Published in ভোরের ডাক on Wednesday, 5 September 2018
আগামী মাসে দেশে আসছে সিডিপি
স্টাফ রিপোর্টার
আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশে আসছে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)। সংস্থার পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধিদলটি উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার পর বাংলাদেশ কোথায় কোথায় সুবিধা হারাবে, তার মূল্যায়নের কাজ শুরু করবে। তারা পরিকল্পনা কমিশন ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগসহ (ইআরডি) বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে বৈঠক করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের পর প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করবে। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা এই তিনটি সূচকের সব শেষ অগ্রগতি এবং সূচকগুলো কতটা টেকসই তা তুলে ধরবে বলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
ইআরডির দেওয়া তথ্য মতে, স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যেতে তিনটি সূচকের মধ্যে সব কটিই পূরণ করতে সক্ষম হওয়ায় গত মার্চে জাতিসংঘের সিডিপি কমিটি বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জনের স্বীকৃতিপত্র দেয়। স্বীকৃতি অনুযায়ী ২০২১ সাল পর্যন্ত পর্যবেক্ষণে রেখে ২০২৪ সালে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার কথা রয়েছে জাতিসংঘের। জানা গেছে, আগামী ২০২১ সালে দ্বিতীয়বারের মতো যখন পর্যালোচনা বৈঠকে বসবে জাতিসংঘ, তখন সিডিপির প্রতিবেদনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে যে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ হবে কি না? সক্ষমতা মূল্যায়নে জাতিসংঘ পৃথকভাবে দুটি প্রতিবেদন তৈরি করবে। যার মধ্যে ‘প্রভাব মূল্যায়ন’ প্রতিবেদনটি তৈরি করবে সিডিপি; যেখানে স্থান পাবে মাথাপিছু জাতীয় আয় এবং মানবসম্পদ সূচকের বিভিন্ন দিক।
আরেকটি প্রতিবেদন তৈরি করবে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা আংকটাড। সংস্থাটি কাজ করবে ‘অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা’ সূচক নিয়ে, যেখানে গুরুত্ব পাবে দেশের আমদানি-রফতানির সব শেষ চিত্র। মূল্যায়ন প্রতিবেদক হিসেবে জাতিসংঘের এ সিডিপির প্রতিনিধিদলের ঢাকা সফরকে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে দেখছে সরকার। সরকার আশা করছে সিডিপির ‘প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদনটি’২০১৯ সালের মধ্যে পাওয়া যাবে। কারণ আগে থেকে মূল্যায়ন প্রতিবেদনের আভাস পাওয়া গেলে এবং মূল্যায়নে সক্ষমতা সূচকের কোনটিতে পিছিয়ে থাকলে সেটি কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বলেন, জাতিসংঘের প্রতিনিধিদল আংকটাড ও সিডিপি যত দ্রুত তাদের প্রতিবেদন তৈরি করবে, বাংলাদেশের জন্য ততই মঙ্গল। কারণ বাংলাদেশের জন্য কোথায় কোথায় চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে, সেটি জানা যাবে। তাদের প্রতিবেদন দেখে ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেওয়া সহজ হবে। যেসব বিষয়ের উন্নয়নে আরো বেশি জোর দেওয়া দরকার সেটা দেওয়া যাবে।
উন্নয়নশীলের সক্ষমতা মূল্যায়নে যেমন সিডিপি প্রতিনিধিদলের বাংলাদেশ সফর গুরুত্ব পাচ্ছে। সেই একই গুরুত্বের বিবেচনায় আছে আংটাডের মূল্যায়ন প্রতিবেদন। তাই আংকটাডও যাতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক নিয়ে দ্রুত মূল্যায়ন শুরু করে, সে অনুরোধ জানাতে সরকারের একটি প্রতিনিধিদল সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় আংকটাডের সদর দপ্তরে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব কাজী শফিকুল আযমের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলে অন্যদের মধ্যে থাকছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সাজ্জাদুল হাসান, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মাহমুদা বেগম, সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের যুগ্ম প্রধান মফিদুল ইসলাম ও ইআরডির উপসচিব আনোয়ার হোসেন। ওই সফরে আংকটাডের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের বৈঠকের কথা রয়েছে।
ইআরডি সচিব কাজী শফিকুল আযম বলেন, আমরা আশা করছি ২০১৯ সালের শুরুতে তারা মূল্যায়ন কাজে হাত দেবে এবং একই বছর প্রতিবেদনটি জমা দেবে। ২০২১ সালে দ্বিতীয় দফায় বাংলাদেশ নিয়ে যখন পর্যালোচনা করা হবে, তখন সিডিপি ও আংকটাডের প্রতিবেদন দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আমরা চাই, ২০২১ সালের আগেই প্রতিবেদন দুটি তৈরির কাজ শেষ হোক। সফরে আংকটাডকে সেই অনুরোধ জানাবো আমরা।
জাতিসংঘের এ সিডিপি কমিটিতে সম্প্রতি সদস্য নিযুক্ত হয়েছেন বাংলাদেশের বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি এ বিষয়ে বলেন, কোনো দেশ যখন এলডিসি থেকে উত্তরণ করতে চায়, ওই দেশের লাভ-ক্ষতি, সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে মূল্যায়ন করে সিডিপি ও আংকটাড। তার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের সক্ষমতাও তারা মূল্যায়ন করবে। তাই আমাদের উচিত হবে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার গর্ব অটুট রাখা। উন্নয়নশীল হওয়ার পর যে ঝুঁকিগুলো সামনে আসবে এখন থেকেই সেগুলোর মোকাবেলায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তিনি আরো বলেন, যদি বড় ধরণের কোনো বিপর্যয় না আসে তবে বাংলাদেশ আগামী ২০২৪ সালে স্বল্পোন্নত থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বের হয়ে যাবে। এটার জন্য আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ যেটি আসবে সেটি হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশে পদার্পনের যে সূচকগুলো আছে, সেগুলোর প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা এবং হারানো সুযোগগুলোর বিকল্প সুযোগ খুঁজে বের করা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, উত্তরণের সব পর্যায়েই কিছু চ্যালেঞ্জ থাকে। বাংলাদেশের এ সফল উত্তরণেও যে চ্যালেঞ্জ নেই তা কিন্তু নয়। চ্যালেঞ্জগুলো টপকাতে পারলেই আমাদের মূল্যায়নের যথার্থতা আসবে। তবে বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক সূচকগুলোর অগ্রগতির বিবেচনায় জাতিসংঘের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সক্ষমতা প্রমাণ পাবে বলেই আশা করা যায়।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম বলেন, উন্নয়নশীল দেশ হলে বাংলাদেশ বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধা হারাবে, বিভিন্ন মহল থেকে এমন কথা বলা হচ্ছে। বিষয়গুলো সরকারও জানে। কিন্তু কারো কাছে কোনো তথ্য নেই, আসলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কত হবে। সেজন্য আমরা একটি বিস্তারিত গবেষণার কাজে হাত দিয়েছি। কয়েক মাসের মধ্যে আমাদের কাজ শেষ হবে। তাছাড়া জাতিসংঘ ঘোষিত ১৫ বছর মেয়াদি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিসি) বাস্তবায়নের জন্য সরকার যে কর্মকৌশল হাতে নিয়েছে, সেখানে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার বিষয়টিও মাথায় রাখা হয়েছে। ফলে সরকারের সব ধরনের প্রস্তুতিই রয়েছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, উন্নয়নশীল দেশে যাওয়ার পর বাংলাদেশের লাভ-ক্ষতি নিয়ে একটি গবেষণা করতে সরকারের সঙ্গে আমাদের আলাপ-আলোচনা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে। জিএসপি হারালে জিএসপি প্লাস কিভাবে পাওয়া যেতে পারে, সে কৌশল নিতে হবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডাসহ অন্যান্য দেশে বাজার সুবিধা হারানোর পর বিকল্প কী সুবিধা তৈরি করা যেতে পারে, সেজন্য এখন থেকেই কাজ শুরু করতে হবে। আমাদের অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা খুবই কম। সেটি বাড়াতে এখন থেকেই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।