Published in বাংলাদেশের খবর on Saturday, 5 May 2018
ভারসাম্যহীন শ্রমবাজার-শেষ পর্ব
শ্রমবাজারের বাইরে সাড়ে ৩ কোটি নারী
জাহিদুল ইসলাম
বাংলাদেশে ১৫ বছরের বেশি বয়সী ১০ কোটি ৯১ লাখ মানুষের মধ্যে নারীর সংখ্যা সাড়ে ৫ কোটি। মোট কর্মক্ষম জনশক্তির অর্ধেকের বেশি নারী হলেও কর্মবাজারে আছেন মাত্র ২ কোটি। এ হিসাবে নারী জনগোষ্ঠীর মাত্র ৩৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ সরাসরি কর্মবাজারে আছেন। বাইরে থাকা সাড়ে ৩ কোটি নারী কাজে যোগ দিলে দেশের মোট দেশজ আয়ে (জিডিপি) বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি ঘটবে- এ কথা বরাবর বলে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে উপযুক্ত পরিবেশের অভাব ও পারিবারিক কাজের চাপে তাদের বড় অংশ শ্রমবাজারের বাইরেই থেকে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গৃহস্থালির কাজ নারীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যোগ দেওয়ার পথে বড় বাধা। কর্মবাজারে যোগ না দেওয়া নারীর ৮১ দশমিক ১০ শতাংশই এর জন্য ঘরের কাজের চাপকে দায়ী করেছেন। অন্যদিকে একই কারণে কর্মবাজারে প্রবেশে বাধা পাচ্ছেন ৮ দশমিক ১০ শতাংশ পুরুষ। উপযুক্ত কাজ পেলে শ্রমবাজারে যোগ দিতে ইচ্ছুক এমন নারীর সংখ্যাও পুরুষের প্রায় দ্বিগুণ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে শ্রমবাজারে যোগ দেবেন আরো ১৫ লাখ ৮৭ হাজার নারী। আর কাজ পেলে যোগ দেবেন এমন পুরুষের সংখ্যা ৮ লাখ ৪৬ হাজার।
প্রতিবেদনটির তথ্য অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন খাতে নিয়োজিত ১ কোটি ৮৬ লাখ ৪৬ হাজার নারীর মধ্যে টাকার বিনিময়ে কাজ করছেন মাত্র ৫৯ লাখ ৩ হাজার। তাদের মাসিক আয় গড়ে ১২ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। এ হিসাবে তারা বছরে বেতন ও মজুরি বাবদ আয় করেন ৮৬ হাজার ৮০২ কোটি টাকা। তবে বেতন ছাড়াও ঘরে-বাইরে কাজ করেন অনেক নারী। এই হোম মেকারদের কাজের স্বীকৃতি নেই। হিসাব করা হয় না এর আর্থিক মূল্য। ফলে জিডিপিতে নারীদের প্রকৃত অবদান অনেকটাই আড়ালে থেকে যাচ্ছে।
কয়েক বছর আগে মজুরিবিহীন গৃহকাজের অর্থনৈতিক মূল্য নির্ধারণে একটি জরিপ চালিয়েছিল বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন অন্বেষণ। এর ফলাফলে বলা হয়েছিল, এক বছরে পরিবারে নারীদের কাজের আর্থিক মূল্য ১ লাখ ১১ হাজার ৫৯১ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরের তথ্য পর্যালোচনা করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছিল। ওই বছর দেশের জিডিপির আকার ছিল ১০ লাখ ৩৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। এ হিসাবে পরিবারে নারীদের কাজের আর্থিক মূল্য জিডিপির ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছর দেশের জিডিপির আকার দাঁড়িয়েছে ২২ লাখ ৩৮ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকায়। এর ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে চলতি জিডিপিতে নারীর গৃহস্থালি কাজের আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় ২ লাখ ৪০ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা। এর সঙ্গে কর্মবাজারের বেতনের আয় যোগ করলে অর্থনীতিতে নারীর অবদান ৩ লাখ ২৭ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা।
প্রচলিত সামাজিক নিয়ম-কানুন ও পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবে নারী কর্মবাজারে পিছিয়ে আছেন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। নারীর পারিবারিক কাজের অর্থনৈতিক স্বীকৃতিও চেয়েছেন তারা।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বাংলাদেশের খবরকে বলেন, আমরা সবাই চাই অর্থনীতিতে নারীর অবদান বাড়ুক। তবে এক্ষেত্রে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে নারীরা পিছিয়ে। আবার পর্যাপ্ত শিক্ষা নিলেও অনেক সময় তারা সঙ্গতিপূর্ণ কাজ পাচ্ছেন না। এক্ষেত্রে পরিবারের পুরুষদের এগিয়ে আসতে হবে। আবার কর্মক্ষেত্রে নারীবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে নিয়োগকর্তা প্রতিষ্ঠান ও সরকারের দায়িত্ব রয়েছে। মানসম্মত আবাসন, সন্তানের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টারের ব্যবস্থা নিশ্চিত হলে শ্রমবাজারে নারীর অন্তর্ভুক্তি বাড়বে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
বাংলাদেশের বাইরে গোটা এশিয়ার শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম বলে মনে করে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। সংস্থার প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ১৫ বছরের বেশি বয়সী নারীর শ্রমবাজারে যুক্ত হওয়ার প্রবণতা এশিয়ায় পুরুষের চেয়ে ৭০ শতাংশ কম। শিক্ষার সুযোগ, শ্রমবাজার আর পরিবার থেকে আরোপিত বাধা দূর করা গেলে এশিয়ার দেশগুলোতে মাথাপিছু আয় আরো ৩০ দশমিক ৬ শতাংশ বাড়বে। এর মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনীতির আয় ৬ দশমিক ৬ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে মনে করে সংস্থাটি।
প্রচলিত বেশ কয়েকটি বাধা নারীকে শ্রমবাজারে যোগ দিতে নিরুৎসাহিত করছে বলে দাবি করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, সামাজিক রীতি নারীদের পারিবারিক কাজে যোগ দিতে উৎসাহী করে। নারীর চলাফেরায়ও সমাজ বাধা সৃষ্টি করছে। চাকরিতে কোটা পদ্ধতি চালু, তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করার মাধ্যমে কর্মবাজারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো সম্ভব বলে দাবি করা হয়েছে প্রতিবেদনে। নারীকে কর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে পর্যাপ্ত গবেষণা, কারিগরি শিক্ষার প্রসার, দক্ষতার সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজের নিশ্চয়তা, নমনীয় কর্মঘণ্টা নির্ধারণ ও চলাফেরায় স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করার পরামর্শ দেওয়া হয় প্রতিবেদনটিতে।
দক্ষতার অভাব, পারিবারিক কাজের চাপ ও নিয়োগকর্তাদের মানসিকতার কারণে নারীরা প্রাতিষ্ঠানিক খাতের বড় পদে আসতে পারছেন না বলে দাবি করেছে বিবিএস। সংস্থাটি বলেছে, কৃষি খাতের ১ কোটি ৯৬ লাখ ৮৩ হাজার শ্রমিকের মধ্যে নারী ৯৬ লাখ ৪৪ হাজার, যা মোট কৃষিশ্রমিকের ৪৯ শতাংশ।
ব্যবস্থাপক পর্যায়ে শ্রমজীবীদের মাত্র ১০ দশমিক ৭০ শতাংশ নারী। এ ছাড়া পেশাজীবীদের ৩২ দশমিক ৫০ শতাংশ, কারিগরি সহযোগীদের ১৫ দশমিক ১০ শতাংশ, পাইকারি বাণিজ্যে ৯ দশমিক ২০ শতাংশ নারী। শীর্ষ ব্যবস্থাপক পর্যায়ে নিয়োজিতদের মাত্র ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ নারী।
দায়িত্বের পাশাপাশি বেতনের ক্ষেত্রেও নারীরা বৈষম্যের শিকার। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একজন পুরুষ প্রতি মাসে গড়ে ১৩ হাজার ৫৮৩ টাকা বেতন পেলেও নারীরা পান ১২ হাজার ২৫৪ টাকা। ব্যবস্থাপক পর্যায়ে পুরুষরা গড়ে ৩৬ হাজার ১৩৩ টাকা বেতন পেলেও নারীরা পান ৩২ হাজার ৫৮৮ টাকা। এ ছাড়া পেশাজীবীদের মধ্যে মাসিক আয়ে ২ হাজার ২৮ টাকা, টেকনিশিয়ানদের ৮৭২ টাকা, করণিক পর্যায়ের সহযোগীদের ১ হাজার ৪৭৯ টাকা, পাইকারি সেবায় ৭৯৪ টাকা, কৃষি ও বনায়নে ১ হাজার ৭০৬ টাকা, খুচরা ব্যবসায় ৮৫৩ টাকা, যন্ত্রপাতি পরিচালনায় ৯০৯ টাকা ও অন্যান্য কাজে ৩ হাজার ৭৫৪ টাকা কম পাচ্ছেন নারীরা।
গৃহস্থালি কাজেও নারীরা তুলনামূলক কম বেতন পাচ্ছেন। এ খাতে পুরুষের গড় বেতন ৯ হাজার ৪৪১ টাকা। আর নারীর ৭ হাজার ৬৪৪ টাকা।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. আবু আহমেদ বলেন, বাজারমূল্যে জাতীয় আয়ে পুরুষের অবদান ৬০ শতাংশ হলে নারীর হবে ৪০ শতাংশ। কিন্তু বর্তমানে নারীর অবদান ধরা হয় ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। আগামী অর্থনৈতিক শুমারিতে পরিবারে নারীর কাজের ছায়ামূল্য নির্ধারণ করলে এই আয় অনেক বেড়ে যাবে বলে তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, বর্তমানে শ্রম খাতে ৩৩ শতাংশ নারী, যাদের সিংহভাগই কৃষিতে। আর ৬৭ শতাংশ রয়েছেন কর্মপরিধির বাইরে। কিন্তু নারীদের সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজে লাগালে এই হার ৪০ থেকে ৫০ শতাংশে উন্নীত করা যাবে। তিনি আরো বলেন, সিংহভাগ নারী সাংসারিক কাজে সারা জীবনই যুক্ত থাকেন। কিন্তু তাদের এ কাজের মূল্যায়ন জাতীয়ভাবে এখনো নির্ধারণ করা হয়নি।