আমাদের অর্থনীতি দুষ্টচক্রের ফাঁদে আটকে গেছে – মোস্তাফিজুর রহমান

Originally posted in দেশ রুপান্তর on 9 July 2024

জাতীয় বাজেটকে কেন্দ্র করে জুন মাস জুড়ে খাদ্যসহ প্রায় সব পণ্যের দাম ছিল ঊর্ধ্বমুখী। এর মধ্যে সারা দেশে বিভিন্ন স্থানে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় সবজির দামও নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অধিকাংশ সবজির দামই শতক ছাড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি মে মাসের তুলনায় জুনে বাড়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত হিসাবে দেখা যায়, মে মাসের তুলনায় জুনে মূল্যস্ফীতি কমেছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। গতকাল রবিবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত মাসিক ভোক্তা মূল্যসূচকে (সিপিআই) এ চিত্র উঠে এসেছে।

সম্প্রতি রপ্তানির তথ্যে কারসাজির বিষয়টি সারা দেশে আলোড়ন তৈরি করেছে। সরকারি এক প্রতিষ্ঠান আরেক প্রতিষ্ঠানের ওপর দোষ চাপাচ্ছে। আসল তথ্যে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় কম হওয়ায় পুরো আর্থিক হিসাব ওলটপালট হয়ে গেছে। ১৪ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি কম হওয়ায় প্রভাব পড়তে পারে দেশের জিডিপিতে। রপ্তানির মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকাশিত অন্যান্য তথ্যেও আস্থা রাখতে পারছে না দেশের মানুষ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ভাষ্য, মূল্যস্ফীতির সঠিক তথ্যই দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তারা। কিছু পণ্যের দাম যেমন বাড়ছে, বিপরীতে কিছু পণ্যের দাম কমেছে বলেও মনে করছেন বিবিএসের কর্মকর্তারা।

বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা যা তথ্য পেয়েছি সেটিই দিয়েছি। সব পণ্যের দাম বাড়ছে সেটি বলা যাবে না, আমরা বিভিন্ন দিকের তথ্য নিয়েই পরিসংখ্যান দিই।’ তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতির তথ্যে গত এক মাসের চিত্রে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। পণ্যের দাম আগের মাসের খুব কাছাকাছি।

২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছিল। মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়ে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় তারা। এরপরই ক্ষমতায় আসে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার। এ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরও উচ্চ মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে সময় লেগেছিল দুই বছর। সর্বশেষ ২০১০-১১ অর্থবছরে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৯২ শতাংশ। সে অর্থবছরের পর সদ্য শেষ হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে ঠেকেছে, ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। অর্থাৎ গত ১৩ বছরে এটিই সর্বোচ্চ গড় মূল্যস্ফীতি।

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বাংলাদেশ একটি দুষ্টচক্রে জড়িয়ে গিয়েছে। এর থেকে উত্তরণের জন্য কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রয়োজন।

সিপিআইতে দেখা যায়, বাংলাদেশের বাজারের গত এক মাসের চিত্রের সঙ্গে সরকারের দেওয়া মূল্যস্ফীতির হিসাবের কোনো মিল নেই। বিশেষ করে, সারা দেশে বন্যা পরিস্থিতির কারণে ফসলের মাঠ ডুবে যাওয়ায় খাদ্যদ্রব্যে গত এক মাসে সবচেয়ে বেশি হাঁসফাঁস করতে হয়েছে দেশের মানুষকে। কিন্তু বিবিএস বলছে, জুন মাসে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশে ঠেকেছে। শুধু তাই নয়, খাদ্য মূল্যস্ফীতিও কমে ১০ দশমিক ৪২ শতাংশে ঠেকেছে বলে দাবি করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির সিপিআইতে! খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে ৯ দশমিক ১৫ শতাংশে নেমেছে।

জুনে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৭২ শতাংশের অর্থ হলো আগের বছরের জুনে যে পণ্য ১০০ টাকায় কিনতে হয়েছিল, এ বছরের জুনে তা কিনতে হয়েছে ১০৯ টাকা ৭২ পয়সায়।

তথ্য বলছে, শহর এলাকার চেয়ে গ্রাম এলাকার মানুষের মূল্যস্ফীতির কষ্ট বেশি। জুনে গ্রামের গড় মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৮১ শতাংশে ছিল, যেখানে শহর এলাকায় গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ।

এমন হিসাবের সঙ্গে দেশের বাজারের মূল চিত্রের ফারাক অনেক। গত জুনে সারা দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যার কবলে রয়েছে। অনেক জেলা এখনো বন্যার পানিতে ডুবে আছে। ফসলের ক্ষেত ডুবে গেছে অধিকাংশ এলাকায়। ফলে সবজির বাজারে আগুন জ্বলছে।

গত দুই বছর বাংলাদেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতি ভোক্তাদের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষ সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। সাধারণত পৃথিবীর সব দেশ উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দিলে ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়িয়ে মুদ্রার সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়। ফলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সম্প্রতি এমন উদাহরণ তৈরি করেছে শ্রীলঙ্কা ও ভারত। তবে বাংলাদেশে গত এক বছর সুদের হার বাড়তে থাকলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে তা কোনো কাজে আসছে না।

সদ্য শেষ হওয়া অর্থবছরে সরকারের গড় মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। এ পরিপ্রেক্ষিতে দেরিতে হলেও ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু বাস্তবে কোনো সুফল আসেনি। মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও অনেক ওপরে, ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সময়ের কাজ সময়ে না করায় এমন পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে। ঠিক যে সময়ে সুদের হার বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল, সে সময় সুদের হার না বাড়িয়ে ব্যাংকগুলোকে টাকা ছাপিয়ে তারল্য সরবরাহ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলাফল দাঁড়িয়েছে উল্টো।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এটি অর্থনীতি যে বিভিন্ন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তারই প্রতিফলন। টাকার অবনমনের ফলে আমদানিকৃত মূল্যস্ফীতিও এখানে বড় ভূমিকা রাখছে। সম্প্রতি ডলার ১১৭-১১৮ টাকা হয়েছে। ফলে আমদানিকৃত মূল্যস্ফীতিও সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে। আবার টাকার অবমূল্যায়ন না করেও উপায় ছিল না।’

গত বছরও সরকারের মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৫, তখন তা দাঁড়িয়েছিল ৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশে। এখন সেটি ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। এ বছরও সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ৬ দশমিক ৫ শতাংশ।

শুল্ক ও রাজস্বনীতিতে পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়ে ড. মোস্তাফিজ বলেন, ‘আমাদের শুল্ক ও রাজস্ব নীতির পরিবর্তন করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর আরেকটু শুল্ক কমিয়ে কিছুটা হ্রাস করা যেত। সেটি করা যায় না কারণ আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত বিশ্বের মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে কম। প্রত্যেকটি খাতই একটা দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়েছে।’

তার মতে, ‘আমাদের নীতিনির্ধারকদের হাতে যেসব বিকল্প আছে, বিশেষ করে এক্সচেঞ্জ রেটটাকে কমিয়ে স্থির রাখায়, কিংবা শুল্ক কমাবে না এগুলো করা যাচ্ছে না কারণ ডলারের অবনমন করতে গেলে আমাদের রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে প্রভাব পড়ে। এটা করলে আবার আমাদের আমদানিকৃত মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেওয়া হয়।’

বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণে জটিলতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমরা রাজস্বনীতি পরিবর্তন বা শুল্ক কমাতে পারছি না, কারণ আমাদের এমনিতেই কর-জিডিপি অনুপাত কম। সুতরাং বাংলাদেশ বড় একটি চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে গেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘তারপরও আমি মনে করি বাজার ব্যবস্থাপনা উন্নত করে, তথ্য-উপাত্ত ঠিকভাবে সরবরাহ করে, তথ্য-উপাত্তভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিয়ে যেসব সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান আছে, তাদের সাপ্লাই চেইনে কোনো ধরনের সমস্যা আছে কি না বা কেউ কিছু করছে কি না, তা দেখা দরকার। ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর, প্রতিযোগিতা কমিশন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এগুলো দেখভাল করবে।’

সাধারণ মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ কমানোর পরামর্শ দিয়ে ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘সাধারণ মানুষের ওপর নেতিবাচক অভিঘাত কমানোর জন্য আমাদের সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় থাকা ফ্যামিলি কার্ডের প্রাপ্যতা আরেকটু বাড়ালে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ আরেকটু কমবে।’ তিনি বলেন, ‘সাধারণ মানুষের ওপর গত কয়েক বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ রয়েছে। মূল্যস্তর আরও অনেক ওপরে উঠে গেছে। মানুষ তাদের আয়ের সঙ্গে সংগতি রাখতে পারছে না, সঞ্চয় ভাঙতে হচ্ছে। এর অভিঘাত পড়ছে আবার বিনিয়োগের ওপর। এদিকে আমাদের নজর দিতে হবে খুব ভালোভাবে।’

বিবিএসের তথ্য বলছে, গত এক বছরে সবচেয়ে বেশি ওঠানামা করেছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি। গত অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশে ঠেকেছিল। জুনেও খাদ্যের মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৪২ শতাংশে রয়েছে।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি ড. গোলাম রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটা কথা আছে সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়। যখন মূল্যস্ফীতির লাগাম টানার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজন ছিল তখন নেওয়া হয়নি। তাই এ মুহূর্তে সেসব ব্যবস্থা নিলেও নিয়ন্ত্রণে আসতে বেশ সময় লাগছে।’

তিনি বলেন, ‘এরপরও যদি উল্টাপাল্টা কিছু না হয়, এসব পদক্ষেপ যদি ঠিক থাকে। অর্থাৎ সরকার যদি ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত ঋণ না নেয়, কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ঋণ না নেয় আর টাকার অধঃপতন যদি আরও না হয় তাহলে এটি ঠিক হয়ে যাবে।’