অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য আসবে আকাঙ্ক্ষা, বাস্তবতা ও নেতৃত্বের সক্ষমতার সমন্বয়ে – ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

Originally posted in প্রথম আলো on 13 August 2024

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যছবি: প্রথম আলো

অর্থনীতির খারাপ সময় যাচ্ছে। গণরোষে বিদায় নিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে ৮ আগস্ট। অর্থনীতির নানা দিক, চ্যালেঞ্জ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে প্রত্যাশা ইত্যাদি নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তাঁর সঙ্গে গতকাল রোববার সিপিডি কার্যালয়ে কথা বলেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি ফখরুল ইসলাম।

প্রথম আলো: দেশের অর্থনীতির অবস্থা কী, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এখন প্রধান করণীয় কী?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: দেশের অবস্থা ভালো বলার সুযোগ নেই। অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর একটা শ্বেতপত্র তৈরি করতে পারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ সরকার কতটা, কী করতে পারবে, তা নির্ভর করবে অবশ্য সরকারের মেয়াদের ওপর। দেশে যে জটিল পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে, শ্বেতপত্র তৈরি হলে উত্তরণের জন্য একটি পথনির্দেশিকা পাওয়া যাবে। একদিকে পরিস্থিতির ভিত্তি, অন্যদিকে ইতিহাস—দুই দিক থেকেই কাজ করবে এ শ্বেতপত্র। শ্বেতপত্র তৈরির ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করার পাশাপাশি মূল অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে। আলোচনার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় নীতি পর্যালোচনা ও দিকনির্দেশনার ক্ষেত্রে একটি গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হবে। আর নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে তা দেবে একধরনের গণতান্ত্রিক ভিত্তি। কোনো কারণে সরকার যদি তা না করে, তাহলে পেশাজীবী নাগরিক সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসতে হবে। আমি মনে করি, এ ধরনের শ্বেতপত্র পরামর্শমূলক দলিল হিসেবে কাজে দেয়। অর্থাৎ, সরকারকে বেঁধে ফেলে না। সরকারের কৃতিত্ব বা দায় নেওয়ার জন্যই এটি হওয়া দরকার। সরকার যদি এটি না করে, তাহলে আর্থিক, বাণিজ্যিক ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করে সিপিডিরই তা করা উচিত। তবে কাজটি করতে এক মাসের বেশি সময় নেওয়া যাবে না। বড়জোর দেড় মাস সময় নেওয়া যেতে পারে। সরকার যদি অন্য কিছু না-ও করে, এ শ্বেতপত্রই একটা অবদান হিসেবে থেকে যাবে।

প্রথম আলো: আপনি যে শ্বেতপত্রের কথা বলছেন, সেটির কাঠামো বা কীভাবে সেটি তৈরি হবে?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: এই কাঠামোর সঙ্গে সরকারের আর্থিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোও যুক্ত হতে পারে। এসব প্রতিষ্ঠান তখন একটি অবস্থানপত্র তৈরি করবে। যেমন দায়দেনা পরিস্থিতি নিয়ে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অবস্থানপত্র রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের অবস্থানপত্রও লাগবে। নিতে হবে অংশীজনদের মতামত। আর যুক্ত করতে হবে বেসরকারি খাত, বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং উন্নয়ন সহযোগীদের। ব্যক্তি খাতের বড়, মাঝারি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মতামতও নিতে হবে।

প্রথম আলো: এর বাইরে নতুন সরকারকে আর কী কী করতে হবে বলে মনে করেন?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: অন্তর্বর্তী সরকারের আরেকটা কাজ করা দরকার। সেটা হচ্ছে ডেটা বা তথ্য-উপাত্ত কমিশন। তথ্য-উপাত্ত হচ্ছে রাষ্ট্রের পঞ্চম স্তম্ভ। তথ্যের যেসব ব্যত্যয় হয়েছে, যেসব ঘাটতি আছে, সেসব পরিষ্কার করতে হবে। যুক্ত করতে হবে তথ্যের উৎপাদক, ব্যবহারকারী এবং মূল্যায়নকারী—এই তিন পক্ষকে। সরকারি তথ্য-উপাত্ত সুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থাও করতে হবে। তথ্য-উপাত্ত প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনভাবে পেশাদারির সঙ্গে কাজ করার সুযোগ করে দিতে হবে।

প্রথম আলো: বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের পরিস্থিতি নিয়ে কিছু বলবেন কি?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: ব্যাংক খাতের পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতির ফুসফুসের মতো কাজ করে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য অন্তত একটা টাস্কফোর্স গঠন করা চাই। আর ব্যাংক খাতের জন্য চাই ব্যাংক কমিশন। ২৩ থেকে ২৪ হাজার মেগাওয়াটের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কেন ১২ থেকে ১৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হচ্ছে এবং একই সঙ্গে আমদানি করতে হচ্ছে, টাস্কফোর্স তার ওপর প্রাথমিক একটা প্রতিবেদন দেবে। রেন্টাল, কুইক রেন্টাল ও দায়মুক্তির বিষয়গুলোও উঠে আসবে টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে।

প্রথম আলো: আপনারা অনেক দিন ধরেই ব্যাংক কমিশনের কথা বলছেন। এ কমিশন গঠন করলে কী সুবিধা হবে বলে মনে করছেন?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: আগে ব্যাংক কমিশন একটা হওয়া উচিত। সরকার ব্যাংক খাতের রোগনির্ণয় করার সময় পাবে, নাকি পথ্য দেওয়া ও চিকিৎসা করার সময় পাবে, জানি না। ফলাফল পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে পারবে কি না, তা–ও জানি না। তবে ব্যাংক খাতে তথ্য-উপাত্তের সঠিকতা যাচাই করা হবে কমিশনের প্রথম কাজ। বড় কাজ হবে খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ নির্ধারণ করা। প্রভিশন ঘাটতি ও মূলধন পর্যাপ্ততার মতো বিষয়গুলোও স্বচ্ছতার সঙ্গে যাচাই করা দরকার। ব্যাংক কোম্পানি আইনে এক ব্যাংকে এক পরিবার থেকে তিনজনকে টানা ৯ বছর থাকার সুযোগ দেওয়া আছে। এগুলো শিথিল করতে হবে। খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য আমানতকারীদের স্বার্থ বিঘ্নিত করা যাবে না। বরং একটি বাস্তবসম্মত ‘এক্সিট পলিসি’ প্রণয়ন করতে হবে। পর্যালোচনা করতে হবে ঋণ অবলোপনের নিয়ম। ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগপ্রক্রিয়া এখন ঠিক নেই। এখানে আরও স্বচ্ছতা ও পেশাদারি আনা দরকার।

প্রথম আলো: রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে সুবিধাপ্রাপ্ত গোষ্ঠীর অনেকে ব্যাংকের মালিকানায় রয়েছেন। তাঁদের ক্ষেত্রে করণীয় কী?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: এটি খুবই জটিল রাজনৈতিক অর্থনীতির বিষয়। তাঁদের মালিকানার প্রশ্নটি স্বচ্ছতার সঙ্গে সুরাহা করতে হবে। ব্যাংক খাতে করপোরেট সুশাসনে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে, যার সঙ্গে মালিকানা ও ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপনা জড়িত। ব্যাংক থেকে একক ব্যবসায়ী কত ঋণ পাবেন, পরিচালনা পর্ষদে এক পরিবার থেকে কতজন থাকবেন, এগুলোর মূল্যায়নও দরকার। আরও দরকার খেলাপি গ্রাহকদের খেলাপি তালিকা থেকে বের হওয়ার নীতি এবং অবলোপন নীতি প্রণয়ন করা। অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ভালো কাজ করে না।

প্রথম আলো: রাষ্ট্রমালিকানাধীন ও সরকারি ব্যাংকগুলোর বিষয়ে সরকারের কী করা উচিত বলে মনে করেন।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: সরকারি ব্যাংক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে যাওয়া ভালো হবে। আরেকটা পরামর্শ দিতে চাই। সেটা হচ্ছে ব্লু রিবন কমিটি করা। অভিজ্ঞ, বিজ্ঞ ও পেশাদারদের সমন্বয়ে তা গঠিত হবে। যারা ব্যাংকে পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী নিয়োগের সুপারিশ অনুমোদন দেবে। ব্যাংকের পাশাপাশি এ ধরনের কমিটি দুদক, নির্বাচন কমিশন ও মানবাধিকার কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও হতে পারে। এতে করে রাজনৈতিক অনুগ্রহে নিয়োগ দেওয়ার চর্চা বন্ধ হতে পারে।

প্রথম আলো: প্রায় দেড় বছর ধরেই দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে নতুন সরকারের করণীয় কী?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও খাদ্যনিরাপত্তা হতে হবে সরকারের এক নম্বর অগ্রাধিকার বিষয়। খোলাবাজারে সাশ্রয়ী দামে যে নিত্যপণ্য বিক্রি করা হচ্ছিল, তা বজায় রাখতে হবে। আর নিশ্চিত করতে হবে মাথাপিছু খাদ্যনিরাপত্তা। খাদ্য উৎপাদনের তথ্য এত দিন বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলা হয়েছে। এগুলো ঠিক করতে হবে। আর ঠিক রাখতে হবে পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা। প্রথমে দরকার বর্তমানের খাদ্য মজুত পরিস্থিতি মূল্যায়ন এবং আমন সংগ্রহ অভিযান কার্যকরের পরিকল্পনা গ্রহণ। কৃষকদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে হবে। খাদ্য উৎপাদনের সঠিক তথ্য প্রকাশ করতে হবে এবং ঘাটতি থাকলে আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে। সরবরাহ ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বন্দরগুলোকে নিরবচ্ছিন্নভাবে চালু রাখা।

প্রথম আলো: সরকারের দায়দেনা পরিস্থিতি নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে আলোচনা হচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: এটির মূল্যায়ন হওয়া জরুরি। বৈদেশিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি যেন উন্নয়ন সহযোগীরা পূরণ করে, সেই চেষ্টা অবশ্যই থাকতে হবে সরকারের। কারণ, সাহায্যের ভালো একটা অংশ সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় হয়। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকসহ অন্যদের ঋণের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয়ে মনোযোগ থাকতে হবে। আগের সরকার যেসব চুক্তি করেছে, কোনো অবস্থাতেই এসব অর্থায়ন আসার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি যাতে না হয়, তা খেয়াল রাখতে হবে। কোনো অবস্থাতেই যাতে ভাতা বন্ধ না হয় বা পরিধি যাতে সংকুচিত না হয়।

প্রথম আলো: বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আপনার শেষ কথা কী?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: আমি মনে করি, তিনটা বিষয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো হচ্ছে আকাঙ্ক্ষা, মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা এবং নেতৃত্বের সক্ষমতা। এ তিনের ভালো সমন্বয়েই সাফল্য আসবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের। আর এ ধরনের সরকার আগেও ছিল। আগের সরকারগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার দরকারও আছে নতুন সরকারের। আশা করছি, নতুন সরকার একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি আমার আরেকটি প্রবল আশা আছে। সেটি হচ্ছে, নতুন সরকার যেন নতুন একটি সংবিধান রচনা করে।