Originally posted in খবরের কাগজ on 15 December 2025
সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই বাজার
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সিন্ডিকেট এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যের কারণে পণ্যের দামের লাগাম টানা যাচ্ছে না। সিন্ডিকেট পরিকল্পিতভাবে দাম বাড়িয়ে চলেছে। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে আসন্ন রমজানে পণ্যের দাম কোথায় ঠেকবে তা বোঝাই যাচ্ছে। তাই রোজায় বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারকে কঠোর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
বাজার বিশ্লেষকরা বলেছেন, সম্প্রতি ব্যবসায়ীদের দাবির কাছে নতিস্বীকার করে সরকার ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়েছে। অন্যদিকে আমদানি করা পেঁয়াজ বাজারে এখনো বিক্রি শুরু হয়নি। শুধু আমদানির অনুমতি দেওয়ার পর দাম কিছুটা কমে উচ্চমূল্যেই স্থির হয়ে আছে, যা দাম বাড়ানোর সঙ্গে সিন্ডিকেট জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণ করে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি সাবেক সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান খবরের কাগজকে বলেন, কিছু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন। সরকার পরিবর্তন হলেও সিন্ডিকেটের দাপট কমে না। এরা সমাজের ক্ষমতাবান ব্যক্তি। পণ্য আমদানি, মজুত, পাইকারি বাজার ও খুচরা বাজার– সব জায়গায়ই তাদের নিজের মানুষ আছে। এসব মানুষ দিয়ে কৌশলে পণ্যের দাম বাড়ানো হয়। সিন্ডিকেট সরকারের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অনৈতিক সুবিধা দিয়েও নিজেদের উদ্দেশ্য পূরণ করে। এসব করে নিজেদের পকেট ভারী করে। সিন্ডিকেটকে ভেঙে দিতে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে।
তিনি আরও বলেন, ব্যবসায়ীরা ভোজ্যতেলের দাম বাড়াতে সরকারকে চাপ দেন। সরকার রাজি না হওয়ায় তারা ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে বিক্রি করা শুরু করেন। সরকার বাধা দিলেও কাজ হয় না। শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের দাবি মেনে সরকার দাম বাড়াতে বাধ্য হয়।
একই মন্তব্য করে অর্থনীতির আরেক বিশ্লেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, প্রতিবছর দেখা যায়, রোজার দুই-তিন মাস আগে থেকে সিন্ডিকেটের সদস্যরা তৎপর হন। রোজায় পণ্যের সরবরাহ বাড়াতে ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে থাকেন। এসব সুবিধার মধ্যে আমদানিতে রাজস্ব ছাড় দেওয়া হয়। এতে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে। তাই সরকারকে বাজার নিয়ন্ত্রণে আরও কঠোর হতে হবে।
কয়েক মাস ধরেই ভোজ্যতেলের মূল্য বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন ব্যবসায়ীরা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো হবে না স্পষ্ট জানিয়ে দেয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তকে তোয়াক্কা না করেই মিলমালিকরা এক লাফে বোতলজাত ভোজ্যতেলের দাম প্রতি লিটারে ৯ টাকা এবং খোলা তেল ৬ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করা শুরু করেন। এটা জানাজানি হলে বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দীন ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা সরকারের অনুমতি ছাড়া তেলের দাম বাড়িয়েছেন, যা আইনগতভাবে ঠিক নয়।’ এ সময় তিনি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও হুঁশিয়ারি দেন। ভোজ্যতেলের মিলমালিক ও বিক্রেতাদের অনেককে কারণ দর্শানোর নোটিশও দেন। কিন্তু ব্যবসায়ীরা তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের দাবি মেনে ভোজ্যতেলের দাম লিটারে ৬ টাকা বাড়ানোর অনুমতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ খবরের কাগজকে বলেন, কয়েক দিন আগেই বাজার সিন্ডিকেটের হোতারা সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে না জানিয়েই সয়াবিন তেলের দাম লিটার প্রতি ৯ টাকা বাড়িয়ে বাজারে বিক্রি শুরু করেন। সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা গণমাধ্যমে বলেছেন এ ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না। তাহলে প্রশ্ন দেশটা চালায় কারা? সরকার নাকি, মুনাফাখোর সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা?
তিনি বলেন, আমদানিকারক, বাজারজাতকারীদের অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে সভা করে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটার প্রতি ৬ টাকা, খোলা সয়াবিন তেলের দাম লিটার প্রতি ৭ টাকা এবং পামঅয়েলের দাম লিটার প্রতি ১৬ টাকা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত দিয়েছে সরকার। এর মাধ্যমে প্রমাণ হয় মুনাফাখোর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের ওপর সরকার অনুমোদনের সীলমোহর মারতে বাধ্য হয়েছে।
অন্যদিকে পেয়াজের দাম বেড়ে প্রতি কেজি ১৬০ পর্যন্ত হয়। পেঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুত আছে এমন তথ্য জানিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকরা দাম বাড়ার কারণ হিসেবে সিন্ডিকেটকে দায়ি করেন।
গত ৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারি বাজারে পেঁয়াজের সর্বোচ্চ দাম ছিল। প্রতিকেজি পুরোনো দেশি পেঁয়াজ ১১৫ থেকে ১২০ টাকায় এবং মুড়িকাটা পেঁয়াজ ১০০ থেকে ১০৫ টাকায় বিক্রি হয়। এই দিন রাতে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে আদেশ জারি করে পরের দিন ৭ ডিসেম্বর থেকে সীমিত আকারে পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দেয়। এই খবর আসার পর ওই দিনই সকাল থেকে পাইকারিতে পেঁয়াজের দাম কেজিপ্রতি ২৫-৩০ টাকা কমে যায়।
ক্যাবের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন খবরের কাগজকে বলেন, আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে, আমদানি করা পেঁয়াজ বাজারে আসতে কমপক্ষে ১৫ দিন লাগবে। এখনো পেঁয়াজ আমদানিই হয়নি। শুধু আমদানির অনুমতি দিয়েছে তাতেই দাম কমে গেল। বিষয়টা হাস্যকর। এখানে ব্যবসায়ীদের কারসাজি প্রমাণিত।
তিনি বলেন, সরকার পেঁয়াজ আমদানি করতে চায়নি। দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজ বাজারে এলে দাম কমবে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু পেঁয়াজের দাম এত বেড়ে যাচ্ছিল যে আমদানির অনুমতি দিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু কী লাভ হলো? সেই সিন্ডিকেট তো এখনো পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। দাম কমছে না। তাহলে কি বাজার সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে?
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু খবরের কাগজকে বলেন, আর্ন্তজাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়েছে। এ জন্য দেশের বাজারে দাম কিছুটা বাড়বে এটা ঠিক। কিন্তু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট দাম যা বাড়ার কথা বিভিন্ন অজুহাতে তার চেয়ে কয়েক গুণ বাড়িয়ে বিক্রি করে। সরকারকে আরও কঠোরভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। রোজার আগে সিন্ডিকেটের তৎপরতা আরও বেড়ে যায়। আসন্ন রোজায় দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে এখন থেকে সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষভাবে ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতাদের নিয়ে বসে দাম নিয়ন্ত্রণের কৌশল ঠিক করে বাস্তবায়নে যেতে হবে।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি। যে বা যারা সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকবে তাদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আসন্ন রোজা সামনে রেখে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে এখন থেকেই কাজ শুরু করেছি।’



