Originally posted in প্রতিদিনের সংবাদ on 13 January 2024
নতুন সরকারের বড় তিন চ্যালেঞ্জ
টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠন করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। নানা প্রতিকূলতায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষ করাই বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। সেটি সফলভাবেই মোকাবিলা করা হয়েছে। এবার পুরোনোদের সঙ্গে নতুনদের সমন্বয়ে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করে চমক দেখিয়েছে আওয়ামী লীগ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন সরকারের বড় তিনটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজেই বলেছেন, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক- এই তিন চ্যালেঞ্জ সরকারকে আগামীতে মোকাবিলা করতে হবে।
গতকাল শুক্রবার সকালে নবগঠিত মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি।
ওবায়দুল কাদের বলেন, সংকট অতিক্রম করে শান্তিপূর্ণ সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পেরেছি, এটা জননেত্রী শেখ হাসিনার ম্যাজিক লিডারশিপের জন্য সম্ভব হয়েছে। তিনি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যে দক্ষতা, দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন এবং সংকটে রূপান্তরের রূপকের ভূমিকা পালন করেছেন, সে কারণেই মূলত আমরা সাহস রাখি, আশা রাখি। তিনি আমাদের আশার বাতিঘর, আমাদের স্বপ্নের সাহসী ঠিকানা। এবার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলাই সরকারের লক্ষ্য।
আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক বলেন, চলার পথে কখনো পুষ্প বিছানো ছিল না, আমাদের চলার পথ জন্ম থেকে এ পর্যন্ত কণ্টকাকীর্ণই ছিল। কাজেই এই পথ আমরা অতিক্রম করি, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, এখন বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে মুক্তির কঠিন লড়াই অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলব।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও জীবনমানের অবনমন কাটিয়ে ওঠা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য সরবরাহ নিশ্চিতের বিষয়ে আরো গুরুত্ব দিতে হবে। উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি প্রয়োজন হলে সময়মতো আমদানি করে মজুদ বাড়ানো উচিত। বাজারে সিন্ডিকেট ও মধ্যস্থতাকারীদের অন্যায্য হস্তক্ষেপ নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ডলার সংকটের কারণে মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ বেশকিছু ক্ষেত্রে আমদানিতে এলসি খুলতে সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে বিনিয়োগ চাঙা করতে হবে। এজন্য ডলার সংকট দূর করতে হবে। ব্যাংকিং খাত ও রাজস্ব খাতে সক্ষমতা বাড়িয়ে সরকারের আয় বৃদ্ধি করার পাশাপাশি ব্যাংকিং সিস্টেমের উৎকর্ষ বৃদ্ধি করে ঋণখেলাপি কমাতে হবে। বর্তমানে সবক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’ নীতি প্রয়োগ করতে হবে। খেলাপি ঋণ, কর ফাঁকি, অর্থ পাচার, হুন্ডি-হাওলা, সিন্ডিকেশন ইত্যাদি কার্যক্রম দেশের অর্থনীতির ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণের পাশাপাশি জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে বিভিন্ন খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায়োগিক দিকে আরো নজর দিতে হবে। সুশাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার পাশাপাশি সাশ্রয়ীভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীকে উপেক্ষা করে নতুন সরকারকে দেশের স্বার্থে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফেরাতে দৃঢ়তার সঙ্গে কার্যক্রম গ্রহণের পাশাপাশি তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ বলেন, এই মুহূর্তে নতুন সরকারকে দুর্নীতি, সুশাসন নিশ্চিত আর দ্রব্যমূল্যের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় মোকাবিলা করতে হবে। আর বর্তমান বাস্তবতায় কূটনীতির বিষয়টিও সামনে আসবে। বিশেষ করে বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আরো ভালো করার পাশাপাশি যেসব দেশের সঙ্গে বিরোধ তৈরি হয়েছে, সেসব সম্পর্কও উন্নত করায় জোর দিতে হবে।
আবার সংসদের ভেতরেও শক্তিশালী একটি বিরোধী দলের অভাবে ভুগতে হবে ক্ষমতাসীনদের। সেই সমীকরণ নতুন সরকারকে নতুন করে চ্যালেঞ্জে ফেলবে বলে মনে করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহদাত হোসেন। এজন্য সরকারকে জনমুখী কাজে আরো বেশি মনোনিবেশ করতে পরামর্শ তার।
এদিকে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) এক প্রতিবেদনে বলেছে, দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেশের অর্থনীতির প্রধান ঝুঁকি। সংস্থাটি ঝুঁকির পাঁচটি ক্ষেত্রও চিহ্নিত করেছে। সেগুলো হলো- দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ঋণসংকট, ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা, মানুষের তৈরি পরিবেশ বিপর্যয় ও সম্পদ নিয়ে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা।
বাংলাদেশে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের অংশীদার হিসেবে কাজ করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। ৭২ কোম্পানির ওপর জরিপ করে ঝুঁকির তালিকা প্রস্তুত করেছে তারা।
২০২৪ সালে মূল্যস্ফীতির হার কমার সম্ভাবনা আছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, দেশের মূল্যস্ফীতি অনেকাংশে আমদানিনির্ভর। বিশ্ব অর্থনীতির বাস্তবতায় মূল্যস্ফীতি হ্রাসের সম্ভাবনা তেমন একটা নেই। তিনি বলেন, অনিশ্চয়তার কারণে রপ্তানিকারকরা আগে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে তারপর রপ্তানি করছেন। সেই সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরবরাহব্যবস্থা এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। আবার দেশের আমদানি কয়েকটি গোষ্ঠীর হাতে সীমাবদ্ধ। তারা যখন ঝুঁঁকি দেখেন, তখন আমদানি কমিয়ে দেন, পাছে বিক্রি না হয় এই ভয়ে। সে কারণেও বাজারে চাপ পড়ে। গোলাম মোয়াজ্জেম আরো বলেন, খাদ্য মূল্যস্ফীতির বড় কারণ ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি। সেই সঙ্গে আছে জ্বালানির উচ্চমূল্য। শীতকাল শেষ হলে ইউরোপে জ্বালানির চাহিদা কিছুটা কমবে, কিন্তু তা এতটা কমবে না যে, মূল্যস্ফীতি এক ধাক্কায় অনেকটা কমে যাবে। তবে অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন ভালো অবস্থায় আছে। সারের সরবরাহ ঠিক থাকলে দেশি খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি হবে না।