Originally posted in খবরের কাগজ on 25 January 2024
আমাদের সামনে অর্থনীতির যে চ্যালেঞ্জগুলো বিদ্যমান আছে, সেগুলো নিয়েই নতুন সরকারকে কার্যক্রম শুরু করতে হবে। বিগত সময়ে অর্থনীতির ওপরে আমরা যে চাপ দেখেছি, সে চাপগুলো এখনো রয়ে গেছে। অন্যদিকে নির্বাচিত সরকার নতুন করে তাদের যাত্রা শুরু করেছে। তাদের সামনে একদিকে মূল্যস্ফীতির চাপ, বৈদেশিক রিজার্ভের নিম্নগতি, রাজস্ব জিডিপির নিম্নহার ইত্যাদি রয়েছে। অন্যদিকে খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা, টাকার অবমূল্যায়ন এবং অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনায় বিভিন্নমুখী চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এই চ্যলেঞ্জগুলো নিয়েই ২০২৩ সাল শেষ হয়েছে। কাজেই বর্তমান সরকারকে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করেই অগ্রসর হতে হবে। সেখানে মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি, সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাসহ প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাগুলো মোকাবিলা করতে হবে। সুশাসনের সঙ্গে সাশ্রয়ীভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে নজরদারি বাড়াতে হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি শক্তিশালী করতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।
বর্তমান সময়ে আমাদের প্রথম যে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে তা হলো, মূল্যস্ফীতি রোধ করা। এটা নিম্ন আয়ের মানুষকে বড় ধরনের একটা চাপের মুখে ফেলে দিয়েছে। অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য মুদ্রানীতি দেওয়া হয়েছে। সেখানে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কথা বলা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে বিনিয়োগ ও ব্যক্তি খাতে ঋণ গ্রহণের ওপরেও এর একটা প্রভাব পড়বে। তা ছাড়া সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে আমরা কীভাবে ব্যবসায়িক পরিস্থিতি উন্নত করতে পারি, সে দিকটা নজরে রাখতে হবে। বিভিন্ন ধরনের পরিষেবার মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের আমরা কতটা সাশ্রয়ীভাবে সুযোগ করে দিতে পারি, সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য সামাজিক সুরক্ষা শক্তিশালী করতে হবে। প্রান্তিক আয়ের মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এবং মূল্যস্ফীতি রোধ বিবেচনা করে বাজার ব্যবস্থাপনার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমদানি স্তর থেকে ভোক্তা স্তর বা উৎপাদক স্তর থেকে ভোক্তা স্তরে মধ্যস্বত্বভোগী যারা আছেন তারা বাজারে এক ধরনের সিন্ডিকেট করার চেষ্টা করছেন। সেগুলো নজরদারির আওতায় রাখতে হবে। একই সঙ্গে দেশে যারা ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত, তাদের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতার যে আইন প্রণয়ন করা আছে, সেটা কার্যকর করতে হবে। আইন বাস্তবায়ন করতে গেলে প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্তের ওপরে নির্ভর করতে হবে এবং সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অনেক বড় একটি ভূমিকা পালন করতে পারে।
বর্তমান মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে, ব্যাংকিং সেক্টরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার অবশ্যম্ভাবীভাবে করতে হবে। যারা স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ঋণ গ্রহণ করে খেলাপি হিসেবে গণ্য হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। দেশের বহিঃখাত একটা ঝুঁকির মধ্যে আছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণ এবং রাজস্ব আয়ের বড় একটি অংশ ঋণের পরিষেবায় চলে যাচ্ছে। সেদিকে আমাদের নজর রাখতে হবে। বিশেষ করে যারা বৈদেশিক ঋণ থেকে বিনিয়োগ করেছে, সে ক্ষেত্রে যেন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি থাকে, সেদিকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং লক্ষ রাখতে হবে তা যেন সাশ্রয়ীভাবে করা সম্ভব হয়। তাহলে বিনিয়োগ থেকে আমরা যে রিটার্ন আশা করছি সেটা পাব।
আমাদের যে অবকাঠামো প্রস্তুত করা হয়েছে তা অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয়ের প্রতি মনোযোগ রাখতে হবে। একটি হলো যেকোনো প্রজেক্ট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যে পরিমাণ ব্যয় হয় সেদিকটা আমলে নেওয়া উচিত। নিজস্ব দায়ভার ও পরিষেবাদানের ক্ষেত্রে এক ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, সেটাও কিন্তু একটি বড় সমস্যা হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। কাজেই কিছুটা জায়গায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থার পাশাপাশি সাবধান হওয়ার দরকার আছে। আমরা জানি যে, রাজস্ব আয়ের একটা বড় অংশ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ব্যয় করতে হবে। তা ছাড়া বিনিময় হারের যে নীতি গ্রহণ করা হয়েছে, অর্থাৎ অবনমন নীতির ক্ষেত্রে একটি ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতিতে সেটাই বলা হয়েছে।
বাজারের সঙ্গে আমাদের সমন্বয় রক্ষা করা জরুরি। এখানে অনেক ধরনের দুর্বলতা দেখেছি। বিশেষ করে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট দুর্বলতা দেখা যায়। এসব বিষয়ে সব সময় নজর দিতে হবে। অর্থনৈতিক একটা টিম তৈরি করতে হবে। সেটি যেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, সেদিকে আমাদের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। অনেক সময় দেখেছি, অর্থনৈতিক নীতিমালা গ্রহণ করেও সমাধান পাওয়া যায় না। এবার সময় এসেছে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা দক্ষভাবে বাস্তবায়নের দিকে নজর দেওয়ার।
তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি মধ্যমেয়াদি চ্যালেঞ্জ যেগুলো আছে সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। বিশেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক শক্তিমত্তা বৃদ্ধি করা, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সেবাদানের ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা; অন্যদিকে আমরা যেন রাজস্ব আহরণ বাড়াতে পারি সেদিকে নজর দিতে হবে। ডিজিটালাইজেশনের দিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে। দক্ষতা বৃদ্ধি করে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। আমরা অনেক অবকাঠামোয় বিনিয়োগ করেছি। যোগাযোগব্যবস্থাসহ বৈদেশিক বিনিয়োগ বাণিজ্যিক ব্যবস্থাকে উন্নত করবে। একই সঙ্গে দক্ষতা বৃদ্ধি করে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে।
প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। আঞ্চলিক বাজারে আমরা যেন রপ্তানি বৃদ্ধি করতে পারি, সেদিকটা অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে। দেশের যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত করার পাশাপাশি বাণিজ্যিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করে বিশ্ববাজারে ঢোকার একটা ব্যবস্থা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে গেলে প্রযুক্তি ও শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। সেগুলো মোকাবিলা করার ঝুঁকিও নতুন সরকারের সামনে আসছে। এ বিষয়গুলো ইনক্লুসিভভাবে অগ্রাধিকার দিয়ে ভবিষ্যতের সুযোগগুলো কাজে লাগাতে হবে। নিজস্ব আর্থসামাজিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ওপরে আস্থা রাখতে হবে। একই সঙ্গে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখার পাশাপাশি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার উৎকর্ষ ও মানোন্নয়নে আরও মনোযোগী হতে হবে। আমরা যেন ঘাটতির জায়গাগুলোতে নজরদারি বাড়িয়ে প্রয়োজনীয় কর্মপন্থা অনুসরণ করতে পারি সেদিকে লক্ষ রাখা দরকার। তা না হলে এই সংকট মোকাবিলা করা কঠিন হবে।
লেখক: সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)