Published in কালের কন্ঠ on Wednesday, 25 January 2017
টিপিপি বাতিল
বাংলাদেশে বাড়ছে স্বস্তি ও আশা
জর্জ ডাব্লিউ বুশের সময় আলোচনার সূত্রপাত। ১২ জাতির মধ্যে অগণিত বৈঠক আর দর-কষাকষি চলেছে পুরো ১০ বছর।
দেশগুলো আলোচনা-সমঝোতা করে যতই মতৈক্যে পৌঁছাচ্ছিল, ততই ভয় বাড়ছিল বাংলাদেশের। অবশেষে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্যিক চুক্তি ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) স্বাক্ষরিত হলো, তখন বাংলাদেশ, চীন, ভারতসহ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিকারক দেশগুলো চরম আতঙ্কে। আর আনন্দ বাড়তে থাকে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ, চীন ও ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের। বাংলাদেশের নাম ভুলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যেতে থাকে ভিয়েতনামের টেক্সটাইল ও বস্ত্রশিল্পে, যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত রপ্তানির আশায়। তাতে ভয় আরো বাড়ে বাংলাদেশের। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ের পর সে ভয় কাটতে থাকে তাঁর টিপিপি বাতিলের ঘোষণার পর। বাংলাদেশ সময় গত সোমবার শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়েছে টিপিপি। আর তাতে ভয় উড়ে গেছে বাংলাদেশের। বরং জিএসপি পুনর্বহালসহ আরো সুবিধা পাওয়ার আশা সৃষ্টি হচ্ছে রপ্তানিকারকদের মধ্যে।
টিপিপি বাতিলের সময় ট্রাম্প বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বহুপক্ষীয় বাণিজ্যিক চুক্তিতে থাকবে না। সে কারণে উত্তর আমেরিকার অন্য দুই দেশ কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গে কার্যকর থাকা নাফটা চুক্তি পর্যালোচনা করে বাতিল করার কথা বলেছেন তিনি। টিপিপির পর নাফটা বাতিল হলে বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটলে তাতেও স্বস্তি আশা করছে বাংলাদেশ। কারণ ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরের পথে হাঁটছেন। ফলে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে যে শুল্ক ও কোটামুক্ত রপ্তানি সুবিধা চেয়ে আসছে, তা আগামী দিনে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। আর তা না হলেও ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির ওপর এখন যে সবচেয়ে বেশি শুল্কারোপ রয়েছে, তা কিছুটা কমানো সম্ভব হতে পারে বলে মনে করছেন রপ্তানিকারকরা।
বিশ্লেষকরা এও বলছেন যে ট্রাম্পকে বুঝে ওঠা মুশকিল। তাঁর কঠোর বাণিজ্যনীতি বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকরও হয়ে উঠতে পারে। কারণ, ট্রাম্প এরই মধ্যে আমদানির ওপর শুল্ক বাড়ানোর কথা বলেছেন। সে পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের তৈরি পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়লে রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই সরকার ও রপ্তানিকারকদের এখন থেকেই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সরকারের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তুতি নিতে পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
টিপিপিতে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ব্রুনেই, চিলি, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ড, পেরু, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম। এই ১২টি দেশ বিশ্বের মোট জিডিপির ৪০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও জাপান বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের বড় ক্রেতা। এসব দেশে ভিয়েতনাম শুল্কমুক্ত সুবিধায় পোশাক রপ্তানির সুযোগ পেত। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ১৫.৬২ শতাংশ শুল্ক দিচ্ছে, ভিয়েতনাম দিচ্ছে ৮.৩৮ শতাংশ। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামকে ‘মোস্ট ফেভারড নেশন’-এর স্বীকৃতি দেওয়ায় উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্ধেক শুল্কে পণ্য রপ্তানির সুযোগ পায় দেশটি। টিপিপি কার্যকর হলে ভিয়েতনামকে এই শুল্কও দিতে হতো না। ফলে ভিয়েতনামের তৈরি পোশাক বাংলাদেশের পোশাকের চেয়ে অনেক কম দামে যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি করার সুযোগ পেত, তাতে বাংলাদেশ তার বাজার হারাত।
এ ভাবনা থেকেই ২০১৫ সালের ২৩ নভেম্বর ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে স্বাক্ষরিত বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তি বা টিকফার দ্বিতীয় বৈঠকে টিপিপিতে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ। তবে টিপিপিতে অন্তর্ভুক্তির জন্য অনেক শর্ত পূরণ করার কথা বলা হয় বাংলাদেশকে। বলা হয় এর আগে অবশ্যই জিএসপি পুনর্বহালের শর্তগুলো পূরণ করতে হবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত মেনে টিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মতো সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ড. ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে সরানোসহ নানা বিষয় নিয়ে বারাক ওবামা প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সম্পর্কে কিছুটা টানাপড়েন ছিল। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে টিকফা স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সেই টানাপড়েন কমানোর উদ্যোগ নিলেও ফল পাওয়া যায়নি। ফলে টিকফার কয়েকটি বৈঠকে জিএসপি পুনর্বহালসহ শুল্ক ও কোটামুক্ত রপ্তানি সুবিধা দাবি করলেও তা খুব একটা আমলে নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র। ফলে এসব নিয়ে কথা বলতে আগ্রহ হারায় ঢাকা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদসহ সরকারের নীতিনির্ধারকরা প্রকাশ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের বিরোধিতা করেছেন। তবে এখন ট্রাম্পের নেতৃত্বে দেশটিতে নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশ তার অবস্থান তুলে ধরে জিএসপি পুনর্বহালসহ শুল্ক ও কোটামুক্ত রপ্তানি সুবিধা দাবি করবে।
সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন কালের কণ্ঠকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর টিকফার পরবর্তী বৈঠক ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে। ওই বৈঠকে জিএসপি পুনর্বহালসহ শুল্ক ও কোটামুক্ত রপ্তানি সুবিধার জোরালো দাবি তুলবে বাংলাদেশ।
ট্রাম্পের বিজয়ের পরপরই গত ৯ নভেম্বর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ‘জিএসপি নিয়ে প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়। তাঁরা আমাদের উন্নয়নের প্রশংসা করেন। কিন্তু জিএসপি পুনর্বহাল করেন না। নানা কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার জিএসপি ফিরিয়ে দেয়নি। আশা করি, নতুন সরকার তা পুনর্বহাল করবে। ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর জিএসপি পুনর্বহালের জন্য আবেদন করা হবে। ’
টিপিপি চুক্তি বাতিল বাংলাদেশের রপ্তানির ওপর কেমন প্রভাব ফেলবে জানতে চাইলে পোশাক মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ রপ্তানিকারক সমিতির (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এতে আমাদের শঙ্কা দূর হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্যবসায়ী থেকে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। তাই তাঁর কাছ থেকে বাণিজ্যের বাধাগুলো দূর করা সম্ভব হবে বলে আমরা আশাবাদী। বিশেষ করে স্থগিত হওয়া জিএসপি পুনর্বহাল এবং সকল পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে চাই আমরা। ’
সালাম মুর্শেদী বলেন, ভিয়েতনাম পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী। কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী কোথাও বাড়তি সুবিধা পেলে তা অন্য প্রতিযোগীদের বেকায়দায় ফেলে। তাই টিপিপি হলে ভিয়েতনামের কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি একটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ত। টিপিপি বাতিল হওয়ায় সেই আশঙ্কা আর থাকছে না।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম কালের কণ্ঠকে বলেন, ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের সংরক্ষণমুলক নীতি ফুটে উঠছে। ট্রাম্প বহুমুখী আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে যাওয়ার কথা বলছেন। অর্থাৎ ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও বাণিজ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়ার নীতি গ্রহণ করছে। মার্কিন শ্রমস্বার্থও তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। তা রক্ষার জন্য তারা যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের বিশ্বের জন্য বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত পরিবেশ, শ্রম অধিকারসহ অন্যান্য বিষয়ও বিবেচনা করতে পারে। এসব নীতি কার্যকর হলে এখন বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশ যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য করতে পারছে, তা সংকুচিত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির ক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধিরও আশঙ্কা রয়েছে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের এসব সংরক্ষণমূলক নীতি বাংলাদেশের ওপর মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। টিপিপি বাস্তবায়িত হলে ভিয়েতনাম যে বাড়তি সুবিধা পেত, সেটি বাতিলের ফলে বাংলাদেশ সাময়িক স্বস্তি পাবে। তবে মার্কিন প্রশাসন সংরক্ষণমূলক নীতিতে এগোতে থাকলে শ্রমস্বার্থ রক্ষায় পরিবেশ, সুশাসন, শ্রমিক অধিকারসহ নানা বিষয়ে বিশ্বব্যাপী প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা বাংলাদেশের ওপরও পড়তে পারে। তবে বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয়। তাই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে আগামী এক বছর যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নেওয়া বিভিন্ন নীতি-পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়া।
বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিকারকদের অন্যতম ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী পারভেজ গোলাম মোয়াজ্জেমের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের জন্য শাপেবর হিসেবে কাজ করবে। কারণ, তিনি শুল্ক বাড়ানোর কথা বলেছেন। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে সর্বোচ্চ শুল্ক পরিশোধ করে। ফলে বাংলাদেশের শুল্ক বাড়ানোর আর কোনো সুযোগ নেই। বরং ভিয়েতনাম, চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের চেয়ে কম শুল্কে সেখানে উচ্চ মূল্যের পোশাক রপ্তানি করছে। ওই সব দেশের তৈরি পোশাকের ওপর শুল্ক বাড়ানোর সম্ভাবনা আছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ কম দামের পোশাক রপ্তানি করে, যেগুলোর মূল ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ। সস্তা পোশাকের ওপর শুল্ক আরো বাড়ালে তাতে এগুলোর দাম বেড়ে যাবে, তাদের সাধারণ শ্রমিকের জীবনযাত্রায় প্রভাব ফেলবে, যা ট্রাম্প চাইবেন না। বরং তথ্য-প্রযুক্তি, গাড়ি নির্মাণ, হাইটেক, ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যের ওপর ট্রাম্প প্রশাসন শুল্ক বাড়াবে।
আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাজার। তাই দেশটির সঙ্গে সুসম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ বিষয়টি উপলব্ধি করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে, ভবিষ্যতেও করবে। বাংলাদেশ জিএসপি পুনর্বহালসহ শুল্কমুক্ত সুবিধার জন্য তত্পরতা চালাবে। তাতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া না গেলেও সুসম্পর্ক বজায় রেখে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের ওপর বিদ্যমান শুল্কহার ১৫ শতাংশ থেকে কিছুটা কমাতে পারা সম্ভব হতে পারে।