Published in বাংলাদেশ প্রতিদিন on 16 November 2020
চীনের মুক্তবাণিজ্য চুক্তিতে সতর্ক বাংলাদেশ
ত্রিমুখী প্রভাব পড়ার আশঙ্কা
রুকনুজ্জামান অঞ্জন
আসিয়ান জোটসহ মোট ১৪টি দেশের সঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুক্তবাণিজ্য চুক্তি সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার চীন। গতকাল সিঙ্গাপুরে আসিয়ানের শীর্ষ বৈঠকের শেষ দিন এই চুক্তিটি হয়েছে। এতে আসিয়ানভুক্ত ১০টি দেশ ছাড়াও সই করেছে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। এই চুক্তির ফলে রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি) নামে নতুন যে বাণিজ্য জোট গঠন হলো তার অর্থনীতির আয়তন বিশ্বের মোট জিডিপির ৩০ শতাংশ। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নতুন এই জোট বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল গড়ে তুলবে। আর এই জোট গঠনের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে এশিয়ায় বাণিজ্যের নীতি এবং শর্ত নিয়ন্ত্রণ করবে চীন। বাণিজ্য ও বিনিয়োগে বাংলাদেশের প্রতিযোগী রাষ্ট্রগুলোর বেশিরভাগ এই চুক্তিতে থাকায় এর প্রভাব পর্যালোচনা করছে সরকারি-বেসরকারি মহল। নতুন এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশে ত্রিমুখী প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। বেসরকারি খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগে প্রতিযোগী রাষ্ট্র ভিয়েতনাম, মিয়ানমার ও কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলো এই চুক্তিতে থাকায় তারা রপ্তানি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ আকর্ষণে আরও বেশি সক্ষমতা অর্জন করবে। সরকারের সংশ্লিষ্টরা অবশ্য রপ্তানি বাণিজ্যে তেমন ক্ষতি দেখছেন না। তবে নতুন এই জোটের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
বাণিজ্যসচিব ড. মো. জাফর উদ্দীন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘চুক্তিটির পর এর খুঁটিনাটি বিষয়গুলো পর্যালোচনা করলে বোঝা যাবে বহির্বাণিজ্যে এর কী প্রভাব পড়তে পারে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আপাতত ক্ষতির আশঙ্কা করছি না। বরং চীন আমাদের যে সুবিধা (৯৭ শতাংশ পণ্যে ডিউটি ফ্রি) দিয়েছে, সেটি সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে রপ্তানি অনেক গুণ বেড়ে যাবে আমাদের।’
চীনের আরসিইপি চুক্তি প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব বলেন, ‘আমরা চাইলেও এই চুক্তিতে যেতে পারতাম না। কারণ এটি কেবল আসিয়ানভুক্ত দেশ এবং আসিয়ানের সঙ্গে যাদের মুক্ত বাণিজ্য রয়েছে তারাই অংশীদার হয়েছে। বাংলাদেশ না আসিয়ানে আছে, না তাদের সঙ্গে কোনো মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে।’
তবে আসিয়ানের একাধিক দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির বিষয়ে সরকার আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানান বাণিজ্য সচিব।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, চীনের আরসিইপি চুক্তির ফলে বাংলাদেশে তিন ধরনের প্রভাব পড়তে পারে।
(১) চুক্তিবদ্ধ দেশগুলোর মধ্যে শক্তিশালী সাপ্লাইচেইন গড়ে উঠবে, ফলে তাঁরা সস্তায় কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য সংগ্রহ করবে;
(২) এর ফলে তাঁরা আরও কম মূল্যে পণ্য রপ্তানি করবে, যেটি বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে আরও বেশি প্রতিযোগিতায় ফেলে দেবে এবং
(৩) চুক্তিবদ্ধ দেশগুলো একে অপরকে বিনিয়োগ সুবিধা দেবে, ফলে জাপান, অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ডের মতো উন্নত দেশগুলোর বিনিয়োগের বেশিরভাগই যাবে মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামের মতো দেশে, যা বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ সঙ্কুচিত করবে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, শুধু ভিয়েতনাম নয়- আসিয়ানের সদস্য হিসেবে পার্শ্ববর্তী মিয়ানমারও বাংলাদেশের চেয়ে বিনিয়োগ সক্ষমতায় এগিয়ে যাবে। কারণ দেশটিতে প্রচুর কাঁচামাল রয়েছে, বাংলাদেশের মতো তাদেরও রয়েছে সস্তা শ্রম। ফলে নিজেদের মধ্যে শক্তিশালী সাপ্লাই চেইনের কারণে বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দেবে তারা। এ অবস্থায় নতুন এই বাণিজ্য জোট আরসিইপির রুলস অব অরিজিন, শুল্ককাঠামো ইত্যাদির ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখার পাশাপাশি দেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগে সক্ষমতা আরও বাড়ানোর পরামর্শ দেন সিপিডির এই গবেষক।
২০১৬ সালে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১০টি দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র মিলে টিপিপি নামে যে অবাধ বাণিজ্য চুক্তি করেছিল, সেটি থেকে আমেরিকাকে বের করে নিয়ে যান ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফলে টিপিপির প্রভাব পড়েনি বাংলাদেশের বাণিজ্যে। এখন চীনের নেতৃত্বাধীন আরসিইপি কতটা প্রভাব ফেলবে- সেটি সময়ই বলে দেবে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।