সরকারকে আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তবতা ও সক্ষমতার সামঞ্জস্য রাখতে হবে – ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

Originally posted in সমকাল on 19 August 2024

অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির একজন সম্মাননীয় ফেলো। তিনি এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক। এ ছাড়া তিনি জাতিসংঘের এলডিসি সংক্রান্ত কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি-সিডিপির অন্যতম সদস্য। এর বাইরে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা, মস্কো, অক্সফোর্ড ও ওয়াশিংটনে। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৫৬ সালে। আদি নিবাস টাঙ্গাইল। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের সহযোগী সম্পাদক শেখ রোকন।

সমকাল: ওয়ান ইলেভেন সরকার এবং এবারের সরকারের মধ্যে মিল খুঁজে পান?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: রাষ্ট্র পরিচালনা করার ক্ষেত্রে অথবা ক্ষমতার গণতান্ত্রিক পন্থায় শান্তিপূর্ণ হস্তান্তরের ক্ষেত্রে যদি প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়, দেশ প্রথমে হোঁচট খায়, পরে আছাড় খেয়ে পড়ে। এটা ওয়ান ইলেভেনের সময় হয়েছিল, এবারও হলো। ২০০৬ সালে বিএনপি সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটা হয়নি, তিন মাস পরে ২০০৭ সালে জানুয়ারির ১১ তারিখে হয়েছে। এবারও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে হয়নি। বিনা ভোটের নির্বাচনে সরকার বানানোর চেষ্টা হয়েছে ৭ জানুয়ারি, আছাড় খেয়েছে আগস্ট মাসে এসে।

সমকাল: কেন আছাড় খেতে হয়?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: বিরোধী দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচনে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা থাকলেও রাজনৈতিক বৈধতা থাকে না। পরবর্তী সময়ে নৈতিক বৈধতার সংকট অবধারিতভাবেই একটা পর্যায়ে গিয়ে ক্ষোভের উদ্গিরণ সৃষ্টি করে।

সমকাল: ওয়ান ইলেভেন পরিস্থিতি ও এবারের গণঅভ্যুত্থান পরিস্থিতির মধ্যে পার্থক্য কী?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: বিএনপি সরকারের রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়েছিল, সেখানে বিরোধী দলগুলো নেতৃত্বে ছিল। এবার প্রথাগত রাজনৈতিক শক্তির বদলে নতুন সামাজিক শক্তি ছাত্র-যুবারা নেতৃত্ব দিয়েছে। সেবার প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক বিষয়গুলো সামনে রেখে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। পরে সেটা আর্থসামাজিক সংস্কারের দিকেও গড়িয়েছে। এবার অরাজনৈতিক বিষয়, যেমন কোটা সংস্কারের বিষয়টি সামনে রেখে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। পরে সেটা রাজনৈতিক লক্ষ্যে গড়িয়েছে।
আপনি বলতে পারেন, সেবার আমরা বড় বিষয় থেকে ছোট বিষয়ে নেমে এসেছিলাম। সুষ্ঠু নির্বাচনের ইস্যু থেকে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পদত্যাগ ইস্যুতে নেমেছিলাম। সিন্ধু থেকে বিন্দুতে নেমেছিলাম। এবার আমরা বিন্দু থেকে সিন্ধুতে গেছি। কোটার মতো সামাজিক ইস্যু থেকে সামগ্রিক রাজনৈতিক ইস্যুতে এসেছি। তবে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হচ্ছে, প্রফেসর ইউনূসের সরকার একটি দৃশ্যমান ছাত্র-জনতার সমর্থন নিয়ে এসেছে।

সমকাল: সেনাবাহিনীর ভূমিকার মধ্যেও বোধহয় পার্থক্য রয়েছে।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: সেবার সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল অ্যাকটিভ; এবারের ভূমিকা রেসপন্সিভ। সেবারের পরিবর্তনে সেনাবাহিনী নেতৃত্ব দিয়েছে; এবার নেতৃত্ব দেয়নি বা দিতে চাচ্ছে না বা দেওয়ার পরিস্থিতি নেই। এবার তারা শুধু পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে।

সমকাল: নাগরিকদের আকাঙ্ক্ষার দিক থেকে দুই পরিস্থিতির মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখেন?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: আগেরবার আকাঙ্ক্ষার দিক থেকে প্রচলিত বিষয়াদি সামনে ছিল। নির্বাচন, ভোটার তালিকা, দুর্নীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি। এবার রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কাঠামো পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা বেড়েছে। সেই অর্থে সমাজে এক ধরনের পরিপক্বতা দেখা যাচ্ছে। তারা বুঝতে পেরেছে, টোটকা ওষুধে কাজ দেবে না। আরেকটু গভীরে গিয়ে কাঠামোগত চিকিৎসা লাগবে। সংস্কার শব্দটি আবার জনপ্রিয় হয়েছে।

সমকাল: কাঠামোগত চিকিৎসা বলতে কী বোঝাচ্ছেন?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: যেমন– সংস্কার চাই। কিন্তু সংস্কারের সাংবিধানিক ব্যাকরণ কী হবে, পরিধি কী হবে, কর্মপদ্ধতি কী হবে, নেতৃত্ব কে দেবে, মূল্যায়ন কে করবে ইত্যাদি। উপরন্তু সংস্কার প্রক্রিয়ার ভেতরের জবাবদিহি কে নিশ্চিত করবে; আস্থাভাজন জনপ্রতিনিধির অনুপস্থিতিতে জনগণের প্রকৃত প্রত্যাশা কীভাবে প্রতিফলিত হবে; নাগরিক সম্পর্ক কী ভূমিকা রাখবে; সেই সংস্কার কীভাবে বৃহত্তর গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভেতরে স্থাপিত হবে– এগুলো।

সমকাল: অনেক বেশি বিষয় টেবিলে তুলতে গিয়ে সরকারের গণতান্ত্রিক বৈধতার প্রশ্ন কি উঠতে পারে?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: অভিজ্ঞতায় দেখেছি, অনির্বাচিত সরকার নিয়ে আসার ক্ষেত্রে মানুষের আকাঙ্ক্ষা যত তীব্র হোক না কেন; একটা সময়ের পরে তার গণতান্ত্রিক বৈধতার প্রশ্নটি সামনে আসেই। ওয়ান ইলেভেন সরকার দুই বছর মেয়াদ শেষ করে দ্রুত বের হয়ে গেছে অনেকটা সেই প্রশ্নের মুখে পড়েই। তাই এ ধরনের সরকার অনির্বাচিত হলেও অবৈধ নয়। কারণ ওয়ান ইলেভেন সরকার বা এখনকার সরকার যে সংবিধানের ১০৬ ধারাবলে বৈধ– সেই রায় সুপ্রিম কোর্টই দিয়েছেন। কিন্তু মেয়াদ দীর্ঘায়িত হতে থাকলে গণতান্ত্রিক বৈধতার প্রশ্নটি জোরালো হতে থাকে।

সমকাল: ওয়ান ইলেভেন সরকারের অগ্রাধিকারের এক নম্বরে ছিল সুষ্ঠু নির্বাচন।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: সে জন্যই তো দুই বছরের মধ্যে সুষ্ঠু ভোটার তালিকা, এনআইডি কার্ড তৈরির বিষয়টিকে তারা অগ্রাধিকার দিয়ছিল। দুই বছরের মধ্যেই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করার বিষয়কে তারা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছিল। তবে সংস্কার, দুর্নীতি দমন ও রাজনৈতিক সংস্কারের বিষয়ও ছিল, যা পরে বিপথগামী হয়।

সমকাল: নির্বাচন এবারের সরকারের অগ্রাধিকার তালিকার কত নম্বরে রয়েছে?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: এবার কয় নম্বরে আছে, আমি জানি না। তবে এটা ন্যূনতম লক্ষ্য। কিন্তু দেখছি যে অন্যান্য আকাঙ্ক্ষা অগ্রাধিকার তালিকার ওপরের দিকে উঠে এসেছে। এটাকে আমি বলব সামাজিক পরিপক্বতার লক্ষণ। নির্বাচন দিয়ে শাসক বদল করলেই যে সুশাসন আসে না– এ ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতা হয়েছে। যুবসমাজ যথার্থই বলছে যে, আবার যেন পুরোনো পরিস্থিতি না হয়। যে যে আচরণের জন্য বিগত সরকারকে বিদায় দেওয়া হয়েছে, আগামী সরকার এসে যদি সেই আচরণই করে, তাহলে লাভ কী হলো? এ বদল করে বি বা সি এনে লাভ কী?

সমকাল: কাঠামোগত পরিবর্তনের জন্য পর্যাপ্ত সময় কি পাওয়া যাবে?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: সেই ঝুঁকি রয়েছে। কারণ বাঙালি একটু ছটফটে জাতি। বিস্মৃতিপরায়ণ জাতি। যে বাঙালি আপনাকে আজকে কোলে তুলে উল্লাস করছে, সেই বাঙালি আগামীকাল হয়তো পদদলিত করে ফেলবে। এই জাতির উচ্ছ্বাস ও হতাশা দুটোই দ্রুত আসে।

সমকাল: এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় নতুন সরকার কী করতে পারে?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: নতুন সরকারকে আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তবতা ও সক্ষমতার সামঞ্জস্য রাখতে হবে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে হবে। কেউ কেউ বলছেন, এই সরকার তিন বা পাঁচ বছর থাকবে। অসম্ভব! গণতান্ত্রিক বৈধতা ব্যতিরেকে একটি সরকার তিন বা পাঁচ বছর থাকার কোনো সুযোগ নেই। যারা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই সরকার এনেছে, সেই জনগণই রাজি হবে না।

সমকাল: গণতান্ত্রিক বৈধতার চেয়েও বড় প্রশ্ন, একটি বড় রাজনৈতিক দল ক্ষমতার ঘরে ঢোকার জন্য ১৮ বছর ধরে অপেক্ষা করছে। তাদের আপনি কতক্ষণ দরজায় দাঁড় করিয়ে রাখতে পারবেন?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: সে তো বটেই। বিএনপি তো অপেক্ষায় আছেই। সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগও তাড়াতাড়ি নির্বাচন চায় বলে ইতোমধ্যে ইঙ্গিত দিয়ে ফেলেছে। এ ক্ষেত্রে অনেক দেশে যেটা করে, সেই গণভোট দিতে পারে। আমাদের দেশেও একবার গণভোট হয়েছিল।

সমকাল: আমাদের দেশে আসলে তিনবার গণভোট হয়েছিল। জিয়াউর রহমানের শাসন নিয়ে, এইচএম এরশাদের শাসন নিয়ে এবং রাষ্ট্রপতি শাসিত পদ্ধতি থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে যাওয়ার প্রশ্নে।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: তিনবার হয়েছিল নাকি! তাহলে তো ভালো, আমাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে। এই গণভোটের মাধ্যমে সরকার কিন্তু গণতান্ত্রিক বৈধতা পেতে পারে। গণভোটের ভেতরে সরকারের মেয়াদকাল ছাড়াও কিছু সুনির্দিষ্ট সাংবিধানিক বিষয় থাকতে পারে। যেমন– সরকারপ্রধান দুই মেয়াদের বেশি থাকতে পারবেন না; সংসদে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি; রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য; স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ; রাজনৈতিক দলের ভেতরে গণতন্ত্র চর্চা; জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো ইত্যাদি।

সমকাল: গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া সংগঠনের নামটাও নিশ্চয় সংস্কারের ক্ষেত্রে বিবেচনাযোগ্য– বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: ছাত্ররা যে সর্বক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করার কথা বলছে, সেটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এর মধ্যে আসলে মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার প্রতিফলিত। এখন দেখতে হবে, কোথায় কীভাবে বৈষম্য দূর করা যায়। নতুন সরকারকে অংশীজন নিয়ে এসব বিষয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে কাজ করতে হবে।

সমকাল: ওয়ান ইলেভেনের সময় সেনাবাহিনী ছিল চালকের আসনে। এবার নাগরিক সমাজকে চালকের আসনে দেখা যাচ্ছে।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: আপনি কি সেটাই মনে করছেন?

সমকাল: আমি আপনার পর্যবেক্ষণ জানতে চাইছি।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: দেখুন, এটা সত্য যে উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়েছে। সেখানে বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান, মানবাধিকারবিষয়ক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। অ্যাডভোকেসি এনজিও, বাস্তবায়নকারী এনজিওর প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। যেসব ব্যক্তি আছেন, তারা নিঃসন্দেহে স্বনামখ্যাত। কিন্তু প্রতীকী প্রতিনিধিত্ব এবং প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব বা কার্যকর পরিবর্তনের সংহত শক্তি– দুটো ভিন্ন বিষয়। পরিবর্তনের জন্য যে অনবরত সংঘবদ্ধতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার চালিকাশক্তি থাকতে হয়, সেটা দৃশ্যমান হতে হবে।
সেটা বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদের আছে, দেখার অপেক্ষায় আছি। কিন্তু সামনের দিনগুলোতে প্রতীয়মান হতে হবে। আরেকটি বিষয় আছে। জনমানুষের কথা বলে ক্ষমতার অংশীদার হওয়া এক জিনিস, আর সেগুলো পরিপালন করার ক্ষেত্রে প্রতিমুহূর্তে জবাবদিহির মুখোমুখি হওয়া আরেক জিনিস।

সমকাল: সেই জবাবদিহি ব্যবস্থা কেমন হতে পারে?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: দেখুন, এই সরকার ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ভেতর দিয়ে আমাদের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন নিয়ে গঠিত হয়েছে মাত্র কয়েক দিন হলো। এই সরকারকে ভেতরে-বাইরে জবাবদিহির মধ্যে রাখার ক্ষেত্রে যেসব উদ্ভাবনী ব্যবস্থা থাকা উচিত, সেগুলো এখনও আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। বিষয়গুলো স্পষ্ট হওয়ার জন্য সময় দেওয়া উচিত। আবার এটাও ঠিক, প্রথম থেকেই জবাবদিহির একটি রূপরেখা থাকতে হবে। বেশি দেরি করলে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা ক্ষুণ্ন হবে।

সমকাল: জবাবদিহির রূপরেখার মধ্যে কী থাকতে পারে? কোনো উদাহরণ দিতে পারেন?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: যেমন মিডিয়া কী ভূমিকা পালন করবে, মিডিয়ার ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে। যেমন নাগরিক সমাজে থাকা সহকর্মীদের ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে। ব্যক্তি খাতে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সুবিধাভোগী একটি গোষ্ঠী ছিল। তাদের জায়গায় ব্যক্তি খাতের নতুন যে গোষ্ঠী নেতৃত্ব নেবে, তারা কী ভূমিকা পালন করবে। উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে আগের সরকারের যেসব অঙ্গীকার রয়েছে, সেগুলোর কী হবে। এসব বিষয় এখনও অস্পষ্ট রয়ে গেছে। এগুলো ক্রমান্বয়ে এবং দ্রুততার সঙ্গে স্পষ্ট করতে হবে। মাঠ পর্যায়ে চর দখলের যে প্রবণতা দেখি তা চিন্তিত করে।

সমকাল: স্পষ্ট করার প্রক্রিয়াটা কেমন হতে পারে?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: আমার প্রত্যাশা থাকবে, এসব বিষয় পরিষ্কার করার ক্ষেত্রে নতুন নেতৃত্ব অন্তর্ভুক্তিমূলকভাবে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে, পরামর্শ করার মাধ্যমে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। সবটার জন্যই যে তৈরি সমাধান রয়েছে, এমন নয়। ভবিষ্যৎমুখী সংলাপ ও গঠনমূলক বিতর্ক দরকার।

সমকাল: নতুন সরকারের সময় সিভিক স্পেস বা নাগরিক পরিসর কি প্রশস্ত হবে?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: নাগরিক সমাজের কাজের ক্ষেত্রে সরকার আরোপিত যে প্রতিবন্ধকতা ছিল, তা কিছুটা দূর হবে বলে মনে হয়। কিন্তু এই সুযোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা সক্ষমতা রাখি কিনা, সেটা ভাবার বিষয়। আমি মনে করি, সিভিক স্পেস বাড়ানোর ক্ষেত্রে যতখানি না নিয়ন্ত্রকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, গ্রহীতাদের সক্ষমতার ভূমিকা তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সিভিক স্পেস যারা বাড়াতে চান, তাদের উদ্যোগ, সক্ষমতা, সাহসিকতা, চিন্তার উদ্ভাবনী শক্তি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অংশীজনের নাগরিক পরিসর থাকলেই যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেটা ব্যবহৃত হবে, এমন নয়।
নাগরিক পরিসর বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, এখন নাগরিক সমাজকে তাদের সক্ষমতা দেখাতে হবে। যেহেতু প্রথাগত রাজনৈতিক শক্তির একটি অংশ দুর্বল হয়ে গেছে, সেহেতু জনগণের কণ্ঠস্বর হিসেবে, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ করার ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজের ভূমিকা আগের চেয়ে অনেক বাড়বে। এ কথা যখন বলি, তখন তাদের কৌশলগত সহযোগী মিডিয়ার ভূমিকার কথা কম করে বলার সুযোগ নেই।

সমকাল: গণঅভ্যুত্থানকালে মিডিয়ার ভূমিকা কেমন দেখেছেন?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: গণতান্ত্রিক উত্তরণকালে মিডিয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছে। সীমিত সুযোগ নিয়েও মিডিয়া বড় ভূমিকা পালন করেছে বলে আমি মনে করি। ক্ষমতাচ্যুতির আগে সরকারের সরাসরি সমালোচনা করতে না পারলেও প্রতিদিন কতজন নিহত হলো, কোথায় কীভাবে নিহত হলো– এগুলো পরিবেশন করে অভিনবত্ব দেখিয়েছে।
তবে কিছু মিডিয়ার ভূমিকা তাদের জনবিদ্বেষী চরিত্র প্রকাশ করেছে।

সমকাল: নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান বা ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময় নাগরিক সমাজের উৎসাহ বা পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া দেখা গেছে। এবার…

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: স্মরণ করাতে চাই, নাগরিক সমাজের দিক থেকে কখনও রাজনৈতিক দল গঠনের আকাঙ্ক্ষা দেখা যায়নি। নাগরিক সমাজের ব্যক্তিবিশেষের উৎসাহ থাকতে পারে। সেটা তো বাংলাদেশের যে কোনো নাগরিকই করতে পারেন। যে কোনো নাগরিক রাজনৈতিক দল গঠন বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে পারেন। সেটা নাগরিক সমাজের সামষ্টিক কোনো অবস্থান নয়। এ দুটো বিষয় আপনাকে আলাদা করে দেখতেই হবে।

সমকাল: এবার কী হবে, নাগরিক সমাজের কেউ কি রাজনৈতিক দল গঠনে আগ্রহী হতে পারেন?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: বিষয়টি সম্পর্কে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। তবে যেদিন নাগরিক সমাজের কেউ রাজনৈতিক দল গঠন করবেন বা কোনো দলে যোগ দেবেন, সেদিন থেকে তিনি নাগরিক সমাজের কেউ নন। সেদিন থেকে তিনি রাজনৈতিক সমাজের অংশ। সেদিন থেকে তাদের দায়দায়িত্ব রাজনৈতিক সমাজের; নাগরিক সমাজের নয়।

সমকাল: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারে?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: তারা যদি দল গঠন করতে চায়, করবে। একাধিক দলও হতে পারে। এতে বাংলাদেশের রাজনীতি আরও পুষ্ট হবে। এর আগেরবার কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্ব তো একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছে। আমি তো তরুণদের প্রতিভা ও অভিজ্ঞতা রাজনীতিতে বিনিয়োগের পক্ষে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের একটি অংশ তো সরকারেরও অংশ হয়েছে। সেটা তাদের রাষ্ট্র পরিচালনায় অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই বাড়াবে। একই সঙ্গে সরকারের বাইরে যে রাজনৈতিক দলগুলো আছে, আগামী নির্বাচনেও তারা অংশ নিতে পারে। আমার উৎসাহ থাকবে নতুন নেতৃত্ব দেখার।

সমকাল: সরকারের আগামী পথ কেমন দেখছেন?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: বিপ্লব করা কঠিন, কিন্তু তার চেয়েও বেশি কঠিন রাষ্ট্র পুনর্গঠন ও পরিচালন। এই উপলব্ধি ক্রমান্বয়ে আমাদের মধ্যে ঢুকবে। নতুন টেনশন সৃষ্টি করবে। ইংরেজিতে বলে, ‘সিঙ্ক’ করবে। আমরা এখনও ইউফোরিয়ার মধ্যে আছি। ইউফোরিয়ার বাংলা কী?

সমকাল: উচ্ছ্বাস।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: আমরা এখনও উচ্ছ্বাসের মধ্যে আছি। ক্রমান্বয়ে বাস্তবতার সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ ঘটবে। সেটা দ্রুতও ঘটতে পারে। সেই সময়ে উদ্ভাবনী শক্তি, নেতৃত্ব, সক্ষমতা, জনসম্পৃক্ততা– এগুলো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। উচ্ছ্বাসে ভেসে না গিয়ে বাস্তবতা অনুধাবনের চেষ্টার মধ্যেই বিজ্ঞতা প্রকাশ পাবে। বাস্তবতার সঙ্গে সামনের দিনগুলোতে নতুন সরকার কামিয়াব হোক, সেটাই প্রত্যাশা করি।

সমকাল: শেষ করি এই প্রশ্ন দিয়ে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে আপনিও থাকছেন– এমন আলোচনা সামাজিক মাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমে ব্যাপকভাবে দেখা গেছে। কিন্তু পরে দেখা গেল, আপনি নেই। চাইলে এ প্রশ্নের উত্তর নাও দিতে পারেন।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: সরকার মানে তো শুধু কয়েকজন উপদেষ্টা নয়। বুঝতে পেরেছেন?

সমকাল: বুঝতে পেরেছি, সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: আপনাদেরও ধন্যবাদ।