তরুণদের প্রশিক্ষণ ও অর্থ সহায়তা প্রদান করে তাদের কর্মশক্তিতে যুক্ত করা প্রয়োজন – ফাহমিদা খাতুন

Originally posted in বণিকবার্তা on 10 November 2024

বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন ১৭ কোটি ৪৭ লাখ

কভিডের পর জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি বেড়েছে

২০২৩ সাল শেষে দেশে নারীর সংখ্যা ছিল পুরুষের তুলনায় ৩২ লাখ ২০ হাজার বেশি। বর্তমানে এ ব্যবধান ৪০ লাখের কাছাকাছি বলে অনুমান করা হচ্ছে

ছবি : বণিক বার্তা

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে ২০২৩ সালে দেশে মোট জনসংখ্যা ছিল ১৭ কোটি ২৯ লাখের কিছু বেশি। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ১৭ কোটি ৪৭ লাখে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে ২০২৩ সালে দেশে মোট জনসংখ্যা ছিল ১৭ কোটি ২৯ লাখের কিছু বেশি। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে ১৭ কোটি ৪৭ লাখে। অতীতে বাংলাদেশে জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির গতি ক্রমেই শ্লথ হতে দেখা গেলেও পরিস্থিতিতে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে কভিড-১৯ মহামারীর পর থেকে। ওই সময় থেকে বাংলাদেশে জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির হার আবারো ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠেছে।

জাতিসংঘের ডিপার্টমেন্ট অব ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্সের অধীন পপুলেশন ডিভিশনের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশের জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির গতি ছিল নিম্নমুখী। কিন্তু এর পর থেকে তা আবারো বাড়তে শুরু করেছে। ২০১৯ সালে প্রবৃদ্ধির হার ছিল দশমিক ৮৫ শতাংশ, যা ২০২১ সালের মধ্যে দশমিক ৮২ শতাংশে নেমে আসে। কিন্তু পরের বছরই তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশে। ২০২৩ সালে তা আরো বেড়ে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ হয়েছে। ২০২৪ সালে এর প্রাক্কলিত হার ১ দশমিক ২২ শতাংশ। আর বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দুই শুমারির মধ্যকার সময় জনসংখ্যা বৃদ্ধির গড় বার্ষিক হার ছিল ১ দশমিক ১২ শতাংশ। সে অনুযায়ী, বর্তমানে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার দুই শুমারির মধ্যকার সময়ের গড় হারকেও ছাড়িয়ে গেছে।

দেশে এখন পুরুষের চেয়ে নারী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধির হার তুলনামূলক বেশি। ২০২৩ সাল শেষে দেশে নারীর সংখ্যা ছিল পুরুষের তুলনায় ৩২ লাখ ২০ হাজার বেশি। বর্তমানে এ ব্যবধান ৪০ লাখের কাছাকাছি বলে অনুমান করা হচ্ছে। দেশে এখন কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। যদিও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো দূর করা যায়নি এখনো। এসব বিপত্তি দূর করতে না পারলে সামনের দিনগুলোয় দেশের নারীপ্রধান কর্মশক্তিকে কাজে লাগিয়ে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড (জনমিতিক লভ্যাংশ) আদায় করা বাংলাদেশের জন্য আরো কঠিন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

আবার বিবিএসের প্রকাশিত জনসংখ্যার তথ্য নিয়েও বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন উঠেছে। সংস্থাটির প্রকাশিত পরিসংখ্যান নিয়ে বরাবরই আপত্তি জানিয়েছেন দেশের অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন খাতের বিশেষজ্ঞরা। বিশেষ করে গত এক দশকের বেশি সময় সংস্থাটি প্রকাশিত অর্থনীতি ও জনমিতি সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সবচেয়ে বেশি। সংশ্লিষ্ট খাতের নীতিনির্ধারণী সরকারি অন্যান্য সংস্থার তথ্যের সঙ্গেও বিবিএসের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে বিস্তর ফারাক।

এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনমিতিক পরিসংখ্যানে ভুল বা অসম্পূর্ণ তথ্য থাকলে তা মাথাপিছু আয় থেকে শুরু করে বাজারে পণ্যের প্রকৃত চাহিদা নিরূপণ পর্যন্ত অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রকেই প্রভাবিত করে থাকে। বর্তমানে বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির অন্যতম প্রধান কারণ প্রকৃত চাহিদা, প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারা। প্রকৃত জনসংখ্যার তথ্য না থাকলে তা নিরূপণ করা সম্ভব হয় না।

যদিও বিবিএসের জনমিতিক পরিসংখ্যান নিয়ে ওঠা প্রশ্নগুলো নেহাতই অনুমানভিত্তিক বলে মনে করছেন সংস্থাটির মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘জনসংখ্যা নিয়ে নতুন করে কনফিউশন তৈরির কিছু নেই। এটা মানসিক অনুমান থেকে বলা হচ্ছে। ২০২২ সালে আমরা জনশুমারি করেছি। সেখানে সবাইকে কাউন্ট করে জনসংখ্যার হিসাব দেয়া হয়েছে। কিন্তু পরিবর্তিত সময় অনেকেই বলছে তা আরো অনেক বেশি। এটা নিতান্তই অনুমান।’

দেশের জনসংখ্যায় তরুণদের হার এখন সবচেয়ে বেশি। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্যমতে, বাংলাদেশ এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড আদায় করে নেয়ার জন্য খুবই সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু এ তারুণ্যনির্ভর জনগোষ্ঠী বা জনমিতিক সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে তা লভ্যাংশে রূপ দিতে পারছে না বাংলাদেশ।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ এবং থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘আমাদের দেশের জনসংখ্যায় এখন ২৬ বছর বয়সী তরুণদের হার সবচেয়ে বেশি। তরুণদের সংখ্যা বাড়লেও তাদের কর্মসংস্থান দেয়া যাচ্ছে না। ফলে তারা নিজের জন্য কাজ করে কিছু করতে পারছে না। আবার দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখারও সুযোগ পাচ্ছে না। কিন্তু ২০৩৫ থেকে ৪০ সালের পর তারুণ্যনির্ভর বাংলাদেশ আর থাকবে না। কর্মক্ষম জনসংখ্যাকে তখন সেভাবে কাজে লাগানো যাবে না। তাই জনমিতির সুবিধা বা ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড লাভের জন্য এখন তরুণদের প্রশিক্ষণ ও অর্থ সহায়তা দিয়ে কর্মে যুক্ত করা প্রয়োজন।’

দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের হার এখন নিম্নমুখী। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ডাটাবেজ সিইআইসি ডাটার তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের হার (লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন রেট) ছিল ৫৮ দশমিক ৭৯ শতাংশ। ২০২৩ সাল শেষে তা নেমে এসেছে ৫৮ দশমিক ১৬ শতাংশে। তরুণদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ বাড়াতে না পারলে বাংলাদেশ জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জন করতে পারবে না বলে আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের।

তারুণ্যনির্ভর জনশক্তিকে কাজে লাগাতে বিনিয়োগ ও নীতিগত অনেক পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) ও অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়েমা হক বিদিশা। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমরা জনমিতির একটা সুবিধার মধ্যে আছি। এটিকে যদি লভ্যাংশ করতে চাই তাহলে আমার সুযোগ-সুবিধার জন্য শুধু যে বয়সের গঠন থাকলে হবে, তা নয়। পাশাপাশি যে জনমিতি, যে তরুণ শক্তি; তাদেরও শিক্ষিত, দক্ষ এবং কর্মক্ষম হওয়া জরুরি। আমাদের কিন্তু জনমিতি লভ্যাংশ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। তরুণদের ক্ষেত্রে বেকারত্বের হার, শ্রমশক্তিতে যুক্ত হওয়া, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের দিক থেকে যে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা দরকার, সেটি থাকলেও আমরা সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারিনি। এখন নীতিগত ক্ষেত্রে এ তরুণ শক্তিকে ব্যবহার করার জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির দরকার আছে। এ নিয়ে কাজ করা দরকার। গ্রামাঞ্চলভিত্তিক যেসব তরুণ রয়েছেন, শহরকেন্দ্রিক যেসব তরুণ রয়েছেন তাদের চাকরির সুযোগ ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করতে হবে। এ জায়গাগুলোয় আরো নিয়োগের দরকার আছে। আমাদের চলতি বাজেটে শিক্ষা-স্বাস্থ্যে বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল। যুব ও শ্রম মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ খুবই কম। সেই জায়গাগুলোয় বড় পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে। সেজন্য আমাদের নতুন ধরনের দিকনির্দেশনা ও নীতি-কৌশল দরকার। শিক্ষা ও কর্মসংস্থানকে টার্গেট করে সরকারের নীতি ও বরাদ্দ বণ্টন নতুনভাবে করার দরকার আছে।’

দেশে এখন পুরুষের চেয়ে নারী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বৃদ্ধির হার তুলনামূলক বেশি। ২০২৩ সাল শেষে দেশে নারীর সংখ্যা ছিল ৮ কোটি ৮০ লাখ ৭০ হাজার। আর পুরুষের সংখ্যা ছিল ৮ কোটি ৪৮ লাখ ৫০ হাজার। সে অনুযায়ী ২০২৩ সাল শেষে দেশে নারীর সংখ্যা ছিল পুরুষের তুলনায় ৩২ লাখ ২০ হাজার বেশি। বর্তমানে নারী ও পুরুষের সংখ্যা কত সে বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ না হলেও বিভিন্ন গাণিতিক মডেল পর্যালোচনায় বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ ব্যবধান আরো বেড়েছে। অনুমান করা হচ্ছে এ ব্যবধান ৪০ লাখের কাছাকাছি।

কর্মক্ষেত্রে সমান দক্ষতা ও মেধার পরিচয় রেখে চলেছেন বাংলাদেশের নারী ও পুরুষরা। যদিও বাংলাদেশে অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো দূর করা যায়নি এখনো। নানা ধরনের মানসিক ও পারিপার্শ্বিক বাধা দূর করার পাশাপাশি নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতে এখনো তেমন একটা অগ্রগতি দেখা যায়নি। এসব বিপত্তি দূর করতে না পারলে সামনের দিনগুলোয় দেশের নারীপ্রধান কর্মশক্তিকে কাজে লাগিয়ে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড (জনমিতিক লভ্যাংশ) আদায় করা বাংলাদেশের জন্য আরো কঠিন হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

সামনের দিনগুলোয় অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের চ্যালেঞ্জগুলোকে দূর করা না গেলে বাংলাদেশের জন্য ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অর্জন আরো কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘শ্রমবাজারের সার্বিক যে অবস্থা, সেখানে শিক্ষিত শ্রমিকের আনুষ্ঠানিক জায়গা কম। এর ফলে গ্র্যাজুয়েট বিশেষ করে টারশিয়ারি পর্যায়ের শিক্ষিত গ্র্যাজুয়েটদের জেন্ডার সুবিধা না থাকাটা শ্রমবাজারে নারীর পিছিয়ে পড়ার একটা কারণ। সমাজ এখনো নারীকে তেমন ভূমিকায় দেখতে প্রস্তুত নয়। মেডিকেলে নারীর সংখ্যা অনেক, কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে তাদের অংশগ্রহণ খুব কম। নারীকে নির্দিষ্ট পেশায় পাঠাতে চায় পরিবার ও সমাজ। নারীকে সব পেশার উপযুক্ত ভাবতে সমাজ এখনো প্রস্তুত হয়নি। আবার অনেক নারীই শ্রমবাজারে আসতে পারে না, কারণ সেখানে তাকে প্রাতিষ্ঠানিক যে সুবিধা দেয়ার কথা, সেটা সে পায় না। উদাহরণস্বরূপ প্রতিষ্ঠানগুলোয় বাচ্চাদের জন্য ডে কেয়ার সেবাগুলো এখনো তৈরি হয়নি। যতটুকু সেবা তৈরি হয়েছে, সেটুকুও আবার অফিস চলাকালের জন্য মাত্র। মানসিক পরিবর্তনগুলো নিশ্চিত করতে না পারলে তা সমাজ ও অর্থনীতির জন্য উদ্বেগজনক হয়ে দেখা দেবে। তবে বাংলাদেশে এখন অনেক পরিবর্তন হচ্ছে। আজ থেকে ২০ বছর আগের মনমানসিকতার সঙ্গে এখন অনেক পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। যদিও সেটা খুব ধীরগতির।’

সরকারি পরিসংখ্যান প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের সব ক্ষেত্রে অনাস্থার জায়গা তৈরি হয়েছে। নীতি-নির্ধারণে ডাটার যে ভূমিকা ও গুরুত্ব, সেটা ওই অর্থে আমরা এখনো অনুধাবন করতে পারিনি। আমাদের সঠিক পরিসংখ্যান যদি না থাকে, তাহলে আমরা সঠিক সিদ্ধান্তটা কীভাবে নেব? তথ্য সংগ্রহে আমাদের যে বিনিয়োগ, সেটাও সঠিকভাবে হয় না। এ বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।’