Originally posted in প্রথম আলো on 5 February 2023
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মানি লন্ডারিং নিয়ে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে। মানি লন্ডারিং বন্ধে ব্যর্থতা, অর্থ পাচারের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট, আর্থিক নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা ইত্যাদি বিষয় তাঁর কথায় উঠে এসেছে। কথা বলেছেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আসাদুজ্জামান
প্রথম আলো: দেশ থেকে বাণিজ্যের নামে ৮৫ শতাংশ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। এসব তথ্য জানার পরও কেন বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার ঠেকাতে পারছে না সরকার?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: দেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক সুশাসনের জন্য এটা খারাপ। এই স্বীকারোক্তি আমাদের মনের ভেতরে আসতে হবে। এই সমস্যার রাজনৈতিক স্বীকৃতি আমাদের দেশে নেই। এটাকে আমরা মুখের কথা হিসেবে বলছি অথবা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে নানাভাবে ব্যবহার করছি। কিন্তু সমস্যাটাকে সততার সঙ্গে, নির্ভীকভাবে আমরা সামনে নিয়ে আসতে চাইনি বা পারিনি। রাজনৈতিক সমর্থন ছাড়া অর্থ পাচারের মতো এমন একটি সংবেদনশীল বিষয়ে কোনো পেশাজীবী, কোনো সরকারি কর্মকর্তা সামনে এগোবেন, এটা আশা করা কল্পনাতীত।
প্রথম আলো: অর্থ পাচার ঠেকাতে সরকারের ঘাটতি কোথায় বলে আপনি মনে করেন?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: আফ্রিকার বহু দেশ পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে এনেছে। সেখানে দেখা যায়, সরকার বদল হলে তাদের পূর্বসূরির কৃতকর্ম উন্মোচন করে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনছে। সুইজারল্যান্ড থেকেও আফ্রিকার অনেক দেশ অর্থ ফেরত নিয়েছে। নাইজেরিয়ার মতো দেশও সুইস ব্যাংক থেকে প্রচুর অর্থ ফিরিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশে যেমন রপ্তানি করেও অনেক ব্যবসায়ী অর্থ ফিরিয়ে আনেন না, ঠিক তেমনই নাইজেরিয়াতেও অনেকে তেলের টাকা ফেরত আনেননি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যেটা গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, খুচরা প্রতিষ্ঠানের পেছনে সময় ব্যয় না করে বড় বড় ও প্রভাশালী ব্যক্তি যাঁরা ব্যবসার নামে অর্থ পাচার করেছেন, তাঁদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে অর্থ পাচার ঠেকানো যাবে না।
প্রথম আলো: কর্মকর্তারা বলছেন, বিদেশে অর্থ পাচারের তথ্য সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে তদন্ত শেষ করা যায় না। বিষয়টিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: বিদেশিরা ভালো করে চিন্তা করে দেখেন, একটা ঘটনাকে শেষ পর্যন্ত নিতে হলে তদন্ত ও বিচারের পেছনে কত ব্যয় হবে। এই ব্যয়ের ফলাফল কী হবে? তাঁরা সব সময় যৌক্তিকভাবে ব্যয় করেন। সে জন্য তাঁরা বড় বড় অর্থ পাচারের বিষয়ে যুক্ত হন, মনোযোগী হন। কিন্তু বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির অভাব রয়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনার তদন্ত প্রক্রিয়ার সঙ্গে একাধিক প্রতিষ্ঠান যুক্ত। তাদের সক্ষমতা বাড়ানো দরকার। একই সঙ্গে তাদের সুরক্ষা দেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আজকাল কেউ আর কাগজে–কলমে যোগ–বিয়োগ করে কিংবা ক্যালকুলেটরে এই কাজ করে না। এ জন্য আলাদা সফটওয়্যার আছে। দেশে দেশে নানা সফটওয়্যার ব্যবহৃত হয়। একটা সফটওয়্যার সঙ্গে আরেকটা যুক্ত থাকে।
এই প্রক্রিয়ায় মানুষের হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ থাকে না। এই প্রক্রিয়া আমাদের দেশে নেই। এই কাজ করার জন্য দক্ষতাসম্পন্ন লোকবল দরকার। আবার তাদের আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সুরক্ষার অভাব রয়েছে।
প্রথম আলো: বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে অর্থ পাচার বেড়ে যায়। এটি বন্ধে করণীয় কী?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: সব জায়গায় যদি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা না যায়, রাজনীতিবিদদের ওপর চাপ সৃষ্টি না করা যায়, তাহলে ক্ষমতাশীল ব্যক্তিদের ওপর চাপ তৈরি করা যাবে না। এক বছর পর দেশে জাতীয় নির্বাচন হবে। নির্বাচনী প্রচারে অর্থ পাচার ও দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির বিষয়টি একটি জাতীয় অঙ্গীকারে পরিণত করার চেষ্টা করতে হবে।
প্রথম আলো: সব সংস্থাই বলছে, হুন্ডিতে দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে। এটি কেন বন্ধ হচ্ছে না?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে, বেসরকারি উপায়ে অর্থ বিনিয়োগ করে অন্য দেশে আমরা নিয়ে যাচ্ছি, যেটাকে আমরা হুন্ডি বলে থাকি। হুন্ডি অনেক সময় প্রত্যক্ষ হয়, দ্বিপক্ষীয়ভাবে হয়, অনেক সময় ত্রিপক্ষীয়ও হয়। যেমন সোনা চোরাচালান দিয়ে সেটা প্রকাশ পায়। একটা পণ্যের মাধ্যমে অন্য পণ্যের চোরাচালান হয়। বিষয়টি হচ্ছে, যাঁরা এভাবে অর্থ পাচার করেন, তাঁদের স্বার্থে আঘাত লাগলে তাঁরা রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে নড়াচড়া করিয়ে দিতে পারেন।
প্রথম আলো: মানুষ বিদেশমুখী। একটা শ্রেণি অর্থ পাচারকে কোনো অপরাধই মনে করছে না। নাগরিকের এমন মনোভাবের কারণ কী?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: যাঁর হাতে অর্থ আছে, তাঁকে যদি রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে না পারে যে তাঁর সম্পত্তি ও উত্তরসূরিরা এ দেশে নিরাপদ, তাহলে অর্থ পাচার কোনোভাবেই ঠেকানো যাবে না। আমরা এক পদ্ধতি আটকালে অন্য পদ্ধতিতে পাচার হবে। তিনি যেখানে নিরাপদ বোধ করবেন, সেখানে যাবেন। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে আশাবাদী করে তোলা, উচ্চবর্গের মানুষকে এ দেশে তাঁদের বিনিয়োগ বাড়াতে উৎসাহিত করা জরুরি। এ জন্য প্রয়োজন সুশাসন, প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, প্রয়োজন নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত করা। যে দেশে বিচারব্যবস্থা ঠিকমতো কাজ করে না, আইনি কাঠামো কোনো চুক্তিকে কার্যকর করতে পারে না, সেই দেশে শুধু প্রশাসনিক ব্যবস্থা দিয়ে টাকা পাচার আটকানো যাবে না। বিষয়টি বহুমাত্রিক।
প্রথম আলো: ব্যাংকিং খাতের অনেকে মানি লন্ডারিংয়ের মামলার আসামি। কেন এই খাতের এত মানুষ অপরাধে জড়াচ্ছেন?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: মানি লন্ডারিংয়ের যেসব ঘটনা ঘটে, তার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে ব্যাংকিং ব্যবস্থা যুক্ত। পাচারের অর্থপ্রাপ্তি অথবা চালান অথবা রক্ষণাবেক্ষণ অথবা কোথাও বিনিয়োগের সঙ্গে ব্যাংকিং ব্যবস্থা যুক্ত থাকে। বেসরকারি মালিকানাধীন যেসব ব্যাংক আছে, বর্তমানে যে ব্যাংকিং কোম্পানি আইন আছে, সেখানে সুরক্ষার যে বিষয়গুলো, তা এখন দুর্বল। একটি পরিবার থেকে পরিচালকের সর্বোচ্চ সংখ্যা, পরিচালক হিসেবে মেয়াদকাল আগের চেয়ে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
সুশাসন নিশ্চিত করার বড় একটা দায়িত্ব হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। তাদের নজরদারি যে কত দুর্বল, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তার চেয়েও একজন ঋণখেলাপি ব্যাংকমালিক কতটা শক্তিশালী—তার প্রমাণ তো আমরা বিভিন্ন সময় পেয়েছি। তাঁরা সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। রাজনৈতিক অঙ্গীকার না থাকলে এসব জটিল আর্থিক দুর্নীতির সমাধান আরও কঠিন।
প্রথম আলো: মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধ দমনে বিএফআইইউর দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আপনিও কি তা–ই মনে করেন?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: যে আইনের বলে বিএফআইইউ কাজ করে, সেখানে তথ্য-উপাত্ত বিনিময়ের ক্ষেত্রে সরকারের ভেতরে কী ধরনের বিধিনিষেধ আছে, সেগুলো পর্যালোচনা করে দেখার বিষয়। বিদেশে এগুলো আলাপ-আলোচনার জন্য একটা প্ল্যাটফর্ম থাকে। সেই প্ল্যাটফর্মে একধরনের গোপনীয়তা থাকে। আস্থার সম্পর্ক থাকে।
সেগুলোর ভিত্তিতে কাজ হয়। এর ওপর রাজনৈতিক নেতৃত্ব কাজ করে। আমাদের দেশে সেসব কাজে আস্থার পরিবেশ খুবই দুর্বল। যেহেতু আস্থার পরিবেশ দুর্বল এবং পরে কোনো ধরনের রাজনৈতিক সমস্যা দেখা দিলে এসব পেশাজীবী সরকারি কর্মকর্তা ভিকটিম হয়ে যেতে পারেন, তাঁরা এই ভয়ে থাকেন। এই অবস্থার উন্নতি না হলে বিএফআইইউর সক্ষমতা সঠিকভাবে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে নানা সমস্যা দেখা দেবে।