Published in সমকাল on Friday 3 July 2020
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সিপিডি কোভিড-১৯-পরবর্তী অনেকগুলো প্রাক্কলন প্রদান করেছে। সেসব প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক সংস্থার মধ্যে বিশ্বব্যাংক প্রথমদিকে বলেছিল বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি তিন থেকে পাঁচ শতাংশের মধ্যে হবে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক সেটিকে আরও নিম্ন সমন্বয় করে এক দশমিক পাঁচ শতাংশের কথা বলেছে। এ ছাড়া আইএমএফের পক্ষ থেকে তিন থেকে চার শতাংশের কথা বলা হয়েছে ২০২১ সালের জন্য। সিপিডি থেকে আমরা বলেছি, এটা আড়াই শতাংশের মতো হতে পারে। এখান থেকে সহজেই অনুমেয় যে, প্রবৃদ্ধির নিম্ন পর্যায়ে শেষ হবে চলতি বছরটি।
২০২১ সাল নিয়েও শুরুর দিকে যেভাবে আন্তর্জাতিক প্রাক্কলনগুলো করা হচ্ছিল, সেই প্রাক্কলনে অনুমিত ছিল বাংলাদেশে কোভিড-১৯-এর খুব বেশি সংক্রমণ হবে না। বাংলাদেশ দ্রুতই হয়তো কভিড সংক্রমণ থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে আশঙ্কা হচ্ছে, বাংলাদেশে কভিডের সংকট দীর্ঘকালীন হতে পারে। এর ফলে চলতি বছরের যে পরিস্থিতি, আগামী বছরে তা থেকে কতটুকু উন্নয়ন হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন জাগছে। বিশ্বব্যাংক থেকে বলা হয়েছিল, এই বছরের মতো আগামী বছরও বাংলাদেশের জন্য স্বল্প প্রবৃদ্ধির বছর হবে।
আইএমএফ থেকে বলা হয়েছিল, ২০২১ সালে বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধিতে আগের মতো ফিরে আসবে। সম্প্রতি এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের প্রধান বলেছেন যে, বাংলাদেশের এখনও সুযোগ রয়েছে প্রবৃদ্ধিতে ফিরে আসার। এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা ও স্বাস্থ্য পরিস্থিতি কত দ্রুত স্বাভাবিক করা যায় এটার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন তিনি। এক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখা দরকার, বিদায়ী অর্থবছরে সবচেয়ে স্বস্তিদায়ক ছিল আমাদের কৃষি খাত। কৃষি খাতে অব্যাহত উৎপাদন, বড় কোনো দুর্যোগ না থাকার কারণে কৃষি খাতের প্রধান উৎপাদন বোরো ধান ভালোভাবে সংরক্ষণ করা গেছে। অন্যান্য ফসলের উৎপাদনও ভালো হচ্ছে। আমদানিনির্ভর পণ্যের আমদানি যদি আগামী বছর অব্যাহত থাকে এবং দেশীয় উৎপাদনও ঠিক থাকে তাহলে ২০২১ সালেও কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে স্বস্তিদায়ক অবস্থায় থাকবে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে নিম্ন আয়ের মানুষ আয় হারাচ্ছেন। ব্র্যাক থেকে বলা হয়েছে, ৯৫ শতাংশ মানুষ আয় হারাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারাও বড় সাফল্য বলে গণ্য হবে। বড় কোনো দুর্যোগ না হলে ২০২১ সালেও আমরা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারব। কৃষি আমাদের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ, বাকি ৮৫ শতাংশ অকৃষিনির্ভর। সেই জায়গাটিতে আমাদের লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, কৃষির বাইরে অর্থনীতির অন্য যে বড় খাত ও উপখাত রয়েছে আগামী বছর সেগুলো কতটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।
এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় খাত হলো সেবা খাত। কিন্তু মনে রাখা দরকার, অন্যান্য খাতের ওপর নির্ভর করে সেবা খাতের বিস্তার বা সাফল্য নির্ভর করে। সেক্ষেত্রে যদি তৈরি বা ম্যানুফেকচারিং অথবা কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে লক্ষণীয় উন্নয়ন না হয় বা মানুষের আয় বৃদ্ধি না পায় তাহলে সেবা খাতে বড় রকমের উন্নতি প্রত্যাশা করা সঠিক হবে না। উপরন্তু সেবা খাতের ভেতরে পরিবহন খাত, স্বাস্থ্য খাত, ট্রেডিং এগুলো কিন্তু ভোক্তার সঙ্গে সরাসরি লেনদেননির্ভর। করোনার কারণে আমরা যে স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়েছি তাতে ভোক্তার পক্ষে সরাসরি সেবা গ্রহণ দুরূহ হয়ে গেছে। ভোক্তা এখন সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে অনেকটাই কুণ্ঠিত। ফলে বিভিন্ন খাত যেমন- হোটেল, রেস্টুরেন্ট, পরিবহন, পর্যটন, শপিংমল, বিনোদন পার্ক এগুলো সহসাই স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরে আসবে বলে মনে হয় না। উপরন্তু মানুষের আয় কমে যাওয়ায় জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সেবা গ্রহণে উৎসুক হবে না। ফলে সেবাজনিত ব্যয়ও কমে যেতে পারে। ফলে সেটিও আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখবে।
সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় অংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের মাঝারি ও ছোট উদ্যোক্তা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ এ ধরনের আর্থিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিতদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির জন্য সহসাই তাদের ব্যবসার উন্নতি হবে না। ব্যবসার উন্নতি না হলে তারাও হয়তো বাধ্য হয়ে শহর ছেড়ে পেশা পরিবর্তন করে গ্রামাঞ্চলের কৃষিতে বা স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থান খোঁজার চেষ্টা করবে। ইতোমধ্যে এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজেও এ ধরনের উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীর প্রাপ্য কম। বিশেষ করে এসএমইর জন্য সরকারের যে ২০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ রয়েছে অথবা ৩০ হাজার কোটি টাকার যে প্যাকেজ বড় ও মাঝারি আকারের শিল্পের জন্য রয়েছে সেখানেও এ ধরনের উদ্যোক্তাদের প্রাপ্তির সুযোগ সীমিত। ফলে তারা যে ঋণ নিয়েও সহসাই কাজে ফিরে আসতে পারবেন, এমনটিও বলা কঠিন। উপরন্তু এসএমই খাতে যে বাজেট তা ৪-৫ শতাংশ চাহিদা মেটাতে পারবে বলে সিপিডির গবেষণায় উঠে এসেছে। ফলে সেবা খাতের উদ্যোক্তারাও সমস্যার মধ্যে পড়বেন।
এর বাইরে কর্মসংস্থানের উদীয়মান খাত বলে পরিচিত খাতে যারা জড়িত তাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দেশীয় বাজারনির্ভর যেসব ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাকটিভিটি তার ওপরে। দেশীয় বাজারে ভোক্তা যদি পণ্য ক্রয় না করে তাহলে উৎপাদনে সহসাই তরণ আসবে না। ফলে দেশীয় বাজারনির্ভর প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে উদ্যোক্তারা লোকসানের মুখে পড়েছেন। এ ধরনের উদ্যোক্তাদের জন্য আগামী অর্থবছরটি চ্যালেঞ্জিং হবে। এর বাইরেও রপ্তানিমুখী খাত যেগুলো রয়েছে সেগুলোরও উৎপাদন, কর্মসংস্থান দ্রুত ফিরে আসবে না। কারণ এসব পণ্যের মূল ক্রেতা দেশগুলো করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওইসব দেশে লকডাউনের কারণে বেকারত্ব বেড়েছে, ফলে এখনও তাদের ক্রয়ের সক্ষমতা ফেরত আসেনি। সেখানে এখনও দোকানপাট খোলা হচ্ছে না।
সরকার প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে রপ্তানিমুখী খাতগুলোকে সুবিধা দিচ্ছে, তাদের পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ দেওয়া হয়েছে। ৩০ হাজার কোটি টাকার আরেকটি বড় প্যাকেজ দেওয়া হয়েছে ঋণের জন্য। এর বাইরে রপ্তানি উন্নয়ন ফান্ড থেকে দেড় বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত দেওয়া হয়েছে। তাদের বিভিন্ন ধরনের ইপিসিটি সার্ভিস পে করার সময়কাল বৃদ্ধি করা হয়েছে। ঋণ ফেরতের সময়কাল বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের ভ্যাট-ট্যাক্স পরিশোধের সময়ও বৃদ্ধি করা হয়েছে। এতসব মিলিয়ে উদ্যোক্তাদের এখনকার যে ক্যাশ সংকট যাচ্ছে তাতে সহায়তা হচ্ছে। তাদের ঋণ দিয়ে শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকেও শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এগুলো দিয়ে উদ্যোক্তারা হয়তো তাদের আপৎকালীন চাহিদা মেটাতে পারবেন কিন্তু দীর্ঘকালীন ভিত্তিতে ক্রয়াদেশ না এলে তাদের জন্য নতুন করে উৎপাদনে যাওয়া কষ্টকর হবে। ফলে আগামী ছয় মাস সময়কালেও আমরা এক ধরনের অনিশ্চিত অবস্থা দেখতে পাচ্ছি রপ্তানিমুখী খাতে। সুতরাং এই পরিস্থিতিতে আগামী বছরটি যে এ বছরের তুলনায় খুব বেশি পরিবর্তন হতে পারবে, এখন পর্যন্ত তা মনে হচ্ছে না।
এই পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষে বাজেট বাস্তবায়ন, রাজস্ব আহরণ এবং শিল্প খাতে নতুন কর্মসংস্থান বা বিনিয়োগে সহায়তার জন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন- এগুলো কষ্টকর হবে। কারণ সরকারের হাতেও অর্থের সংকট রয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সীমিত বাজেট দিয়ে হয়তো সরকারকে আগামী অর্থবছর বাস্তবায়ন করতে হবে। তার মাধ্যমে যথেষ্ট পরিমাণে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বিনিয়োগে তরণ আনা এবং শিল্প খাতে উৎপাদনে ভূমিকা রাখাও সীমিত পর্যায়ে হতে পারে। মোট কথা, আগামী বছরটিও চলতি বছরের থেকে ভিন্নতর হবে না। তাত্ত্বিকভাবে দেখা যায়, যদি স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে তাহলে আমাদের মতো অর্থনীতির দেশগুলো দ্রুত পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসতে পারে। কিন্তু এখনকার যে চিত্র তাতে সময়কালটি আরও দীর্ঘায়িত হবে। মনে রাখা দরকার, স্বাস্থ্যঝুঁকি বজায় রেখে আমাদের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সহজ হবে না।
সুতরাং আগামী অর্থবছর আমাদের প্রবৃদ্ধির জন্য চ্যালেঞ্জিং হবে। সেই জায়গা থেকে আমরা মনে করি, সরকারের ভেতরেও যেন কোনো আত্মতুষ্টি কাজ না করে। স্বাস্থ্যঝুঁকি মাথায় রেখেই আমাদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করতে হবে এবং আগামী অর্থবছরে যদি সীমিতভাবেও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার করা যায়, তাতে যদি কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ এবং উৎপাদনমুখী খাতগুলো কাজে ফিরে আসে ও স্বাস্থ্যঝুঁকি যদি কমে আসে তা-ই আমাদের জন্য বড় সাফল্য হবে।
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)