দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে যেসকল কমিউনিটি ক্লিনিক বা স্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে, সেখানে প্রয়োজনীয় সংখ্যক দক্ষ লোকবলের অভাব রয়েছে। এর ফলে, প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে থাকা বরগুনার মতো দেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর অধিবাসীদের পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ সম্ভব হচ্ছে না। বিদ্যমান লোকবলের মাধ্যমে কার্যকর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে সরকারি মনিটরিং বৃদ্ধি করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা ও কার্যকর মনিটরিং বৃদ্ধিতে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে সমন্বয় ও যোগাযোগ বৃদ্ধি করা জরুরি। উপকূলীয় অঞ্চলের অধিবাসীদের জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব না হলে “কাউকে পেছনে রাখা যাবে না” এ চেতনায় টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট বা এসডিজি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।
মঙ্গলবার ১৫ অক্টোবর ২০১৯ বরগুনায় অনুষ্ঠিত “উপকূলীয় অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা: সরকারি পরিষেবার কার্যকারিতা” শীর্ষক সংলাপে এ সকল বক্তব্য উঠে আসে। “গণতান্ত্রিক সুশাসনে জনসম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ” শীর্ষক এক চলমান প্রকল্পের আওতায় সিপিডি ও অক্সফামের যৌথ উদ্যোগে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় এবং জাগো নারী’র সহযোগিতায় এ সংলাপটি আয়োজিত হয়।
জনাব তৌফিকুল ইসলাম খান, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, সিপিডি, সংলাপে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। এ প্রতিবেদনে তিনি এসডিজি এবং বিভিন্ন জাতীয় নীতিমালার আলোকে বরগুনার অধিবাসীদের স্বাস্থ্যসেবার বর্তমান অবস্থা ও বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেন। তিনি উল্লেখ করেন, জনসংখ্যার তুলনায় বরগুনায় নিয়োগপ্রাপ্ত সরকারি চিকিৎসকের সংখ্যা অপ্রতুল এবং উপকূলীয় অঞ্চল হওয়ায় বেশীরভাগ নিয়োগপ্রাপ্ত সরকারি চিকিৎসক বরগুনায় থাকতে চান না। বরগুনার প্রায় ১৫.৩ শতাংশ নারী অপরিণত বয়সে গর্ভধারণ করেন এবং এ জেলার প্রতি ১,০০০ নবজাতকের মাঝে প্রায় ২৭ জন শিশু মৃত্যুবরণ করে। জেলা এবং উপজেলা পর্যায় থেকে আওতাধীন কমিউনিটি ক্লিনিকসমূহের তদারকির ক্ষেত্রে যথেষ্ট দুর্বলতা রয়েছে। পরিবার কল্যাণ সহকারীর অনিয়মিত উপস্থিতি বা অপর্যাপ্ততা অনেক ক্ষেত্রেই জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিয়মানুযায়ী গ্রহণের ক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতাদের বাধার মুখে ফেলে। কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা নিতে গেলে অনেকসময়ই সেবাপ্রার্থীরা সেখানে কর্মরতদের দুর্ব্যবহারের শিকার হন। সেই সাথে, স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোগ (যেমন হটলাইন ১৬২৬৩) সম্পর্কে জনসাধারণের সচেতনতার অভাব রয়েছে।
সংলাপের প্রধান অতিথি হিসেবে বরগুনা জেলার জেলা প্রশাসক জনাব মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, এসডিজি বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং জেলা প্রশাসন সে অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিশোর-কিশোরীদের মাঝে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং জড়তা কাটাতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বিশেষ করে, এ জেলার প্রতিটি বিদ্যালয়ে কিশোরীদের মাঝে বিনামূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রশাসন। এছাড়া, উপকূলীয় অঞ্চলের স্থানীয় সমস্যার ভিন্নতা ও ব্যাপ্তির বিবেচনায় এ জেলার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বৃদ্ধির জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করা হয়েছে।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বরগুনা জেলার সিভিল সার্জন ডা. হুমায়ুন শাহীন খান বলেন, জেলার বিভিন্ন কমিউনিটি ক্লিনিক ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে লোকবলের ঘাটতি নিরসনে সরকারি লোকবল ও বাজেট বৃদ্ধি করা জরুরি। জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের পক্ষ থেকে উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কার্যকর মনিটরিং বৃদ্ধি করা হবে।
বরগুনা জেলার বিশিষ্ট সমাজসেবক জনাব সুখরঞ্জন শীল এ অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জগুলো সমাধানের ক্ষেত্রে নাগরিকদেরও আরো সচেতন হতে হবে। এক্ষেত্রে, সরকারি যেসকল সেবা ও হটলাইন রয়েছে সেগুলো সম্পর্কে সকলের মাঝে প্রচারণা বৃদ্ধি জরুরি।
সিপিডি’র সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান সংলাপের সভাপতি হিসেবে তার বক্তব্যে বলেন, আমরা গবেষণা থেকে দেখতে পাচ্ছি নিরাপদ ও সুপেয় পানির অভাবের সাথে উপকূলীয় অঞ্চলের বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কিত। নিরাপদ পানি আরো সহজলভ্য করার ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসন ও জনসাধারনের যৌথভাবে কাজ করা উচিত। এ অঞ্চলের অনেক অধিবাসী মৎস্য আহরণের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। তাদের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও আলাদা ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। যেসকল চ্যালেঞ্জের কথা আলোচিত হলো, এগুলো সমাধানে বাজেট বৃদ্ধি যেমন জরুরি, সেই সাথে, বিদ্যমান বাজেটের সুষ্ঠু ও কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিতে মনিটরিং ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে, সরকারি প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা ও নাগরিকদের একসাথে কাজ করতে হবে।
জাগো নারী’র প্রধান নির্বাহী হোসনে আরা হাসি এ অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন এবং ড. খালিদ হোসেন, প্রোগ্রাম ম্যানেজার, অক্সফাম ইন্ বাংলাদেশ, সূচনা বক্তব্য প্রদান করেন। এ সংলাপে বরগুনার জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তাবৃন্দ, সাংবাদিক, গবেষক, জনসম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠান প্রতিনিধি, শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন পেশাজীবীসহ দুইশতাধিক স্থানীয় নাগরিক অংশগ্রহণ করেন এবং সংলাপে বরগুনার মতো উপকূলীয় অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে প্রস্তাবনা তুলে ধরেন।