশিক বিক্রি করেছেন এবং ন্যায্য মূল্য পাননি। এ কারণে অনেক কৃষক তাদের ব্যাংক ঋণের কিস্তি সময়মতো পরিশোধ করতে পারেননি। বাংলাদেশ ব্যাংক এ সমস্যা বিশেষভাবে বিবেচনা করতে পারে। পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্তরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পেরও ক্ষতি হয়েছে। নতুন বছরের বাজেটে তাদের জন্য নীতিগত ও আর্থিক প্রণোদনা রাখা উচিত।
রাজনীতির কারণে অর্থনীতির প্রভূত ক্ষতি হয়েছে, এতে সন্দেহ নেই। এখন পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করায় সরকার প্রশাসনিক ও আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত পদক্ষেপ নিয়েছে। এজন্য কেউ কেউ কৃতিত্বও দাবি করতে পারেন। কিন্তু এটাও মনে রাখা চাই যে, অর্থনীতিতে স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনার জন্য রাজনৈতিক পদক্ষেপেরও প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের অর্থনীতিতে বেসরকারি খাত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে এবং উদ্যোক্তারা এমন রাজনৈতিক পরিবেশ প্রত্যাশা করে, যেখানে সবার অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। এর সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগও সরাসরি সম্পর্কিত।
অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)