Originally posted in বণিক বার্তা on 4 November 2024
বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বর্তমানে সর্বাধিক আলোচিত বিষয়। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখা এবং টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এখানে দীর্ঘদিন ধরে মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী।
বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বর্তমানে সর্বাধিক আলোচিত বিষয়। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, ক্রয়ক্ষমতা ধরে রাখা এবং টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এখানে দীর্ঘদিন ধরে মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী। সেপ্টেম্বর ২০২৪-এ পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ এবং খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৪০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে (মাসিক অর্থনৈতিক প্রবণতা, বাংলাদেশ ব্যাংক)। যার ফলে অতিমাত্রায় মূল্যস্ফীতির চাপে রয়েছে নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ।
এ অনিয়ন্ত্রিত মূল্যস্ফীতির জন্য প্রধানত দায়ী বিগত সরকার। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতির মতো মৌলিক পদক্ষেপ না নেয়া এবং কার্যকর নীতি গ্রহণে কালক্ষেপণ করার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি ক্রমে স্ফীত হয়েছে। এদিকে বর্তমানে বাজারদর কমার কোনো লক্ষণ না থাকায় অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের প্রত্যাশা দিন দিন বাড়ছেই। এরই মধ্যে আবার বাজারে মুদ্রা সরবরাহের লাগাম টেনে ধরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক আরেক দফা নীতি সুদহার বাড়িয়েছে।
আমাদের দেশের বাস্তব প্রেক্ষাপটে শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। কেননা যেখানে দুর্বল বাজার ব্যবস্থাপনা রয়েছে, সেখানে মুদ্রানীতি আশানুরূপভাবে প্রভাব রাখতে পারে না। এখানে অলিগোপলি আচরণ এবং বাজার কারসাজির মাধ্যমে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে স্বাভাবিক ভারসাম্য রক্ষায় বিঘ্ন ঘটানো হয়, যা বাজারদর অস্থিতিশীল করে তোলে। যে কারণে আমরা দেখেছি যে অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও মানুষকে বাড়তি দাম গুনতে হয়। অতিরিক্ত মুনাফা লাভে সরবরাহ শৃঙ্খলে এভাবে কৃত্রিম সংকট তৈরির জন্য সিন্ডিকেটকে দায়ী করা হয়। এ অবস্থায় মুদ্রানীতির কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে অসাধু, মুনাফালোভী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও অলিগোপলি বাজার ব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলা জরুরি, যেমনটা প্রয়োজন বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাড়ানো।
বিগত সরকারের আমলে স্থানীয় দলীয় ক্যাডারসহ সংগঠিত দলগুলোর চাঁদাবাজির ঘটনা এক ধরনের স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। উপরন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিভিন্ন জেলা থেকে বাজার অভিমুখী পণ্যবাহী যানবাহন থেকে চাঁদাবাজি করার ঘটনাও প্রচলিত ছিল। এর সঙ্গে ছিল বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, যা সরবরাহ শৃঙ্খলে কৃত্রিম ঘাটতি তৈরি করত। দুর্ভাগ্যবশত এ ধরনের অপকর্ম বন্ধ না হওয়ায় এখনো বাজারদর চড়া। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে দেশের বেশ কয়েকটি স্থানে ভয়াবহ বন্যার বিরূপ প্রভাব পড়েছে উৎপাদনে। বন্যাকবলিত অঞ্চলগুলো ব্যাপকমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা কৃষি উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটিয়েছে। এতে সরবরাহ শৃঙ্খলে তীব্র ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ফলস্বরূপ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আকাশচুম্বী হয়েছে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে আরো চাপের মুখে ফেলেছে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও ক্রমাগত ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া থেকে সাধারণ জনগণকে বাঁচাতে ও কিছুটা স্বস্তি দিতে হলে অন্তর্বর্তী সরকারকে অবশ্যই মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। স্বল্প ও মাঝারি মেয়াদে মুদ্রাস্ফীতি মোকাবেলা করতে নীতিনির্ধারকদের নিম্নোক্ত ১২টি বিষয় বিবেচনা করা উচিত মনে করি।
১. প্রকৃত প্রস্তাবে মূল্যস্ফীতি মোকাবেলা করতে রাজস্ব ও মুদ্রানীতির মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। বিগত অর্থবছরে দীর্ঘ সময় ধরে মুদ্রানীতি ছিল সম্প্রসারণমূলক। পাশাপাশি সরকারি ব্যয়ও ছিল বেশি। এছাড়া ব্যাংকগুলোর মন্দ ঋণ (এনপিএল) ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, যার একটি অংশ বাজারে প্রবেশ করে থাকতে পারে। উপরন্তু বিগত সরকার ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল ছিল। বিশেষ করে ২০২৩ সালের বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকারের বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা লক্ষণীয় ছিল। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের ঋণদাতা হয়ে পড়ায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফল হতে পারেনি। অতএব মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে শুধু সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নেয়া পর্যাপ্ত নয়। প্রকৃতপক্ষে মূল্যস্ফীতির ওপর এর প্রভাব দেখতে হলে রাজস্ব ও মুদ্রানীতির মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
২. আমদানীকৃত পণ্যের ওপর উচ্চ শুল্ককর কমানো বা প্রত্যাহার করা উচিত। কেননা এটি ভোক্তা পর্যায়ে দাম বাড়ায়। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার চালসহ কয়েকটি পণ্য থেকে এ ধরনের আমদানি কর কমিয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে এটা নিশ্চিত করতে হবে যেন আমদানি শুল্ক হ্রাসের সুবিধাভোগী হতে পারে ভোক্তারা। বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত কম থাকায় কর বিভাগ তার আমদানি কর ছাড়তে চায় না। কিন্তু কর আদায় বাড়ানোর এটি কোনো টেকসই সমাধান নয়। বরং কর প্রবৃদ্ধির জন্য কর ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রয়োজন। এতে সরকারের রাজস্ব বাড়তে পারে এবং রাজস্ব নীতি আরো টেকসই হবে বলে আশা করা যায়।
৩. সরকারের ব্যয়ের মান উন্নত করতে হবে এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ব্যয় করার দিকে মনোযোগী হতে হবে। জ্বালানি খাতে ভর্তুকি প্রদান একই সঙ্গে আর্থিক এবং জলবায়ু উভয় খাতের জন্য ক্ষতিকারক। বরং সরকারের সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজনে আরো অর্থ ব্যয় করতে হবে, যেহেতু দরিদ্র পরিবারগুলোয় ব্যয়ের একটি বড় অংশ যায় খাদ্যের জোগানে। তাছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতি তাদের আর্থসামাজিক অবস্থার অবনতি ঘটিয়েছে। এটি একদিকে অনেককে দরিদ্র করে তুলেছে এবং অন্যদিকে অনেককে দারিদ্র্যসীমার নিচে ঠেলে দিয়েছে। তাই ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি থেকে দরিদ্রদের সুরক্ষা দিতে ভর্তুকি ব্যবস্থা সংস্কারের মাধ্যমে সম্পদের পুনর্বণ্টন আবশ্যক। আর এ ধরনের সহায়তা যথাযথ বণ্টনের মাধ্যমে প্রকৃত অভাবীদের কাছে যাতে পৌঁছে, তাই অবশ্যই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
৪. টাকার মান স্থিতিশীল পর্যায়ে রাখতে দক্ষতার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা জরুরি। ইউএস ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশী টাকার অবমূল্যায়ন আমদানি ব্যয় বাড়িয়েছে, যা মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশী রফতানিকারকরা প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়িয়ে বেশি করে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করতে পারে, যা টাকার মান ধরে রাখতে সহায়ক হতে পারে। এছাড়া টাকার মান স্থিতিশীল করতে এবং আমদানি ব্যয়জনিত মূল্যস্ফীতি কমাতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে মূলধন পাচার রোধ।
৫. উন্মুক্ত বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রয় (ওএমএস) এবং খাদ্যবান্ধব উদ্যোগের মাধ্যমে খাদ্য বিতরণ কার্যক্রম উন্নত করতে হবে। একই সঙ্গে দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য নগদ অর্থ সহায়তা বাড়ানো উচিত।
৬. যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তাদের পণ্যের মূল্য নির্ধারণে স্বচ্ছতা বাড়ানোর ওপর মনোযোগ দেয়া দরকার। বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের (বিসিসি) একটি সমন্বিত ডাটাবেজ তৈরি করা উচিত, যেখানে সারা দেশে উৎপাদন কেন্দ্র থেকে বাজার পর্যন্ত পণ্যের দাম কত তা উল্লেখ থাকবে। বিসিসিকে অবশ্যই নিয়মিত বাজারে প্রভাব বিস্তারকারীদের ওপর নজর রাখতে হবে এবং বাজার কারসাজির ঘটনা তদন্তসাপেক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। কমিশনের উচিত সক্রিয়ভাবে বাজার প্রতিযোগিতায় বাধা সৃষ্টি করে এমন কর্মকাণ্ড, যেমন কারসাজি, একচেটিয়া ও অলিগোপলি অবস্থা প্রতিহত করা।
৭. যেহেতু সার্বিক মূল্যস্ফীতিতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখে, তাই উৎপাদন ও খাদ্যপণ্য সরবরাহ বাড়াতে আধুনিক কৌশল ও প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন ত্বরান্বিত করতে হবে। পাশাপাশি গ্রামীণ অবকাঠামো, যেমন রাস্তা ও মজুদ সুবিধা উন্নত করতে হবে যাতে ফসল উত্তোলন-পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতি কমানো যায় এবং দক্ষ সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা যায়। কারণ এগুলো খাদ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এছাড়া বাড়তি দামের সঙ্গে যেন কৃষকরা নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারেন সেজন্য কৃষি উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করা উচিত।
৮. মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরবরাহ শৃঙ্খল নির্বিঘ্ন রাখতে হবে। এর জন্য সংশ্লিষ্টদের দক্ষতা বাড়ানোসহ লজিস্টিক এবং পরিবহন পরিকাঠামোয় বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার।
৯. অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে সরকারের উচিত তার বাণিজ্য অংশীদারদের সংখ্যা বাড়ানো। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য যথাসময়ে আমদানি করলে তা সহসা সৃষ্ট সংকট মোকাবেলা করতে পারে, যা দাম বেড়ে যাওয়ার প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
১০. সরকারের উচিত কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্য মূল্যে পর্যাপ্ত ক্রয় নিশ্চিত করা। এটি দক্ষ বাজার ব্যবস্থাপনা, বাজারদরে স্থিতিশীলতা এবং কৃষকদের ন্যায্য মুনাফা লাভের নিশ্চয়তা দিয়ে মূল্যস্ফীতি সহায়ক হবে।
১১. উৎপাদক ও বাজারের মধ্যে সংযোগ উন্নত করতে হবে। যখন কৃষকরা সরাসরি বাজারের সঙ্গে জড়িত থাকবেন, তখন মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য প্রতিহত করা সম্ভব হবে। এতে কৃষকরা বাজারদরের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ মুনাফা পাবেন। এতে ভোক্তা পর্যায়েও দাম কমবে।
১২. ডিজিটাল প্লাটফর্ম, যেমন ই-কমার্স ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে ক্রেতাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগে সক্ষম করে তুলতে হবে। এতে কৃষকদের ক্ষমতায়ন হবে এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের ওপর নির্ভরশীলতা কমাবে, যা পক্ষান্তরে বাজারদরের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে। অবশ্যই এর জন্য ডিজিটাল সাক্ষরতা ও ইন্টারনেট সংযোগের মতো নানা পদক্ষেপ নিতে হবে।
মোটকথা বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন যা বিভিন্ন নীতির সমন্বয়ে গঠন হবে। এ বহুমাত্রিক পদ্ধতির জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ, বেসরকারি খাত, কৃষক এবং অন্যান্য অংশীজনের সমন্বয় ও সহযোগিতা প্রয়োজন।
ড. ফাহমিদা খাতুন: সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক