Published in সাম্প্রতিক দেশকাল on Monday 29 June 2020
প্রণোদনা-বাজেটে বরাদ্দ নেই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের
কোভিড-১৯ সংক্রমণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সারাদেশের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা। অনানুষ্ঠানিক খাতে এই উদ্যোক্তারা দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। ৮০ লাখ উদ্যোক্তাদের ছোটখাটো উদ্যোগে সরাসরি অন্তত আড়াই কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। অথচ আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে তাদের জন্য নেই কোনো সুখবর। নেই পৃথক কোনো বরাদ্দ। কর ছাড়ের জন্য দাবি ছিল, বাজেটে সেটিও রাখেননি অর্থমন্ত্রী। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত ১৯টি প্যাকেজের মধ্যে ৩টি প্যাকেজ থেকে সুবিধা নেওয়ার সুযোগ আছে। তবে চরম এই দু’সময়ে ঋণগ্রহণের মতো অবস্থা যেমন নেই, তেমনি কাগজপত্র ও পদ্ধতিগত নানা জটিলতায় ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের সুযোগও খুবই সামান্য।
বিভিন্ন সংস্থার তথ্যমতে, সারাদেশে ছোটখাটো প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন ৮০ লাখ উদ্যোক্তা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, অতিক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্রকারখানা রয়েছে ৪০ হাজার ২৫০টি। আর বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির তথ্যমতে, সারাদেশে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রয়েছেন ৫৬ লাখ। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) সমীক্ষা অনুসারে, বাংলাদেশের জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান ২০ থেকে ২৫ শতাংশ। বর্তমানে দেশের প্রায় আড়াই কোটি মানুষের সরাসরি কর্মসংস্থান ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পখাতে।
করোনাভাইরাসের কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এসব উদ্যোক্তা। গত ঈদ ও পহেলা বৈশাখকেন্দ্রিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ব্যবসায় ধস নেমেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। অবস্থার উন্নতি না হলে ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়তে পারেন অনেকে। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি বলছে, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রতিদিন গড়ে ১১০০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। ৬৪ দিনে (২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে) এ লোকসানের পরিমাণ ৭০ হাজার কোটি টাকা। শুধু পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে মাটিরহাঁড়ি, মিষ্টি, পোশাকসহ শতভাগ দেশের বাজারের জন্য পণ্য তৈরি করে এমন ব্যবসায়ীদের ক্ষতির পরিমাণ আরো ছয় হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৭৬ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি।
পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, নভেল করোনাভাইরাস ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে অঘোষিত লকডাউনে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থমকে গেছে। এতে আয়ের পথ বন্ধ হয়ে দরিদ্র মানুষের জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। এর মধ্যে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ৭৩ শতাংশ এবং দোকান, সেলুন, পার্লারের রোজগার কমেছে ৭২ শতাংশ। এ অবস্থায় বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ ও সুবিধার দাবি জানিয়েছিলেন উদ্যোক্তা ও বিশ্লেষকরা।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা দোকান ভাড়া, কর্মচারীর বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। এ বিপুল পরিমাণ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অবশ্যই সরকারের সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল। গতানুগতিকভাবে বাজেট দেয়া হয়েছে। এই বাজেট থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা কিছু পাবে না। তবে প্রধানমন্ত্রী যে প্যাকেজ দিয়েছেন, তা বাস্তবায়ন হলে ব্যবসায়ীরা দাঁড়াতে পারতেন; কিন্তু ব্যাংকগুলো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ঋণ দিচ্ছে না।’
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তার বাজেট বক্তৃতায় করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের অংশ হিসেবে ঘোষিত ১৯টি প্যাকেজের কথা উল্লেখ করেছেন। এই ১৯টি প্যাকেজের মধ্যে এসএমই খাতের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল, সুদ ভর্তুকি হিসেবে দুই হাজার কোটির তহবিল এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য তিন হাজার কোটি টাকার তহবিল করা হয়েছে। যেসব ব্যবসায়ী ঋণ নিয়েছেন, তাদের মধ্যে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণে সুদ মওকুফ এবং অন্যান্য ঋণে সুদ কিছুটা কমানো হয়েছে একটি তহবিলের আওতায়। বাকি দুটি তহবিল থেকে সাধারণ নিয়মে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে পারবেন উদ্যোক্তারা। অপ্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোক্তাদের ঋণ নেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেই। ব্যাংক যেভাবে যাচাই-বাছাই করে ঋণ দেয়া শুরু করেছে, তাতে ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তারা ঋণ পাচ্ছেন না। উল্টো নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এ জন্য প্যাকেজের আওতায় ঋণ বিতরণ অনেক কম।
এ বিষয়ে একটি বেসরকারি ব্যাংকের একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘প্যাকেজের আওতায় ব্যাংকগুলোকে ঋণ বিতরণ করতে হবে এবং তা আদায় করতে হবে। আদায় করার জন্য যে ধরনের প্রক্রিয়া অনুসরণ করা দরকার, তা করা হচ্ছে। সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ঋণের জন্য আবেদন অনেক কম এসেছে। যার ফলে প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ বিতরণ করা সম্ভব হচ্ছে না।’
উইমেন এন্টারপ্রেনিয়র অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ওয়েব) সভাপতি নাসরিন আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘গত কয়েক মাসে নারী উদ্যোক্তারা বিপাকে আছেন। ক্ষতিগ্রস্তরা ৪ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে পারবেন না। তাদের অন্তত এক বছর বিনা সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা জরুরি।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘ঋণের নামে প্রণোদনা দেয়ার সময় এখন নয়। কারণ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণের কিস্তি পরিশোধ করার মতো অর্থ নেই। তারা যেন পুনরায় কার্যক্রম শুরু করতে পারেন, সে জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দিতে হবে।’
প্রস্তাবিত বাজেটে উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ বরাদ্দসহ কর ছাড়ের দাবি করা হয়; কিন্তু কিছুই করা হয়নি। আগের মতোই ভ্যাট আদায় করা হবে। সিপিডির আরেক ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘এই খাতের উদ্যোক্তারা করোনাভাইরাসের কারণে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। অনেকের ক্ষেত্রে ব্যবসা পুনরায় শুরু করা কঠিন হয়ে পড়েছে। আমরা প্রস্তাব করেছিলাম বার্ষিক এক কোটি টাকা পর্যন্ত টার্নওভারে ভ্যাটমুক্ত রাখার জন্য। বড় শিল্পের ক্ষেত্রে নানা ছাড় দেয়া হলেও আগের মতোই বার্ষিক ৫০ লাখ টার্নওভারে ৪ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। এটি বাড়ানো দরকার ছিল।’
নারী উদ্যোক্তা সংগঠন ওয়েন্ডের সভাপতি ড. নাদিয়া বিনতে আমিন বলেন, ‘জিডিপির ২৫ শতাংশ অবদান রাখে এসএমই খাত। এ খাতের সিংহভাগই নারী উদ্যোক্তা। এই সংকটকালীন সময়ে উত্তরণে নারী উদ্যোক্তাদের করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা করা হয়েছে। এটি পাঁচ লাখ করার দাবি জানাচ্ছি।’