কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণের প্রকৃত চিত্র উঠে আসছে না: ফাহমিদা খাতুন

Published in বণিকবার্তা on 16 October 2020

একবিংশ শতাব্দীতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে সরকারি-বেসরকারি ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন। অধিকার প্রতিষ্ঠার দৌড়ে শহুরে নারীরা এগিয়ে থাকলেও এখনো অবহেলিত গ্রামের প্রান্তিক নারীরা। গ্রামীণ নারীরা গৃহশ্রম, কৃষি-শিল্প খাতে কাজ করলেও তারা প্রত্যাশিত মর্যাদা ও স্বীকৃতি লাভ থেকে এখনো বঞ্চিত। অর্থনীতিতে তাদের বড় ভূমিকা থাকলেও তাদের অবদান স্বীকৃত নয়। কৃষিতে নারী শ্রমিকের আধিক্য বাড়লেও কৃষক হিসেবে তারা সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত। প্রান্তিক নারীদের শ্রম, মর্যাদা এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা না করা গেলে তাদের জীবনমান উন্নত হবে না।

গতকাল ‘গ্রামীণ নারী দিবস’ উপলক্ষে আয়োজিত ‘অর্থনীতিতে প্রান্তিক গ্রামীণ নারীর ভূমিকা’ শীর্ষক অনলাইন বৈঠকে অংশ নিয়ে আলোচকরা এসব কথা বলেন। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নিজেরা করি ও বণিক বার্তার যৌথ উদ্যোগে আলোচনা সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। এতে সহায়তা করেছে ইকো কো-অপারেশন। সভাপ্রধান ছিলেন ‘নিজেরা করি’র সমন্বয়কারী খুশী কবির।

সূচনা বক্তব্যে বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ বলেন, আজ গ্রামীণ নারী দিবস। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই দিনটি সম্পর্কে জানেন না। বাংলাদেশের অর্থনীতি আগামী বছর ৫০ বছরে পদার্পণ করবে। বণিক বার্তা বাংলাদেশের গ্রামীণ রূপান্তর নিয়ে এ বছরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করছে। বিশেষ করে কৃষি, অকৃষি, অবকাঠামো এবং সামাজিক খাতে পরিবর্তনের চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে। এরই মধ্যে দুটি পর্ব প্রকাশ হয়েছে। এটি করতে গিয়ে আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিবর্তনে গ্রামের প্রান্তিক নারীরা বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের একেক অঞ্চলে নারীদের জীবন সংগ্রামের ধরন একেক রকম। উপকূলীয় অঞ্চল, উত্তরবঙ্গ, এমনকি পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের জীবনাচরণ অঞ্চলভেদে ভিন্ন। প্রান্তিক নারীরা দেশের বাইরে গেছেন। অর্থনীতিতে তাদের অবদান এখনো সেভাবে স্বীকৃতি লাভ করেনি, তাদের মর্যাদাও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

সভাপ্রধানের বক্তব্যে খুশী কবির বলেন, বিশ্বে ৭০০ কোটির বেশি মানুষ বসবাস করছে। এর চার ভাগের এক ভাগ গ্রামীণ নারী। যারা কৃষি, ক্ষুদ্র ব্যবসাসহ সাংসারিক কাজকর্ম করে থাকেন। কিন্তু ভূমিতে অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এসব নারীর অগ্রগতি হয়নি। শতকরা ২০ ভাগেরও কম নারী ভূমিতে অধিকার পান। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ এখনো অনেক কম। ২০২৫ সালের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে আরো ২৫ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, গ্রামীণ নারীদের নিয়ে আমরা কথা বললেও অর্থনীতিতে তাদের ভূমিকা কতটুকু, তা জানি না। অর্থনৈতিক উন্নয়নের বাস্তবতা ও গতিপ্রকৃতি বুঝতে তাদের অবদান জানাটা জরুরি।

কৃষিক্ষেত্রে প্রান্তিক নারী শ্রমিকদের অবদানের কথা তুলে ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় যে পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে, তার ৮০ শতাংশ নারী উৎপাদন করছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীরা উৎপাদনে অনেক অবদান রাখছেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কৃষিতে নারীদের যে অবদান সেটি খুব ছোট করে দেখানো হচ্ছে। নারীরা এখন চিংড়ি চাষ, চা বাগান, কৃষি খেতে কাজ করছেন। কিন্তু সেগুলো সামগ্রিকভাবে উঠে আসছে না। শিল্প-কারখানায়ও নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে।

সম্পত্তিতে নারীদের অধিকারের বিষয়ে তিনি বলেন, সম্পত্তি ক্রয়-বিক্রয়ে নারীর কোনো অধিকার নেই। বাংলাদেশের ৯৬ শতাংশ জমির মালিক পুরুষ। বাকি ৫ শতাংশ জমির মালিক নারীরা। সেই ৫ শতাংশ নারীর জমি কোনো না কোনোভাবে পুরুষ ভোগদখল করছেন। দেশে ৯৪ শতাংশ নারীর কোনো সম্পত্তি নেই। সেটা বাঙালি, উপজাতি কিংবা আদিবাসী সব নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

ভূমিহীন নারীদের অবস্থার কথা তুলে ধরে জাতীয় কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম গোলাপ বলেন, ভূমিহীন নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই একটা চ্যালেঞ্জ। এ লড়াই করতে গিয়ে অনেকের প্রাণ গেছে। অনেকে আহত হয়েছেন।  তিনি বলেন, আমরা যে লড়াই করছি, তার মূল লক্ষ্য আজও আমরা অর্জন করতে পারিনি। স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছরেও বাংলাদেশে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সমাজে নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হলে দেশের ৬০ শতাংশ নারীকে সংগঠিত করতে হবে। তা না হলে সব পরিকল্পনা ব্যর্থ হবে।

নারীদের সামগ্রিক অবস্থার কথা তুলে ধরে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, গ্রামীণ নারীরা কাজ করছেন, তবে তা অনানুষ্ঠানিকভাবে। যে কারণে কর্মক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণের প্রকৃত চিত্র উঠে আসছে না। পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি বলেন, ৯১ দশমিক ৮ শতাংশ নারী অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করছেন।

শস্য সংরক্ষণ থেকে শুরু করে বীজতলা নির্মাণ, শস্য বাজারজাতের কাজ করছেন নারীরা। তারা ৩৫ থেকে ৪০ ধরনের কাজ করছেন। কিন্তু তার আনুষ্ঠানিকতা আমরা দেখি না। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের কৃষিতে ৪০ শতাংশ নারী শ্রমিক কাজ করছেন। কিন্তু অর্থনীতিতে তাদের অবদান মাত্র ১৩ শতাংশ।

কৃষিঋণের ক্ষেত্রে নারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের কথা তুলে ধরে ফাহমিদা খাতুন বলেন, নারীদের উদ্যোক্তা হতে ব্যাংকঋণ প্রদানের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এসব ব্যাংকের কর্মীরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে যান না। ফলে প্রান্তিক নারীদের যে আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন, সেটি তারা পাচ্ছেন না।

কভিড-১৯-এর কারণে নারীরা সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। ২০ হাজার কোটি টাকার একটা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে নারীদের ঋণ হিসেবে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। ১ হাজার কোটি টাকা নারীরা ঋণ নিতে পারবেন। এর বাইরে এনজিওগুলো থেকে নারীদের ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, সেখান থেকে তারা ঋণ পাচ্ছেন না।

এসব প্রতিবন্ধকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে প্রান্তিক নারীদের অর্থ পাওয়ার সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া নারী সংবেদনশীল বিনিয়োগ বৃদ্ধি, বৈষম্যমূলক সমাজ ব্যবস্থার অবসান এবং সম্পদের ওপরে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, প্রান্তিক নারীরা যে পরিশ্রম করেন, এগুলো তাদের প্রতিদিনকার জীবনসংগ্রাম। ভূমিহীন নারীরা জমিতে তাদের অধিকার পাচ্ছেন না। এসব নারীর জীবনের গল্পের মধ্য দিয়ে শুধু অর্থনৈতিক বৈষম্য নয়, আরো অনেক ধরনের বৈষম্যের চিত্র ফুটে ওঠে।

গ্রামীণ নারীদের পরিসংখ্যান তুলে ধরে রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশের উপপরিচালক সুরাইয়া বেগম বলেন, ২০০৫ সালে দেশে শ্রমশক্তি জরিপ হয়েছিল, সেখানে ৭৭ শতাংশ নারী শ্রমিক। মোট কৃষি শ্রমের ৪৫ দশমিক ৬ শতাংশ বিনা মূল্যে নারী শ্রম। ৫৪ দশমিক ৬ শতাংশ শ্রম টাকার বিনিময়ে কেনা হয়েছে। জমির মালিকানায় ৮১ শতাংশ পুরুষ, ১৯ শতাংশ নারী।  জিডিপিতে কৃষির অবদান ১৭ শতাংশ। গ্রামীণ নারীদের শ্রমঘণ্টা যদি আমরা মূল্যায়ন করতে না পারি, তাহলে আমরা নারীদের অবদান বুঝতে পারব না। এ সময় তিনি কৃষিতে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে, তা তুলে ধরেন।

পাঁচ প্রান্তিক গ্রামীণ নারীর জীবনকথা

গ্রামীণ নারী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এই ওয়েবিনারে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পাঁচজন নারীর জীবনকথা ও প্রাত্যহিক জীবনাচরণ তুলে ধরা হয় ভিডিওচিত্রের মাধ্যমে।  জীবন সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার নোয়াকাটা গ্রামের নারী অঞ্জলি দাস বলেন, আমরা যে কাজ করি তার যথাযথ মূল্যায়ন পাই না। ধানের বীজ বোনা, সার দেয়া, ধান কাটা এবং পরিষ্কার করা থেকে শুরু করে কৃষিজমির সব ধরনের কাজ করি। কিন্তু তার যথাযথ পারিশ্রমিক পাই না। নারী-পুরুষ একসঙ্গে কাজ করলে মজুরির ক্ষেত্রে পুরুষরা বেশি টাকা পান, নারীরা কম।

একই কথা বলেন রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার নাটাগাড়ি গ্রামের অঞ্জলি মিঞ্জির। তিনি বলেন, আমি বারো মাসই খেতে কাজ করি। আমার আয়ের তিন ভাগ টাকা আমি সংসারে কাজে লাগাই। বাকি এক ভাগ আমার স্বামীকে দিই। পুরুষের চেয়ে নারীরা কম টাকা পান। টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার শেফালী বেগম বলেন, আমরা নারীরা যে কাজ করি সমাজে তার কোনো মূল্য পাই না। স্বামী বাইরে কাজ করলেও আমি বাড়িতে কাজ করি কিন্তু তার কোনো মূল্য নেই।

খাস জমির কথা তুলে ধরে রংপুরের পীরগঞ্জের প্রান্তিক নারী মাহামুদা বেগম বলেন, খাস জমি নিয়ে সরকার যে নীতিমালা করেছে, সেখানে প্রান্তিক নারীদের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে এখনো অনেক ধনী লোক খাস জমি দখল করে আছে। আমরা এসব জমি পাই না। কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার সালেহা আক্তার জানান, স্বামী ফেলে রেখে চলে যাওয়ার পর কৃষিকাজ শুরু করেন। কিন্তু সমাজ থেকে অনেক বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হন তিনি।

 

httpv://youtu.be/2YZTk6qx5i8