Originally posted in প্রথম আলো on 6 July 2024
রপ্তানি হিসাবের গরমিলে প্রশ্নের মুখে সরকারি তথ্য–উপাত্তের বিশ্বাসযোগ্যতা
ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো রপ্তানি তথ্য সংশোধনের পর দেশের অর্থনীতির সূচকগুলোর গ্রহণযোগ্যতা আবারও বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এত দিন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে গবেষকেরা তথ্য-উপাত্তের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে যে সন্দেহ প্রকাশ করে আসছিলেন, সেটিই এখন সত্য হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও গবেষকেরা।
অর্থনীতিবিদ ও গবেষকেরা বলছেন, ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে অর্থনীতির নাজুক সময়ে নীতিনির্ধারকেরা যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেগুলোর কার্যকারিতা ও গ্রহণযোগ্যতাও এর ফলে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এ কারণে ভুল রপ্তানির তথ্যের ভিত্তিতে হিসাব করা অর্থনীতির অন্য সূচকগুলোও সংশোধন দরকার। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়, সে জন্য একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পরিসংখ্যান কমিশন গঠনেরও দাবি জানিয়েছেন কেউ কেউ।
সম্প্রতি রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) রপ্তানির তথ্য সংশোধন করা হয়েছে। তাতে গত দুই অর্থবছরের ১০ মাস করে মোট ২০ মাসে প্রায় ২৩ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার উধাও হয়ে গেছে। দুই বছরের বেশি সময় ধরে প্রকৃত তথ্য আড়াল করে ইপিবি রপ্তানির ভুল তথ্য প্রকাশ করে আসছিল। আর ইপিবির এই তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের হিসাব করে এসেছে।
এখন রপ্তানির তথ্যে গরমিল ধরা পড়ায় মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি, মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিএনপি, লেনদেনের ভারসাম্য, বিদেশি ঋণ গ্রহণের নীতি সিদ্ধান্তসহ অর্থনীতির অনেক কার্যক্রমের সূচক সংশোধনের দাবি উঠেছে।
কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে এ ভুল তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপনের বিষয়টি নিছক ভুল হিসেবে দেখতে নারাজ অর্থনীতিবিদ ও গবেষকেরা। রপ্তানিকারকেরাও এ নিয়ে ছিলেন অসন্তুষ্ট। তাঁরা বলছেন, এটি নিছক কোনো ভুল নয়, এই ঘটনা তথ্য-উপাত্তের ধারাবাহিক কারসাজিরই প্রতিফলন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরের দায়িত্বে থাকা নেতৃত্ব জেনেবুঝে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে খুশি করতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্তগুলো ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়েছে। ভুল জেনেও রাজনৈতিক নেতৃত্বে এসব পরিসংখ্যান ব্যবহার করেছে তাদের রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ে। সাময়িকভাবে এর সুফল মিললেও শেষ পর্যন্ত তা দেশের ভাবমূর্তি ও তথ্য-উপাত্তের গ্রহণযোগ্যতাকে বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে সরকারি পরিসংখ্যান ও তথ্য-উপাত্তের নৈরাজ্য ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে আমরা প্রশ্ন করে আসছিলাম। এখন সরকারি উদ্যোগেই রপ্তানির তথ্যে তার প্রমাণ মিলেছে। এ ধরনের ঘটনায় প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও সমন্বয়হীনতা এবং দক্ষ নেতৃত্বের অভাবের বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। দেরিতে হলেও রপ্তানির তথ্য সংশোধন করা হয়েছে। এখন জিডিপি প্রাক্কলন থেকে শুরু করে অর্থনীতির অন্যান্য প্রক্ষেপণ বা পরিসংখ্যানের তথ্যগুলোও হালনাগাদ করার বাধ্যবাধকতা দেখা দিয়েছে।’
তথ্য ও পরিসংখ্যানের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে পরিসংখ্যান কমিশন গঠনেরও সুপারিশ করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, সরকারি তথ্য-উপাত্ত ও পরিসংখ্যান হচ্ছে রাষ্ট্রের পঞ্চম স্তম্ভ। সেখানে বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি দেখা দিলে তা দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত করে।
গবেষকেরা বলছেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংস্থা ও গবেষকেরা আমাদের দেশের অর্থনীতিসংক্রান্ত সরকারি বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে আসছিলেন। রপ্তানি তথ্যের সংশোধন ও ২০ মাসে ২৩ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি কমে যাওয়ায় এখন তাদের মধ্যে আমাদের ভাবমূর্তি বড় প্রশ্নের মুখে পড়বে।’ তাই কীভাবে, কখন থেকে এবং কেন এ ধরনের ভুল তথ্য প্রকাশ শুরু হয়েছে, তা খতিয়ে দেখার দাবি করছেন গবেষকেরা।
এ বিষয়ে গবেষণা সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনায় দেশের পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা ও ভাবমূর্তি সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে। রপ্তানির তথ্যের গরমিলের ফলে জিডিপি ও জিএনপির হিসাবও এখন সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া এত দিন যে রপ্তানির ওপর ভিত্তি করে আমরা বিদেশি ঋণ গ্রহণ ও সরকারিভাবে জ্বালানিসহ যেসব কেনাকাটা করছিলাম, সেগুলোর ক্ষেত্রেও এখন নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কী করছে
গত বুধবার প্রকৃত রপ্তানির ভিত্তিতে তথ্য প্রকাশ শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে ইপিবি, এনবিআর ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা বৈঠক করে এ বিষয়ে একমত হন। বৃহস্পতিবার দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিষয়টি নিয়ে গত বৃহস্পতিবার ইপিবির শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটো। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, এখন থেকে একক কোনো সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে ইপিবি আর রপ্তানির তথ্য প্রকাশ করবে না। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের তথ্য সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাইয়ের পর প্রকৃত রপ্তানির তথ্য প্রকাশ করা হবে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাই থেকে এ উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, ‘রপ্তানিকারক সমিতি, এনবিআর, শিপিং অ্যাসোসিয়েশন, রপ্তানিকারক দেশের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের তথ্য যাচাই-বাছাই করে এখন থেকে প্রকৃত রপ্তানির তথ্য প্রকাশ করা হবে। ভবিষ্যতে যাতে রপ্তানির তথ্য নিয়ে কোনো বিভ্রান্তি দেখা না দেয়, সে জন্য দেশি-বিদেশি গবেষক, গবেষণা সংস্থার পরামর্শ ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদাহরণ কাজে লাগিয়ে নতুন পদ্ধতি চালু করা হবে। এ জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেব আমরা।’ চলতি মাস থেকে রপ্তানির একক সংস্থানির্ভর কোনো তথ্য ইপিবি প্রকাশ করবে না বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।
দায় কার
গবেষকেরা বলছেন, ইপিবির পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডেরও (এনবিআর) দায় রয়েছে তথ্য-উপাত্তের এই গরমিলের পেছনে। এসব সংস্থার যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা এ দায় এড়াতে পারেন না। রাজনৈতিক নেতৃত্বকে খুশি করতে এ ধরনের পরিসংখ্যান কারসাজি করা হয়েছে বলে মনে করেন তাঁরা।
এ বিষয়ে মাশরুর রিয়াজ বলেন, অতীতে বাংলাদেশ ব্যাংক রপ্তানির হিসাব করত রপ্তানি আয়ের প্রকৃত তথ্যের ভিত্তিতে। দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত এই ব্যবস্থা বাদ দিয়ে হঠাৎ করে কয়েক বছর ধরে ইপিবির তথ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে সংস্থাটি। ফলে লেনদেন ভারসাম্যসহ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ধাক্কা এসে লেগেছে। কারণ, যে পরিমাণ রপ্তানি দেখানো হচ্ছিল, প্রকৃত অর্থে সেই পরিমাণ আয় দেশে আসছিল না।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘ভুল তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে কোনো নীতি সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে সেটিও ভুল হয়। ২০২৬ সালে আমরা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে বেরিয়ে যাব। এত দিন রপ্তানির তথ্যে আমাদের যে সক্ষমতার কথা বলা হচ্ছিল, এখন এসে দেখা যাচ্ছে সেই সক্ষমতা কম। ফলে এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে রপ্তানি খাত বড় ধরনের ধাক্কা খাবে।’