Originally posted in dw.com on 5 May 2023
সম্প্রতি ভারতকে স্থায়ীভাবে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ৷ ভারতকে এই সুযোগ দেওয়ায় বাংলাদেশের কী লাভ হয়েছে?
ভারতের যেসব পণ্য এই বন্দরগুলো দিয়ে উঠানামা করবে, তার মধ্যে কোন নিষিদ্ধ পণ্য থাকছে কিনা, সেটা কীভাবে নিশ্চিত করা হবে? যে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটা কী ঠিক আছে? নাকি কম হয়ে গেছে? এসব বিষয় নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডির বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান৷
ডয়চে ভেলে :ভারতকে স্থায়ীভাবে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের যে সুযোগ দেওয়া হলো সেটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন? এতে কী বাংলাদেশের লাভ হল?
অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান : ভারতকে যে সুবিধা দেওয়া হয়েছে, সেটা আমাদের আগের সম্পাদিত চুক্তির আওতায়৷ এর মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে চালানোও হয়েছে৷ এটাকে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেখতে হবে৷ ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে নৌ প্রটোকল সই করেছে৷ সেই প্রটোকলের অধীনে ভারতের পণ্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নেওয়ার জন্য এই চট্টগ্রাম ও মোংলা পোর্ট ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশ সম্মত হয়েছে৷ আমার মনে হয়, এতে ভারত ও বাংলাদেশ দুই পক্ষেরই ইতিবাচক ফলাফলের সম্ভবনা আছে৷ ভারতের তো একটা সুবিধা হবেই৷ তাদের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগের যে দূরত্ব ও ব্যয় সেটা কমবে৷ শুল্ক তো নেওয়া হবে না৷ তাদের কাছ থেকে বড় কোনো আয় হবে না৷ কিন্তু বাংলাদেশের জন্য বড় যে সুবিধাটা হবে, লোডিং, আনলোডিং ও ট্রান্সপোর্ট দিয়ে ভারতের আখাউড়া বা আগরতলা এসব জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে৷ এই ট্রান্সপোর্ট ব্যবসাটা আমাদের জন্য একটা আকর্ষণের জায়গা হবে বলে আমার মনে হয়৷ লোডিং, আনলোডিং এর ব্যবসাটাও আমরা করতে পারব৷ বাংলাদেশের জাহাজ যেন এই ব্যবসাটা ধরতে পারে সেদিকেও আমাদের নজর দিতে হবে৷ সার্বিকভাবে দুই পক্ষেরই এখান থেকে ইতিবাচক ফলাফল পাওয়ার সুযোগ আছে৷
এই দুইটি বন্দরের কী সেই সক্ষমতা আছে? আর নিজেদের পণ্য উঠা-নামায় কোন সমস্যা হবে কিনা?
এখন চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ হচ্ছে৷ পায়রা বন্দর এখানে যোগ হচ্ছে৷ মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্র বন্দর হচ্ছে৷ এখন আমাদের চিন্তা করতে হবে, বন্দরের সুবিধা কিভাবে বৃদ্ধি করে সেবা খাতের রফতানি সুবিধা হিসেবে ব্যবহার করতে পারি৷ পোর্টের সক্ষমতা বৃদ্ধি করে যদি আমরা এই ব্যবসাটা ধরতে পারে তাহলে এটা আমাদের অন্য ধরনের একটা সুযোগ সৃষ্টি করে দেবে৷ তবে অবশ্যই আমাদের পোর্টে জেটি, ক্রেন, হ্যান্ডেলিং এগুলোতে বিনিয়োগ করতে হবে৷ তাদের এই বাড়তি কাজ আমাদের বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে সেটা হবে না৷ তবে যেটা হতে পারে, আশুগঞ্জ আন্তর্জাতিক নৌ বন্দর করার পর আমরা যেটা ভেবেছিলাম, ভারত থেকে এখানে জাহাজ আসবে আর ৩৫ কিলোমিটার সড়ক পথ পাড়ি দিয়ে আখাউড়া যাবে৷ কিন্তু গত ৭ বছরে এই ব্যবসার কিছুই হয়নি৷ কারণ আমরা সেখানে অবকাঠামো গড়ে তুলতে পারিনি৷ অতত্রব যদি আমরা অবকাঠামো গড়ে না তুলি তাহলে এইসব সুযোগ কেউ ব্যবহার করবে না৷ ফলে আগে তারা যেভাবে ব্যবসা করছিল, সেভাবেই করবে৷ আমাদের দুশ্চিন্তা হওয়া উচিত আমরা আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করছি কিনা ব্যবসাটা ধরার জন্য?
এর জন্য যে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে তা কি ঠিক আছে? নাকি কম হয়ে গেছে?
এই ফি দিয়ে বড় কোনো আয় হবে না৷ যেটা ধরা হয়েছে, সেটা আমাদের সংশ্লিষ্টরা নির্ধারণ করেছেন৷ এটা বড় ধরনের আয়ের কোন সোর্স না৷ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তুলনা করেই টেকনিক্যাল লোকেরা এটা ঠিক করেছেন৷
ভারতীয় পণ্য পরিবহণ করতে গিয়ে বাংলাদেশের সড়ক ও বন্দরের উপর যে চাপ পড়বে বা ক্ষতি হবে, সেটা তো বাংলাদেশকেই ঠিক করতে হবে? বাংলাদেশের সড়কগুলো কী এই চাপ নেওয়ার জন্য তৈরি কিনা?
এটা নির্ভর করবে, কতটুকু ব্যবহার হচ্ছে তার উপর৷ যদি অনেক ব্যবহার হয় তাহলে তো এর উপর চাপ পড়বে৷ আমরা জানি, অনেকগুলো সড়ক ভারতের রেয়াতি ঋণে তৈরি করা হয়েছে৷ তাদের কাছ থেকে আমরা আট বিলিয়ন ডলার তিন খাতে পেয়েছি৷ সেটা দিয়ে অনেক অবকাঠামো হচ্ছে৷ সুতরাং ভারতেরও একটা বিনিয়োগ এখানে আছে৷ তারপরও যদি অনেক বেশি ব্যবহার হয় তাহলে আমরা আলোচনা করে অবচয় ফি নির্ধারণ করতে পারি৷ এটা নির্ভর করবে বৃহত্তর সহযোগিতা কাঠামোর উপর৷ আরেকটা হতে পারে, আমরা টোল রাস্তা বানিয়ে সেখানে টোল নিতে পারি৷ ওই রাস্তা দিয়ে যেই যাবে তাকে টোল দিতে হবে৷ আশুগঞ্জ নৌ বন্দরের মতো হচ্ছে কিনা, আমরা বন্দরের সুযোগ সুবিধা বাড়াতে পারছি না এসব কিছু দেখেই পরবর্তীতে অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে৷
পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশের যানবাহন ব্যবহারের বিষয়টি কী নিশ্চিত করা হয়েছে? নাকি ভারতের পরিবহণ এখানে চলাচল করবে?
এখন যেটা হয়েছে, সেটাতে তো আমাদের পরিবহন দিয়েই করতে হবে৷ আর যদি যান চলাচল চুক্তি হয়, সেখানে বলা আছে নিজেদের পরিবহণ দিয়েই এক জায়গা থেকে পণ্য অন্য জায়গায় নিতে পারব৷ তখন আমাদের যানবাহন ভারতে যেতে পারবে, ভারতের যানবাহন এখানে আসতে পারবে৷ সেটা কিন্তু অন্য চুক্তি৷ এখন যেটা হয়েছে, জাহাজে পণ্য আসবে, সেটা ভারতেরও হতে পারে, আমাদেরও হতে পারে৷ দুই পোর্টে সেটা লোড বা আনলোড করার পর আমাদের ট্রান্সপোর্টই সেটা বর্ডার পর্যন্ত নিয়ে যাবে৷
যেসব পণ্য এই বন্দরগুলো দিয়ে উঠানামা করবে, তার মধ্যে কোন নিষিদ্ধ পন্য থাকছে কিনা, সেটা কীভাবে নিশ্চিত করা হবে?
এগুলোতে নজরদারি রাখতে হবে৷ সিলগালা বা জিপিএস নিয়েও আলোচনা হচ্ছে৷ এখন এসকোর্টের একটা বিষয় এসেছে৷ সেই ফিও নির্ধারণ করা হয়েছে৷ জিপিএস সিস্টেম লাগালে এগুলোর আর প্রয়োজন হবে না৷ অবশ্যই সিকিউরিটি একটা প্রশ্ন৷ নিষিদ্ধ পণ্য যাতে না আসে এবং সিকিউরিটির বিষয়ে আমাদের অবশ্যই নজর দিতে হবে৷ তবে আজকাল বিভিন্ন সিস্টেম আছে, ইউরোপে তো এটা নিয়মিতই হচ্ছে৷ তারপরও আমাদের যেসব সিকিউরিটির প্রয়োজন বাংলাদেশ সেটা তো নিশ্চয় করবে৷
গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় বাংলাদেশকে ভারতের স্থলবন্দর, বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে নেপাল ও ভুটানে পণ্য রপ্তানিতে বিনা মাসুলে ট্রানজিট দেওয়ার যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, সেটি কেন পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর হচ্ছে না?
এটা তো সরকার করবে না, করবে ব্যবসায়ীরা৷ অনেক সময় আমাদের এখানে তো জট লেগে যায়৷ তখন কেউ যদি সড়কপথে কলকাতায় নিয়ে, সেখানের বিমানবন্দর ব্যবহার করে, তাহলে সে সেটা করবে৷ আমাদের গার্মেন্টের পণ্য অনেক সময় দ্রুত পাঠানোর দরকার হয়৷ তখন কেউ চাইলে কলকাতা বিমানবন্দর ব্যবহার করে করতে পারবেন৷ এই সুযোগটা ভারত আমাদের দিয়েছে৷ কিন্তু আমাদের চেষ্টা করা উচিত নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে৷ একটা অপশন থাকল, যদি হঠাৎ করে প্রয়োজন হয় সেটা আমরা নেবো৷ কিন্তু এর মানে এই না যে, আমরা কিছু করলাম না, সব ব্যবসা ভারতের মাধ্যমে করব৷ এটা কোনভাবেই কাম্য হবে না৷
ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এখন ৩০টিরও বেশি পয়েন্ট উন্মুক্ত আছে৷ কিন্তু এসব জায়গায় বর্ডার লজিস্টিকস পুরানো পদ্ধতিতে মূল্যায়ন হয়৷ এগুলোকে আধুনিকায়ন করা হয়নি৷ যার ফলে পণ্যজট লেগেই থাকে৷ এসব বিষয়ে কেন সুরাহা হচ্ছে না?
এসব বিষয় দ্রুত সুরাহা করা উচিত৷ বেনাপোল, পেট্রাপোলসহ আরও দুই তিন জায়গায় ইন্টিগ্রেটেড কাস্টমস পয়েন্ট করার উদ্যোগ চলছে৷ সিঙ্গেল উইনডো করার দরকার৷ দুইটা সিস্টেমের ইন্টার অপারেটেবিলিটি নিশ্চিত করা দরকার৷ এগুলো শ্লথ গতিতে হচ্ছে৷ এর ফলে আমরা রপ্তানি সক্ষমতা হারাচ্ছি৷ আমদানিতেও আমাদের খরচ বেশি পড়ছে৷ সেটা আমার ভোক্তা, উৎপাদকের জন্য কষ্ট বাড়াচ্ছে৷ এই ৩০টির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ যেগুলো সেগুলোতে দ্রুত এসব কাজ করা দরকার৷ সমন্বিতভাবে এখানে বিনিয়োগ করা উচিত৷ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, রাজনীতিবিদেরা ভালো চুক্তি করেন৷ কিন্তু আমলা পর্যায়ে গেলে বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়৷ আবার বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনেক সময় টাকা ছাড়ের সমস্যা হয়৷ এটা থেকে যে ফল আসবে সেক্ষেত্রে আমলা পর্যায়ে অনেক সময় সঠিকভাবে অনুধাবন করা হয় না৷
কীভাবে দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক আরও ইতিবাচক ও সুন্দর হতে পারে?
ভারতীয় বিনিয়োগকে কীভাবে আকর্ষণ করে অর্থনৈতিক অঞ্চলকে আরও বেশি কার্যকর করা যায় সেটা দেখতে হবে৷ পদ্মা সেতুকে ট্রান্সপোর্ট করিডোর থেকে কীভাবে অর্থনৈতিক করিডোরে করতে পারি৷ বর্ডারের শুল্ক, অশুল্ক বাধা দূর করে আমরা যদি যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিনিয়োগ এবং ব্যবসা ও রফতানির ক্ষেত্রে ত্রিমাত্রিক সমস্যার সমাধান করতে পারি তাহলেই এসব উদ্যোগ থেকে আমরা ভালো ফলাফল পাব৷