Originally posted in বিবিসি বাংলা on 20 September 2024
বাংলাদেশে ‘অলিগার্ক’দের শিল্প কারখানার ভবিষ্যৎ কী?
বাংলাদেশে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ব্যবসা বাণিজ্যে কয়েকটি বড় শিল্পগোষ্ঠীর একচেটিয়া আধিপত্য দেখা গেছে। ক্ষমতার ছত্রছায়ায় প্রভাব খাটিয়ে বিপুল সম্পদের মালিক এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাংকিং ব্যবস্থায় এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কারণে বাংলাদেশে এসব শিল্প মালিকদেরকে ‘অলিগার্ক’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হচ্ছে।
পদচ্যুত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ এবং চট্টগ্রাম ভিত্তিক শিল্পগ্রুপ এস আলম কথিত ‘অলিগার্ক’দের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। বিপুল পরিমাণ ঋণ, বিদেশে অর্থ পাচার, ব্যাংক দখলসহ শেয়ার বাজারে কারসাজির মতো অভিযোগে এসব শিল্পগোষ্ঠীর কর্ণধারদের বিরুদ্ধে কঠোর হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
এছাড়া দেশের বিদ্যুৎ খাত, নির্মাণ শিল্প, ভোগ্যপণ্যসহ বিভিন্ন সেক্টরে এরকম অলিগার্ক তৈরি হয়েছিল যাদের ভূমিকা নেতিবাচক হিসেবে এখনকার ক্ষমতাসীনরা সামনে আনছে।
তৈরি পোশাক, সিরামিক, ঔষধ এবং গণমাধ্যম সেবাসহ বহুমাত্রিক পণ্য উৎপাদন, আমদানি- রপ্তানি বাণিজ্য রয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপের। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ আর শেয়ার বাজারে কারসাজির অভিযোগে অভিযুক্ত এই গ্রুপের মালিক সালমান এফ রহমান।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সুবিধাভোগী হিসেবে আলোচিত অন্যতম শিল্প গ্রুপ এস আলম। ইসলামী ব্যাংকসহ ‘শরীয়াহভিত্তিক’ বেশ কয়েকটি ব্যাংক দখলের অভিযোগ, লক্ষ কোটি টাকা ঋণ এবং বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ আনা হচ্ছে এস আলমের মালিক সাইফুল আলমের বিরুদ্ধে।
বিদ্যুৎ-জ্বালানি, সিমেন্ট, ইস্পাত কারখানা থেকে শুরু করে ভোজ্যতেল, চিনি, ট্রান্সপোর্ট, টেক্সটাইল, মিডিয়াসহ বিভিন্ন ব্যবসা বাণিজ্যের এক বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে চট্টগ্রাম ভিত্তিক শিল্পগোষ্ঠীটি। এস আলম শিল্পগোষ্ঠীর দাবি অনুযায়ী সব মিলিয়ে ১৪টি সেক্টরে বাংলাদেশে ১৩.২ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ রয়েছে তাদের।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, “তারা নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং সুবিধা পেয়েছে এবং তাদের সাথে আবার রাজনীতির একটা যোগাযোগ ছিল, সংযোগ ছিল। তা না হলে তো আর তারা এরকম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এদের নিয়ন্ত্রণ এত বেশি এবং কয়েকজন মিলে একটা খাতকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে এজন্যই এদেরকে বলা হয় অলিগার্ক।”
বেক্সিমকো এবং এস আলম শিল্পগোষ্ঠীর মালিকদের ব্যাংক হিসাব স্থগিত হওয়ায় কোম্পানির ব্যবসা পরিচালনায় সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এসব শিল্পগোষ্ঠীতে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের কর্মসংস্থান রয়েছে।
বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান এখন কারাগারে। তার ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হয়েছে।
দায়, দেনা, ঋণ ও মামলায় বেক্সিমকো গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনায় সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলো দেখাশোনার জন্য একজন রিসিভার নিয়োগ করতে নির্দেশনা জারি করেছে আদালত।
এস আলম গ্রুপ ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সরকারের কাছে আর্থিক, সামাজিক ও আইনি সহায়তা চেয়ে চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে হাজারো শ্রমিকের বেতন ভাতা পরিশোধে ব্যর্থ হলে শিল্প এলাকায় শ্রমিক অসন্তোষের শঙ্কার কথা বলা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, এলসি বাতিল করায় ভোগ্যপণ্য আমদানি ব্যহত হচ্ছে যা দেশে খাদ্য ও বস্তুগত সংকট তৈরি করতে পারে।
‘অলিগার্ক’দের কারখানার কী হবে ?
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এই শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে অন্তবর্তী সরকার কী সিদ্ধান্ত নেবে সেটি এখন একটা বড় প্রশ্ন। শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া বিবিসি বাংলাকে বলেন, সরকারের লক্ষ্য শিল্প রক্ষা করে কীভাবে ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করা।
“প্রতিষ্ঠানগুলো অবশ্যই টিকিয়ে রাখতে চাই দেশের স্বার্থে। দেশের মানুষের স্বার্থে। কিন্তু এখানে কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তি জড়িত ছিল। যারা ওই প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করে মানি লন্ডারিং করেছে, ঋণ নিয়েছে, ঋণ খেলাপি হয়েছে। সেই ব্যক্তিদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসতে পারে। কিন্তু বড় বড় প্রতিষ্ঠান হাজার হাজার শ্রমিক আছে, আমরা কোনও সিদ্ধান্ত নিতে গেলে তাদের ব্যাপারটাও ভাবতে হবে। তাদের জন্যও বিকল্প কর্মসংস্থানের কথা ভাবতে হবে। এবং এর প্রভাব জাতীয় অর্থনীতিতে কীভাবে পড়বে সেটাও আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে।”
প্রতিষ্ঠানগুলো টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে শ্রম উপদেষ্টা জানান মালিকানায় পরিবর্তন আনা এমনকি কিছু জাতীয়করণ করা যায় কি না সে চিন্তা-ভাবনা থেকে পর্যালোচনা চলছে।
“একটা প্রতিষ্ঠানেতো মালিক একাধিক থাকে। অনেক স্টেকহোল্ডার্স আছে। তাদের মধ্যে থেকে কাদেরকে দায়িত্ব দিয়ে অথবা যদি প্রয়োজন বোধ করে শিল্প মন্ত্রণালয় জাতীয়করণ করতে পারে, কারণ শ্রমিকদের দিকটাও আমাদের দেখতে হবে। এবং দেশের এইরকম পলিসিগত ডিসিশন এবং এর বাস্তবায়ন এটা দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। এটা আমরা একদিনে পারবো না আবার একদিনে সেটা করতে গেলে সেটা আমাদের শিল্পের ক্ষতি করতে পারে। এবং আমাদের শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের ক্ষতি করতে পারে।”
“সেজন্য আপনারা দেখেছেন যে একটি বড় বিজনেস বেল্টের গার্মেন্টসের যে স্যালারি সেটা দেয়ার জন্য কিন্তু সরকার গ্যারান্টি দিয়ে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। তো সেক্ষেত্রে আমরা স্মুদলি কীভাবে এই জিনিসগুলো সমাধান করা যায় সে নিয়ে কাজ করছি,” যোগ করেন মি. ভুঁইয়া।
এ বিষয়ে সিপিডির ফাহমিদা খাতুন বলেন, “রেগুলেটরি মেইজার অনেক ধরনের নিতে হবে। এবং সাময়িকভাবে হলেও কিছুটা কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কারণ ওখানে হঠাৎ করে অন্য আরেকজন যদি সমান দক্ষভাবে না চালাতে পারে ব্যবসা, তাহলেতো সেবার মান নেমে যাবে কিংবা প্রতিষ্ঠানের লাভ কমে যাবে। তো সেটা একটা খারাপ অবস্থা, চ্যালেঞ্জিং সিচ্যুয়েশন আমি বলবো।”
শিল্পের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা
বাংলাদেশে গত দেড় দশকে তথাকথিত অলিগার্কদের শিল্প কারখানার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে। এখন সেগুলো চাপের মুখে পড়েছে নানাভাবে। ৫ই আগস্ট সরকার পতনের পর এসব শিল্পমালিককের বেশকিছু প্রতিষ্ঠান হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের শিকার হয়েছে।
বেক্সিমকো, এস আলম’র মতো ‘অলিগার্ক’দের শিল্প-কারখানার ভবিষ্যৎ কী?
আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের এমনও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। বেক্সিমকো গ্রুপের বেশকটি প্রতিষ্ঠান অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও হামলার শিকার হয়েছে।
ঢাকার কাছে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের এমপি এবং সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর মালিকানাধীন গাজী গ্রুপের সাতটি প্রতিষ্ঠান পাঁচই আগস্টের পর ব্যাপক হামলা, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সরকার পতনের পর হামলায় উৎপাদন বন্ধ এবং ক্ষতি হওয়ার কারণে গাজী গ্রুপের সাতটি প্রতিষ্ঠানের প্রায় সাড়ে সাত হাজার শ্রমিক ছাটাই করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া গাজী টায়ারের একটা বড় যোগান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পণ্যের বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বলেও ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।
এছাড়া পোশাক শিল্প এলাকায়ও ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা নিয়ে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য সরকারের কাছে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি উঠেছে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি করার কোনো বিকল্প নাই।
“যখন সরকার গঠিত হয়েছে তখন থেকেই সবাই বলছিল যে যত দ্রুত সম্ভব স্ট্যাবিলিটি আনা। এবং এই যে ক্ষয়ক্ষতি কিংবা আক্রমণ এগুলি বন্ধ করতে হবে। এগুলি দেশের ব্যবসা বাণিজ্য যেমন ক্ষতিগ্রস্ত করছে তেমনি আবার দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। যারা বাইরে থেকে আসছে এবং যাদেরকে আমরা আনতে চাই তাদের কাছে তো একটা খারাপ মেসেজ চলে যাচ্ছে।”
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকার তৎপর হয়েছে। ইতোমধ্যে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেয়া হয়েছে। কথিত ‘অলিগার্ক’দের প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবিষ্যৎ এবং সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সাক্ষাৎকার চাইলে শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমানের দপ্তর থেকে জানানো হয় এই মুহূর্তে তিনি কথা বলতে রাজি নন।