করোনা মোকাবেলায় ত্রাণ কর্মসূচির কার্যকারিতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বরাদ্দ নির্ধারণের জন্য একটি সুচকের উপর নির্ভর না করে স্থানীয় পর্যায়ের দারিদ্র্যের হার, জনসংখ্যা, বেকারত্বের হার ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে বহুমাত্রিক মাপকাঠি নির্ধারণ করতে হবে। ত্রাণ সেবা সংক্রান্ত প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোগ সম্পর্কে জনসাধারণের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সুবিধাভোগী নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা বৃদ্ধির জন্য বাস্তবায়ন নির্দেশিকা অনুযায়ী প্রচার-প্রচারণার পরিকল্পনা প্রনয়ণ এবং তা বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ করা সহ ত্রাণ কর্মসূচি কার্যকর করতে আরও পদক্ষেপের প্রয়োজন আছে। এছাড়া ত্রাণ সেবা সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য (যেমনঃ উপজেলা ও ইউনিয়নওয়ারী বরাদ্দ, বিতরণ, সুবিধাভোগীদের তালিকা, ‘হটলাইন’ এর ব্যবহার) ডাটাবেসে সংরক্ষণ এবং যথাযথ ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
‘আম্ফানের’ মত দুর্যোগ মোকাবেলায় কৃষি পুনর্বাসন/প্রণোদনা কর্মসূচি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নে সরকারি সহায়তার অধিকতর কার্যকর ব্যবহার এবং অপচয় রোধে সার ও বীজের বরাদ্দের ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ের প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির নিরীখে এবং স্থানীয় কৃষকদের চাহিদা, ফসল উৎপাদনের বিন্যাস অনুযায়ী বরাদ্দ প্রদান করতে হবে। ইউনিয়ন/উপজেলাভিত্তিক একটি তথ্যভাণ্ডার (ডাটাবেস) তৈরি করতে হবে, যেখানে কৃষকের আর্থ-সামাজিক অবস্থা থেকে শুরু করে ফসল উৎপাদনের যাবতীয় তথ্য নিয়মিতভাবে সংগৃহীত হতে থাকবে। এতে করে তাদের চাহিদা অনুযায়ী সাহায্য দেয়া ও যোগ্য ব্যক্তি চিহ্নিত করা সহজতর হবে। সরকারি কৃষি প্রণোদনাসমূহ যেন দুর্যোগে অধিকতর ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মাঝে পৌঁছায় তা নিশ্চিতে জিও-এনজিও সমন্বয় বৃদ্ধি করতে হবে। কৃষকের তালিকা হালনাগাদ করে নতুনভাবে কৃষিকার্ড বিতরণের উদ্যোগ নিতে হবে। নিবিড় তদারকির ভিত্তিতে কৃষকের জন্য জামানতবিহীন ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং কৃষি সহায়তাসমূহ সুষ্ঠুভাবে বিতরণের জন্য মাঠ পর্যায়ে বরাদ্দকৃত সরকারি চাকুরীর নিরীখে কৃষি কর্মীদের নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। কৃষি ঋণ বিতরণে বর্গা চাষী এবং ত্রাণ বিতরণে গ্রামে ফেরা মানুষের জন্য বিশেষ উদ্যোগের প্রয়োজন আছে।
এ সকল সুপারিশমালা উঠে আসে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি), অক্সফাম ইন বাংলাদেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন-এর পক্ষ থেকে আয়োজিত করোনা ও আম্ফান মোকাবেলায় ত্রাণ কর্মসূচি এবং কৃষি প্রণোদনা: সরকারি পরিষেবার কার্যকারিতা শীর্ষক একটি ভার্চুয়াল সংলাপে। ডাক দিয়ে যাই, পিরোজপুর এবং এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ এর সহযোগিতায় এই সংলাপটি অনুষ্ঠিত হয় ৩১ জানুয়ারি ২০২১ তারিখ রবিবার সকাল ১০ টা থেকে।
ড. ফাহমিদা খাতুন, নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি), ড. দীপঙ্কর দত্ত, কান্ট্রি ডিরেক্টর, অক্সফাম ইন বাংলাদেশ এবং জনাব মোঃ শাহজাহান গাজী, নির্বাহী পরিচালক, ডাক দিয়ে যাই, পিরোজপুর সংলাপে প্রারম্ভিক বক্তব্য প্রদান করেন। কোভিড-১৯ অতিমারি বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখে যাচ্ছে। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট বাস্তবায়নে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলোকে এই অতিমারি আরও কঠিন করছে বলে তারা মন্তব্য করেন। উপকূলীয় জেলাগুলিতে সাম্প্রতিক বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় ‘আম্ফান’ এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
সিপিডি’র সিনিয়র রিসার্চ ফেলো জনাব তৌফিকুল ইসলাম খান ও সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, জনাব মোস্তফা আমির সাব্বিহ সংলাপে মুল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। উপস্থাপনায় করোনা ও আম্ফান মোকাবেলায় ত্রাণ এবং কৃষি পুনর্বাসন/প্রণোদনা কর্মসূচি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে কিছু সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ পরিলক্ষিত হয়েছে। বরাদ্দ ও বিতরণের পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করা, সেবা সম্পর্কিত প্রচার প্রচারণা বৃদ্ধি করা, স্থানীয় পর্যায়ে সুবিধাভোগী নির্বাচন প্রক্রিয়া (বিশেষ করে নগদ অর্থ সুবিধার ক্ষেত্রে) অংশগ্রহণমূলক করা, ভবিষ্যতে ২,৫০০ টাকার মত কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে এর অধিকতর কার্যকারিতার জন্য তালিকাভুক্ত হওয়া বা সেবা পাবার শর্তের ক্ষেত্রে একাধিক বিকল্প রাখা সহ আরও পদক্ষেপ প্রয়োজনীয় করোনা মোকাবেলায় ত্রাণ কর্মসূচিকে কার্যকর করতে। ইন্দুরকানী উপজেলা থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২,৫০০ টাকা মানবিক সহায়তা পাওয়ার যোগ্য এমন ৪,০০০ জনের একটি তালিকা জাতীয় পর্যায়ে পাঠানো হয়। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে প্রেরণকৃত তালিকার মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০% এর কাছাকাছি মানুষ এই সহায়তা পেয়েছেন। যারা তালিকাভুক্ত কিন্তু এখনও সহায়তা পাননি তাদের সকলের কাছে দ্রুত নগদ সহায়তা পৌঁছানোর উদ্যোগ গ্রহনের প্রয়োজন রয়েছে। দুর্যোগ মোকাবেলায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য কৃষি পুনর্বাসন কর্মসূচি আরও কার্যকর করার ক্ষেত্রে চাহিদা নিরূপণ এবং এর ভিত্তিতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদেরকে কৃষি প্রণোদনা সম্পর্কে জানানো ও জিও-এনজিও সমন্বয়ে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের অগ্রাধিকার তালিকা প্রস্তুত করতে হবে।
পরিস্থিতির ভয়াবহতা তুলে ধরে জনাব শ ম রেজাউল করিম, এমপি, মাননীয় মন্ত্রী, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার সংলাপে প্রধান অতিথি হিসেবে বলেন যে এই দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সরকারি উদ্যোগ বাস্তবায়নে বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার সাথে সম্মিলিত প্রচেষ্টার কথা বলেন।
সংলাপের বিশেষ অতিথি জনাব আবু আলী মোঃ সাজ্জাদ হোসেন, জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পিরোজপুর জেলা সংলাপে উপস্থিত সকলের সাথে জেলা প্রশাসকের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলেন। করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় তিনি বলেন যে পিরোজপুর জেলায় সকলের জন্য খাদ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়। আম্ফান মোকাবেলায় তিনি বলেন যে পিরোজপুরে পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত করায় হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। দুর্গত মানুষদের পর্যাপ্ত সহায়তা নিশ্চিত করতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানদের তৎপরতা প্রশংসা করে বিশেষ অতিথি বলেন যে দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানদের যথেষ্ট ভূমিকা ছিল।
সংলাপে আলোচনার সারসংক্ষেপ তুলে ধরে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ-এর আহ্বায়ক ও সিপিডি’র সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আলোচনাকে উৎসাহব্যঞ্জক, তথ্যভিত্তিক ও অংশগ্রহণমূলক হয়েছে বলে মনে করেন। তিনি মন্তব্য করেন যে জনগোষ্ঠীভিত্তিক এর চেয়ে দারিদ্রতাভিত্তিক ওবিপন্নতাভিত্তিক ত্রাণ তৎপরতা অনেক বেশী কার্যকর হয়। এই কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে আরও তথ্য-উপাত্ত ও প্রশাসনিক সমন্বয় প্রয়োজন। যোগ্য মানুষের কাছে সহয়তা পৌঁছে দিতে প্রচার-প্রচারণার উপর গুরুত্ব দেন তিনি।
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মাননীয় ফেলো সিপিডি, সংলাপে সভাপতিত্ব করেন। তিনি সমাপনী বক্তব্যে নাগরিক অধিকারের কথা উল্লেখ করে বলেন যে, এরকম সংলাপের মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার প্রয়োজন রয়েছে।
পিরোজপুর থেকে প্রায় এক শতাধিক কমিউনিটি-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের (সিবিও) সদস্য ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ এই সংলাপে যোগ দেন এবং বিভিন্ন পরামর্শ ও মন্তব্য উপস্থাপন করেন। তারা তাদের তৃণমূল অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, এই দুর্যোগ পরিস্থিতিতে এই অঞ্চলে সুপেয় পানির অভাব রয়েছে। জনাব হোসাইন মুহাম্মদ আল-মুজাহিদ, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, ইন্দুরকানী উপজেলা, পিরোজপুর, সংলাপে সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ সরকারের এসডিজি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে যথাযথ সহযোগিতা দেওয়ার উদ্দেশ্যে সিপিডি, অক্সফাম ইন বাংলাদেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন দেশের ১৩টি জেলায় “গণতান্ত্রিক সুশাসনে জনসম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ” শীর্ষক একটি প্রকল্প পরিচালনা করছে। প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে এসডিজি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় স্থানীয় সরকারসহ বেসরকারি পর্যায়ের অন্যান্য সকল সংশ্লিষ্ট অংশীজনের অংশগ্রহণ ও সক্রিয় অবদান রাখার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে তাদের সক্ষমতা তৈরির চেষ্টা করা। এই সংলাপটি এ প্রকল্পের আওতায় অনুষ্ঠিত হয়।
সংলাপে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ, উন্নয়নকর্মী, এনজিও প্রতিনিধি, ব্যক্তিখাতের উদ্যোক্তা, সমাজকর্মী এবং গণমাধ্যমকর্মীসহ নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।