Published in যুগান্তর on Friday 26 June 2020
দুর্নীতির টাকাই পাচার হয়ে সুইস ব্যাংকে
অর্থনীতিবিদদের অভিমত
দেশ থেকে টাকা পাচারের বিষয়টি নতুন নয়। তবে গত কয়েক বছরে তা অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টে পাচারের এসব তথ্য উঠে আসছে।
সুইস ব্যাংকের রিপোর্ট তারই অংশ। অর্থ পাচারের মূল কারণ হল- সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দুর্নীতির অর্জিত টাকা দেশে রাখা নিরাপদ বোধ করছেন না।
সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের মোটা অঙ্কের অর্থের সঞ্চয় প্রসঙ্গে যুগান্তরের কাছে এমন মন্তব্য করেন দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা।
তাদের আরও অভিমত, টাকা তছরুপের তিনটি খাত। এগুলো হল- ব্যাংকিং খাত, শেয়ারবাজার এবং বৈদেশিক বাণিজ্য। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পণ্য আমদানির নামে বিদেশে পাচার করা।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের বিষয়টি গভীর উদ্বেগের। এর আগেও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা টাকা পাচারের তথ্য প্রকাশ করেছে। সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের যে টাকা রাখা হয়েছে, সেটা মূলত দুর্নীতির।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের মূলত তিনটি কারণ। এর মধ্যে প্রধান হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতি বেড়েছে বলেই অর্থ পাচারও বেড়েছে।
এছাড়া দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণেও অর্থ পাচার বাড়ছে।
তার মতে, অর্থ পাচার রোধ করতে হলে দুর্নীতি কমিয়ে আনার বিকল্প নেই। পাশাপাশি বিনিয়োগ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। নাগরিক জীবনেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি।
তার মতে, টাকা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস মিলে উদ্যোগ নিলে টাকা ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এরপর ফিরিয়ে আনা টাকা বাজেয়াপ্ত করাসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, সাধারণভাবে বাংলাদেশে একটি অদ্ভুত পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
একদিকে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ নেই। অপরদিকে তারাই হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। কী কারণে এটি হচ্ছে, তা বোঝা দরকার। তিনি বলেন, এই টাকা পাচারের কয়েকটি কারণ হতে পারে।
যেমন- তারা বিনিয়োগের পরিবেশ পাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় টিকে থাকতে পারছে না। অথবা বাংলাদেশের ভবিষ্যতের প্রতি তাদের আস্থা নেই।
সামগ্রিকভাবে কেন উচ্চবিত্তরা দেশে টাকা রাখে না, সেটি অত্যন্ত দুশ্চিন্তার বিষয়। আবার যদি এ ধরনের কাজ আইনের আওতায় না এনে প্রশ্রয় দেয়া হয়, তবে এটি বাড়তে থাকবে।
এ অবস্থার উত্তরণে আমরা বড় ধরনের সংস্কারের কথা বলছি। তার মতে, টাকা তছরুপের তিনটি খাত। এগুলো হল- ব্যাংকিং খাত, শেয়ারবাজার এবং আমদানি খাত।
এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পণ্য আমদানির নামে বিদেশে পাচার করা। ফলে খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকে।
দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, সুইস ব্যাংকের টাকা অবৈধভাবে নেয়া হচ্ছে বিধায়ই তারা প্রকাশ করছে। তিনি বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মিস ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে পাচার হয়।
এর মধ্যে রয়েছে আমদানি পণ্যের মূল্য বেশি দেখানো এবং রফতানিতে কম দেখানো। তিনি বলেন, ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে টাকা পাচার ও তার শাস্তির ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে বলা আছে।
কীভাবে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে হবে, সম্পদ বাজেয়াপ্ত এবং অপরাধীর শাস্তির কথা বলা আছে। বর্তমান আইনে পাচারকৃত অর্থের দ্বিগুণ জরিমানার বিধান রয়েছে। একইভাবে এর সঙ্গে জড়িতদের ৪ থেকে ১২ বছর কারাদণ্ডের বিধান আছে। কিন্তু আইনের বাস্তবায়ন নেই। ফলে টাকা পাচার বাড়ছে।
আর আইন বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনের কারণ এর পেছনে প্রভাবশালীরা জড়িত। তিনি বলেন, যারা অর্থ পাচার করছে, তারা কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত বা ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে- এই ধরনের সামর্থ্য রয়েছে।
ফলে এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। তবে একসময় পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনা কঠিন ছিল। বর্তমানে আর সেটি নেই। এখন চাইলে সহজেই টাকা ফিরিয়ে আনা যায়। কারণ আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে যে দেশে টাকা পাচার হয়, ওই দেশের কর্তৃপক্ষ টাকা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য।
একে বলা হয়, পারস্পরিক আইনি সহায়তা কার্যক্রম। এর মাধ্যমে সরকার চাইলে সুইস কর্তৃপক্ষ এসব তথ্য দেবে। আর এই প্রক্রিয়ায় টাকা ফিরিয়ে এনে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারলে পাচার বন্ধ না হওয়ার কোনো কারণ নেই।