অযৌক্তিক প্রকল্প বাদ দিয়ে রাজস্ব বাড়াতে হবে—ড. ফাহমিদা খাতুন

Originally posted in DW বাংলা on 4 May 2025

বাজেট ২০২৫-২৬: আকার কমিয়ে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানার চেষ্টা

আকার কমিয়ে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার চেষ্টা থাকবে বাংলাদেশের আসছে অর্থবছরের বাজেটে৷ ব্যয় কমাতে থাকছে না বড় আকারের প্রকল্প৷ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে অটোমেশন নিশ্চিত করার জন্য তথ্য প্রযুক্তির ওপরে গুরুত্ব দেওয়া হবে।

বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার কথা বলছেন সরকার সংশ্লিষ্টরা | ছবি: MD Mehedi Hasan/ZUMA Press/picture alliance

অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ আগামী ২ জুন টেলিভিশনে নতুন অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করবেন৷ পরে তা উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে পাশ হবে৷ ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সরকারের আয়-ব্যয়ের পরিকল্পনা কেমন হবে সম্প্রতি এক আলোচনায় তার পূর্বাভাস দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা৷

লক্ষ্য বাণিজ্যের প্রসার, মূল্যস্ফীতিতে লাগাম

বাজেট এবার ‘খুবই বাস্তবমুখী’ হবে দাবি করে ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, তার লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি কমানো, ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটানো৷

বাজেট নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘‘বাজেটে আমাদের উদ্দেশ্য থাকবে একটি সমতাভিত্তিক এবং কল্যাণমুখী বাজেট যেন আমরা দিতে পারি৷ বাজেট হবে মধ্যমেয়াদি, কারণ দীর্ঘমেয়াদি বাজেট আমাদের ম্যান্ডেট না৷ আমি কথাবার্তা কমই বলি, লম্বা বক্তৃতা আমি পছন্দ করি না৷ এবার বাজেট স্পিচ ৫০ থেকে ৬০ পাতার মধ্যেই হবে৷ এবারের বাজেটটা একটু বাস্তবমুখী করবো৷”

করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো, সারা দেশে করজালের বিস্তৃতির ব্যাপারে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘‘ক্যাশলেস সোসাইটি (কাগুজে নোটবিহীন লেনদেন) এবং ফেসলেস ট্যাক্স সিস্টেম প্রয়োজন৷ আমি মনে করি ট্যাক্স অফিসারদের মুখোমুখি হওয়া কারও জন্য মোটেও বাঞ্ছনীয় নয়৷ সামনাসামনি হলে টেবিলের নিচ দিয়ে লেনদেন হয়৷ অটোমেশন নিশ্চিত করার জন্য তথ্য প্রযুক্তির ওপরে আরও গুরুত্ব দিতে হবে৷”

যেভাবে বাজেট ঘোষণা হবে?

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের এটি হবে প্রথম বাজেট৷ আকার হতে পারে সাত লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা৷ টেলিভিশনের পর্দায় অর্থ উপদেষ্টা বাজেট ঘোষণা করবেন ২ জুন সোমবার৷ প্রতি অর্থবছরে জুন মাসের কোনো বৃহস্পতিবারকে বাজেট ঘোষণার জন্য বেছে নেওয়া হয়৷ এবারই তার ব্যতিক্রম হচ্ছে৷ তবে বাজেট ঘোষণার পরদিন রেওয়াজ অনুযায়ী অন্য উপদেষ্টাদের সঙ্গে নিয়ে বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলন ঠিকই করবেন অর্থ উপদেষ্টা৷ পরে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে বাজেট পাশ হবে৷

নির্বাচিত সরকারের ক্ষেত্রে জাতীয় সংসদে বাজেট প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী৷ এক্ষেত্রে সংসদ না থাকায় অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বাজেট উপস্থাপন করবেন টেলিভিশনের পর্দায়৷ রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে এ বাজেট ঘোষণা করা হবে৷ সর্বশেষ ২০০৭-০৮ সালে টেলিভিশনে ভাষণের মাধ্যমে দুইটি বাজেট ঘোষণা করেছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম৷

কী থাকছে বাজেটে?

বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজস্ব সংগ্রহের বড় কোনো উৎসের সন্ধান না পাওয়ায় আগামী বাজেট বড় করা হচ্ছে না৷ এ কারণেই চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় আগামী অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার অন্তত সাত হাজার কোটি টাকা কমানো হচ্ছে৷ উচ্চাভিলাষী না হয়ে বাস্তবভিত্তিক বাজেটের দিকেই এগোতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার৷ অন্যতম লক্ষ্য হবে মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা৷

বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে, গত মার্চে যার হার ছিল ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ৷ সূত্রে অনুযায়ী, নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ছয় শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা থাকতে পারে৷ সরকার প্রথমে আগামী অর্থবছর শেষে এ হার সাত শতাংশে নামিয়ে আনবে বলে ঠিক করেছিল৷ বাংলাদেশ ব্যাংক নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়ায় এ হার আরও কমবে বলে সরকার আত্মবিশ্বাসী৷

অর্থসচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদার সম্প্রতি এক আলোচনায় বলেছেন, ‘‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হবে৷ কর্মসংস্থান সৃষ্টি আমাদের অন্যতম অগ্রাধিকারের একটি পদক্ষেপ৷ সবার পক্ষ থেকে কর্মসংস্থানের বিষয়েও পরামর্শ এসেছে৷ শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ ক্রমান্বয়ে কমছে, এটা বাড়ানোর বিষয়ে পরামর্শ এসেছে৷ অটোমেশন ও ক্যাশলেস সোসাইটির পরামর্শ এসেছে৷ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে যে পরামর্শটা এসেছে, সেটা হচ্ছে বাজেটের আকার ছোট হতে হবে, বাজেট হতে হবে বাস্তবধর্মী৷ এগুলো সরকার গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে৷”

জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের মতো আগামী অর্থবছরেও বাজেট ঘাটতি মোট দেশজ উৎপাদনের পাঁচ শতাংশের নিচে রাখা হবে৷ আগামী অর্থবছরের জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হচ্ছে পাঁচ দশমিক পাঁচ শতাংশ৷ চলতি অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য কিছুটা কমিয়ে এরইমধ্যে পাঁচ দশমিক ২৫ শতাংশ করা হয়েছে৷ যদিও বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলছে, চলতি অর্থবছরের জিডিপির প্রবৃদ্ধি পাঁচ শতাংশের নিচে থাকবে৷

রাজস্ব বাড়ানো ও ব্যয় কমানোর চ্যালেঞ্জ

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) আগামী অর্থবছরে পাঁচ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হতে পারে, যা চলতি বাজেটে ছিল চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা৷ তবে প্রত্যাশা অনুযায়ী কর আদায় না হওয়ায় চলতি অর্থবছরে রাজস্বের লক্ষ্য কমিয়ে চার লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়েছে৷ এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) রাজস্ব আদায় হয়েছে দুই লাখ ২১ হাজার ৮১৭ টাকা, কিন্তু আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা৷ রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫৮ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ ২১ শতাংশ৷

বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এবার বাজেটের আকার ছোট হোক সেটা আমরা বলেছি৷ কারণ অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নিয়ে বাজেট বড় করা রাজনৈতিক সরকারের কাজ৷ এই সরকারের তো সেই ধরনের কোন বাধ্যবাধতা নেই৷ ফলে সরকার চাইলেই ঘাটতি কমিয়ে মূল্যস্ফীতির দিকে নজর দিতে পারে৷ পাশাপাশি যেদিকে সবচেয়ে বেশি নজর দেওয়া প্রয়োজন সেটা হলো, সম্প্রতি সিপিডি তাদের গবেষণায় দেখিয়েছে, ২০২৩ সালে দুই লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা সরকার রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে৷ অর্থাৎ এই রাজস্ব সরকারের পাওয়ার কথা ছিল৷ সেটা কীভাবে পাওয়া যাবে সেই পথ দেখতে হবে৷ সব পাওয়া না গেলেও যদি অর্ধেকও পাওয়া যায় অর্থাৎ এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা সেটাও তো বাজেটের বড় একটা অংশ৷ এই দিকে অবশ্যই অর্থ উপদেষ্টাকে নজর দিতে হবে৷’’

বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রথমত আমরা সরকারকে বাজেটের আকার কমাতে বলেছিলাম৷ আমরা দেখছি, সরকার ইতিমধ্যে বলেছে তারা বাজেটের আকার ছোট করছে৷ পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি তো বড় চ্যালেঞ্জ৷ অর্থ উপদেষ্টাও এ বিষয়ে দৃষ্টি দিয়েছেন৷ কারণ আমাদের বুঝতে হবে, দুর্বল ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের অর্থনীতি৷ বর্তমান সরকার সেখান থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে৷ কিন্তু এখনও তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি৷ বাজেটে রাজস্ব বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে৷ যদিও সেটা বড় চ্যালেঞ্জ৷ তবুও অযৌক্তিক প্রকল্পগুলো বাদ দিতে হবে৷ যেমন ধরেন, রূপপুরে রেলস্টেশনের পাশে সাতটি বিলাশবহুল রুমের আবাসিক ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ অথচ সেখানে এখনও ট্রেনই যায় না৷ তাহলে এই প্রকল্পগুলোর তো কোন প্রয়োজন নেই৷ এগুলো সরকারকে বাদ দিতে হবে৷ যদিও এই সরকার এমন অনেক প্রকল্প বাদ দিয়েছে৷’’

চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২০২৫) মূল বাজেট বরাদ্দ ছিল সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা, যা সংশোধন করে সাড়ে সাত লাখ কোটি টাকায় সীমিত রাখা হচ্ছে৷ ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের মূল বাজেট বরাদ্দ ছিল সাত লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা পরবর্তীকালে সাত লাখ ১৪ হাজার ৪১৮ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছিল৷