Originally posted in মানবজমিন on 20 May 2025
দেশের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ও শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘আমলা, ব্যবসায়ী আর রাজনীতিবিদরা মিলে আওয়ামী লীগের আমলে চোরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। চোরতন্ত্র বা লুটপাটতন্ত্রে যারা যুক্ত ছিলেন, তাদের মধ্যে জড়িত রাজনীতিবিদেরা পালিয়ে গেছেন, ব্যবসায়ী গোষ্ঠীরা ম্রিয়মাণ (নির্জীব) হয়ে আছে। আর আমলারা আবার পুনরুজ্জীবিত হয়েছেন।
সোমবার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে ‘নীতি সংস্কার ও আগামীর জাতীয় বাজেট’ শীর্ষক নাগরিক প্ল্যাটফরম আয়োজিত সংলাপে এ কথা বলেন তিনি। সিপিডি ও এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফরম এ আয়োজন করে। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী, বিশেষ অতিথি ছিলেন বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী।
অর্থনৈতিক সংস্কারে সরকারের মনোযোগ কম উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমাদের সাধারণ আক্ষেপ হলো সরকারের পক্ষ থেকে অন্যান্য সংস্কারে যতখানি মনোযোগ দেয়া হয়, অর্থনৈতিক সংস্কারের ব্যাপারে অতখানি মনোযোগ আমরা দেখি না। এটা একটা বড় ধরনের সমস্যা এবং ওনারা অনুধাবন করেন না। অর্থনীতিতে যদি স্বস্তি না থাকে তাহলে অন্য কোনো সংস্কার কিন্তু স্বস্তিতে থাকবে না। তারপরও এত কিছু অসম্পূর্ণতা বা অসংগতি থাকার পরও বাজেট কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, সেটি চারটি বিষয়ের ওপর অনেকখানি নির্ভর করবে বলে মনে করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, ‘বিনিয়োগের জন্য যেসব উপাদান থাকে, এই মুহূর্তে সেগুলো আমাদের খুব বেশি উৎসাহিত করতে পারছে না। ফলে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। শ্রমিকদের মজুরি বাড়ার হার মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে নিচে। অর্থাৎ তাদের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। তাহলে আমরা অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড়াতে দেখছি কিনা, সেটি খুব বেশি শক্তি দিয়ে বলা যাচ্ছে না।’
দেবপ্রিয় বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসলেও অর্থনৈতিক বৈষম্য মোকাবিলায় তারা এখনো যথেষ্ট পদক্ষেপ নিতে পারে নাই। আমরা এমন ধরনের কাঠামোগত রূপান্তর বা ইক্যুইটি-বিরোধী পক্ষপাত হ্রাস দেখতে পাচ্ছি না, যা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় অর্থবহ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেবে। ফলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, এটা এখন জোর দিয়ে বলতে পারছি না।
তিনি আরও বলেন, সরকারের অর্থনীতি পরিচালনা কোনো ঘোষিত নীতিমালার আলোকে হচ্ছে না, তা চলছে এডহক ভিত্তিতে। যে ফিসক্যাল পলিসি নিয়ে কাজ হচ্ছে, সেটা গত সরকারের। পুরনো যে কাঠামো রয়েছে সেটাকেই ধুয়ে-মুছে কাজ করা হচ্ছে, সেটা আমাদের পছন্দ হয়নি। দ্বি-বার্ষিক পরিকল্পনা তৈরি করার সুপারিশ করা হয়েছিল। টাস্কফোর্সের যে সুপারিশ ছিল, সেটা ধরে যে গতি আসার কথা ছিল, তা আমরা দেখতে পাইনি। তিনি বলেন, ‘আমাদের যে ঐক্য প্রক্রিয়ার আলোচনা চলছে, এর ফলাফল; নির্বাচন সম্বন্ধে একটি নির্দিষ্ট পথরেখা পাওয়া; যে বিচারের কথা বলা হচ্ছে, তা আগে হবে, না পরে হবে ইত্যাদির পাশাপাশি শান্তিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার বিষয়ের ওপরে নির্ভর করবে।’
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দুই ভাগ করাটা ঠিক হয়েছে। এটা আমাদের শ্বেতপত্রের সুপারিশেও ছিল। কিন্তু যেভাবে করা হয়েছে, সেটি ঠিক হয়নি। তার মতে, আলোচনা ছাড়া পেশাজীবীদের জায়গাকে সংকুচিত করে এবং অন্যান্য স্বায়ত্তশাসনের জায়গাকে আরও বেশি নিয়ন্ত্রণে রেখে যেভাবে ভাগ করা হয়েছে, এই পদ্ধতি ঠিক হয়নি। এখন এটাকে ঠিকমতো ভাগ করাটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের মূল্যস্ফীতি কমানোর বিষয়টি মুদ্রানীতিতে এখনো প্রতিফলিত হয়নি। মূল্যস্ফীতির হার ৮ থেকে ৯ শতাংশের মধ্যে এলে আমরা একটা সিগন্যাল পাবো। এদিকে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি হারের চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেশি, অর্থাৎ তাদের প্রকৃত মজুরি কমে যাচ্ছে। জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশের নিচে আছে। এটা বাড়াতে হবে। আগামী অর্থবছরেও ১০-এর নিচে থাকছে।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, বাস্কেট কেস ধরনের পুরনো নেতিবাচক ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে দেশের উন্নয়ন ও সক্ষমতা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। একইসঙ্গে স্থিতিশীল ও ন্যায্য আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক কাঠামোর অনুপস্থিতির দিকটি তুলে ধরে তিনি বলেন, এটি আজকের দিনে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।
র্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক এম আবু ইউসুফ বলেন, ‘এবার একটা ভিন্নধর্মী বাজেট হবে বলে আমরা আশা করি। কারণ বাজেট নিয়ে আগে যারা কথা বলেছে তারা এখন বাজেট প্রণয়ন করছে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে যতগুলো কমিটি করেছে শ্বেতপত্র, টাস্কফোর্স ও কমিশন এসবের প্রতিফলন বাজেটে থাকা উচিত। কিছু প্রতিফলন এর মধ্যে দেখা গেছে, যেমন এবারের বাজেটের আকার কমছে, এডিপির আকার ও প্রকল্পের সংখ্যা কমানো হয়েছে।’ বাজেটে কর্মসংস্থানকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া উচিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘শিক্ষা, সুরক্ষা ও স্বাস্থ্যের বিষয়গুলো থাকবে। ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে রাজস্ব বাড়ানোর বিকল্প নেই।’
বিল্ড-এর সিইও ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, দেশে কর্মসংস্থান কমেছে। এটা নিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বাজেটে থাকতে হবে। বিশেষ করে শ্রমিক, স্টার্টআপদের প্রতি বাড়তি নজর দিতে হবে। তা না হলে উৎপাদন ব্যাহত হবে।