Professor Rehman Sobhan on rethinking the nature of democratic practices in Bangladesh, published in Jugantor Special Anniversary Issue on Thursday, 6 March 2014.
বাংলাদেশের গণতন্ত্রচর্চার পুনর্ভাবনা
রেহমান সোবহান
ব্রিটিশ শাসন অবসানের পরবর্তী ৬৫ বছরজুড়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে অন্যতম যে হাহাকারবোধটি কাজ করেছে, তা হল একটি সুষ্ঠু গণতন্ত্রের জন্য হাহাকার। যে গণতন্ত্র জনগণের। যে গণতন্ত্র জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য পরিচালিত। পূর্ব পাকিস্তান থাকাকালীন পুরো সময়টাই বাঙালি জাতি গণতন্ত্র থেকে বঞ্চিত ছিল। কারণ তখনকার ক্ষমতাসীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বুঝতে পেরেছিল, গণতন্ত্রের মাধ্যমে তাদের হাতে কুক্ষিগত ক্ষমতা সাধারণ মানুষের কাছে চলে যাবে। সেই সাধারণ মানুষের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল বাঙালিরা।
আইয়ুব খানের এক দশকের সামরিক শাসনের উদ্দেশ্যই ছিল জনগণের দ্বারা শাসন ব্যাহত করা। যার ফলে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য কেবলই বেড়েছে। পাকিস্তানের স্বাধীনতার ২২ বছর পর অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠার একটি সুযোগ এলেও ক্ষমতাসীনরা তা মেনে নিতে পারেনি। কারণ, নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে জনগণের চাহিদার প্রতিফলন ঘটার একটি অবস্থার সৃষ্টি হলেও হতে পারত, যা কি-না ক্ষমতাসীনদের আধিপত্যকে খর্ব করার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে।
ফলে, পাকিস্তানের অংশ থাকা অবস্থায় বাংলাদেশের মানুষের গণতন্ত্রের জন্য যে আকাক্সক্ষা, তা পূরণ হওয়া ছিল অসম্ভব। গণতন্ত্রের এই অধিকার তাই বাংলাদেশকে অর্জন করে নিতে হয়েছে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের এই গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষা এখনও সুদূরপরাহত। আমি এখানে আমাদের এই হতাশার মূল কারণগুলো তুলে ধরার এবং কিছু সমাধান দেয়ার চেষ্টা করব। যার মাধ্যমে আমাদের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা ও রাজনৈতিক নেতারা আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক চর্চাকে নতুন করে ভাবার সুযোগ পাবেন।
১. আমরা এখনও নির্বাচনের জন্য একটি সর্বজনস্বীকৃত পন্থা খুঁজে পাওয়ার অপেক্ষায় আছি।
ষআমাদের সংবিধান অনুযায়ী সবসময়ই একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে হওয়া নির্বাচনে সেই সরকারের পরিবর্তন হয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত আমরা দেখিনি।
ষঅর্থাৎ ক্ষমতা হারানোর ভয়কে উপেক্ষা করে নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার কোনো উদাহরণ আমাদের সামনে নেই।
ষষাটের দশক থেকে শুরু করে আশির দশকের শেষ পর্যন্ত নির্বাচনকেন্দ্রিক আমাদের এসব তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই একটি অনির্বাচিত, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা জন্ম নেয়। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখার কারণেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে পূর্ববতী সরকারের পতন হয় এবং অন্য একটি দল নতুন সরকার গঠন করে।
ষতত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই ব্যবস্থা সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, আদালতের এই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা বাতিল করা হয়। পরবর্তীতে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে পুনঃমঞ্চায়িত হয় ?’৯০-পূর্ববর্তী নির্বাচনের ফলাফলের সেই ধারা, আবার সরকার গঠন করে ক্ষমতাসীনরাই।
ষআজ, ব্রিটিশ শাসন অবসানের ৬৫ বছর আর স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরও, আমাদের নির্বাচনের এমন একটি পদ্ধতি খুঁজতে হচ্ছে, যা আমাদের সংবিধান ও ইতিহাসের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে পারে। এই খোঁজা চলাকালীন আমাদের দুটি বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন; তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আমাদের পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা এবং স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে রাজনীতিবিদদের প্রচলিত ব্যবস্থা অপব্যবহারের প্রবণতা।
২. তবে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হলেই যে একটি সরকার জনগণের সরকার হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। সিপিডি’র রওনক জাহানের গবেষণাসহ অন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতামত অনুযায়ী আমাদের সংসদগুলোতে ব্যবসায়ীরা প্রভাবশালী। কেউ কেউ সংসদে আসার জন্য ব্যবসাকে ব্যবহার করছে। আবার সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় ব্যবসায়ী হয়ে উঠছে অনেকে। যার ফলে সংসদীয় রাজনীতি হয়ে উঠেছে গুটিকয়েকের স্বার্থরক্ষার একটি ব্যবস্থা। যেই ব্যবস্থায় ক্রমাগত কমছে সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব। যেমনটি ছিল পাকিস্তান শাসন আমলে।
ষএরকম একটি জনবিমুখ প্রেক্ষাপটে, সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রতিনিধিত্ব না থাকায়, ‘জনগণের দ্বারা সরকার’ এর যে ধারণা, তার প্রতিফলন হচ্ছে না একেবারেই। আর এই ধরনের প্রতিনিধিত্বহীন সরকারের কাছে জনমুখী নীতি কখনোই গুরুত্ব পাচ্ছে না।
ষতাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের শুধু সুষ্ঠু ও সবার অংশগ্রহণভিত্তিক নির্বাচন নিয়ে চিন্তা করলেই হবে না। বরং এমন একটি নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবতে হবে, যার মাধ্যমে সংসদে সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা যায়। সংখ্যাগরিষ্ঠদের জনপ্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার এই প্রয়োজনীয়তা শুধু বাংলাদেশের নয়, একই জিনিস দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, যেখানে জনগণের দোহাই দিয়ে ধনীদের দ্বারা গঠিত ধনীদের সরকার সর্বোচ্চ আদালত দ্বারা সুরক্ষিত অবস্থায় টিকে থাকে।
৩. যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম, নেতৃত্ব ও প্রতিনিধিত্ব অগণতান্ত্রিক, সেখানে একটি গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের বাস্তবতা আমাদের আরেকবার ভেবে দেখা দরকার। এই পরিস্থিতির জন্য খুব সহজেই রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দোষারোপ করা যায়। কিন্তু যে বিষয়টির গভীর পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন তা হল, কেন এবং কিভাবে দলের দ্বিতীয় সারির নেতাকর্মীরা (যাদের অনেকেরই রাজনৈতিক অঙ্গনে পদচারণা অনেক দিনের), তাদের গণতান্ত্রিক দায়িত্ববোধ বিসর্জন দিয়ে অন্ধভাবে একটি পূর্বপ্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বকে আঁকড়ে ধরে আছে।
৪. বাংলাদেশের রাজনীতির আরও একটি মৌলিক সমস্যা হচ্ছে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আদর্শগত বিরোধ। আর এ বিরোধ রুয়ান্ডার হুতু ও তুতসিদের মধ্যকার বিভেদের মতোই প্রকট। যার ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে স্বাভাবিক সংলাপের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। সংসদ বর্জনের যে সংস্কৃতি গত চারটি সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, তাতে প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে সংসদ। এতে পুরো সরকার ব্যবস্থায় বিরোধী দলের ভূমিকাহীনতা এবং সরকারি দলের একক আধিপত্যের একটি ধারা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। তাই, যে কোনো মূল্যে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়াটা রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য জীবিকা, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, এমনকি জীবন-মৃত্যুর ব্যাপার, অর্থাৎ সার্বিকভাবে অস্তিত্ব রক্ষার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ক্রমবর্ধমান সহিংস অবস্থা আমাদের রাজনৈতিক আদর্শগত বিরোধেরই বহিঃপ্রকাশ।
৫. বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সফল করার জন্য সহিংসতার আশ্রয় নেয়ার ব্যাপারটির উত্থান নিকটঅতীতে হলেও, দল, ধর্ম বা আদর্শগত বিভিন্ন দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশই এরই মধ্যে এ ধরনের সহিংসতার সম্মুখীন হয়েছে। শুধু এই এশিয়া নয়, সারা বিশ্বের বিভিন্ন সংঘাতের ইতিহাস পর্যালোচনা করে আমাদের বুঝতে হবে, সহিংসতা বন্ধে রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ভিত্তিতে, শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নাকি একে অপরকে ধ্বংস করাটাই একমাত্র পন্থা।
গণতন্ত্র চর্চা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাধা বা কাঠামোগত দুর্বলতা- কোনোটিই বাংলাদেশের একক সমস্যা নয়। দক্ষিণ এশীয় বেশির ভাগ দেশই নানাভাবে এই সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়াতে গণতন্ত্র পুরোপুরিভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য একটি আঞ্চলিক সংলাপের আয়োজন করা যেতে পারে, যা রাজনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞ সবার জন্যই একটি শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা হবে। তবে একজন বাংলাদেশী হিসেবে, একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার আশায় পাঁচ দশক পার করার পর, এখন আমার মৌলিক দাবি এমন একটি পরিবর্তন, যা আমার দেশের রাজনৈতিক অপব্যবস্থার সংশোধন করবে।
আমি অথবা আমার প্রজন্ম ‘জনগণের দ্বারা ও জনগণের জন্য’ একটি সরকার পুরোপুরিভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হইনি। আমি আশা করি, বর্তমান প্রজন্ম, আমাদের প্রজন্মের রেখে যাওয়া অমীমাংসিত প্রশ্নগুলোর কার্যকর উত্তর খুঁজে বের করতে পারবে। আর এর মাধ্যমেই লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত গণতন্ত্রের অধিকার বাংলাদেশের মাটিতে অক্ষুণ্ন থাকবে।
অনুবাদ : কোরেশী সানিন