বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দারিদ্র্য নিয়ে ভাবনা – ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

Published in যুগান্তর on Wednesday, 19 October 2016 

বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দারিদ্র্য নিয়ে ভাবনা – ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

 

khondaker_golam_moazzemসম্প্রতি বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে চরম দারিদ্র্য পরিস্থিতির হিসাব তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, অতি দারিদ্র্যের হার ১২.৯ শতাংশে নেমে এসেছে, যা ২০০৯-১০ অর্থবছরে ছিল সাড়ে ১৮ শতাংশ। সন্দেহ নেই, বাংলাদেশের অতি দারিদ্র্য পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। সংখ্যার হিসাবে ধরলে বলা যায়, সাত বছরের ব্যবধানে প্রায় ৮০ লাখ হতদরিদ্র লোক অতি দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠেছে। এটা আপনাআপনি ঘটেনি। সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতির পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অবদান রয়েছে এর পেছনে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ তাদের আয় কিছু পরিমাণে হলেও বাড়াতে পেরেছে। আগের চেয়ে ক্রয়ক্ষমতার উন্নতির সাক্ষ্য দেয় বিশ্বব্যাংকের এ পরিসংখ্যান।

বাংলাদেশে চরম দরিদ্র জনসংখ্যা কমছে- এ বিশ্লেষণ ও প্রাপ্তিটি বাংলাদেশের জন্য খুবই ইতিবাচক। নতুন হিসাব অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি প্রতি মাসে এক হাজার ২৯৭ টাকার বেশি আয় করেন, তবে তিনি হতদরিদ্র নন। বিষয়টিকে কয়েকটি দিক থেকে বিশ্লেষণ করা দরকার।

প্রথমত, বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বলা হচ্ছে, জিডিপি ১ শতাংশ পয়েন্ট বাড়লে দারিদ্র্য ১.৫ শতাংশ পয়েন্ট কমে আসে। অর্থাৎ জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির উচ্চধারা ব্যক্তি আয় বাড়িয়ে দারিদ্র্য কমাতে সহায়তা করে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবটি খুবই গুরুত্ববহ হলেও হিসাব করার ক্ষেত্রে ২০১০ সালের খানা জরিপে আয়-ব্যয়ের অন্য উপাত্তকে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি অর্থনীতির চলকগুলোকে একইভাবে প্রভাবিত করছে- এ অনুমিতি থেকে সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দারিদ্র্যের হারটি পাওয়া গেছে বলে প্রতীয়মান হয়।

প্রকৃতার্থে, দেশে দারিদ্র্য পরিস্থিতির উপযুক্ত হিসাবটি পাওয়া যেতে পারে সর্বশেষ আয়-ব্যয় খানা জরিপ থেকে। তখন মিলিয়ে দেখা যেতে পারে সংখ্যাগতভাবে প্রাপ্য হিসাব প্রকৃত পরিস্থিতির কতটুকু কাছে বা দূরে। আপাতভাবে অনুমান করা যায়, দেশে দারিদ্র্য পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হলেও উন্নতির মাপকাঠিটি এতটা সরলরৈখিক নাও হতে পারে, যা সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশ করা হচ্ছে।

দারিদ্র্য পরিস্থিতির উন্নতি হলেও উন্নতির মাপটি ক্রমশ শ্লথ হচ্ছে বলে মনে হয়। অর্থাৎ আমরা এগিয়ে চলেছি; কিন্তু মাঝে-মধ্যে থমকে থাকতে হচ্ছে। এর যৌক্তিক কারণও রয়েছে। খানা জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০০০ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে দারিদ্র্য কমেছে প্রায় ৯.২ শতাংশ, যা ২০০৫ থেকে ২০১০-এর সময় ছিল ৭.৫ শতাংশ। সর্বশেষ হিসাবে ২০১০ থেকে ২০১৬ সময়কালে হতদরিদ্র কমেছে ৪.৭ শতাংশ। অর্থাৎ দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে সমস্যার উন্নয়ন আর সরলরৈখিক থাকছে না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল- চরম দারিদ্র্যপীড়িত মানুষের সংখ্যা অধিক থাকার সময় বিভিন্ন অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ইতিবাচক অভিঘাত যত দ্রুত তাদের ওপর পড়ে, সংখ্যা কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে সে প্রভাব নিশ্চিতের ক্ষেত্রে আরও সুনির্দিষ্ট কার্যক্রমের দরকার পড়ে। মনে রাখা দরকার, দেশে এখনও দুই কোটির ওপর লোক চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছে, যাদের কাছে পৌঁছানোর অন্য সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম দরকার।

বাংলাদেশে দারিদ্র্য পরিস্থিতির বহুমাত্রিকতা রয়েছে। এখানে কয়েকটি উল্লেখ করা যায়- সর্বশেষ ২০১০-এর খানা জরিপ মতে, দেশে গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্য পরিস্থিতি শহরাঞ্চলের চেয়ে বেশ খারাপ। দেখা যাচ্ছে, শহরাঞ্চলে দারিদ্র্য পরিস্থিতি দ্রুত উন্নতি হলেও গ্রামাঞ্চলের ক্ষেত্রে তা নয়। দারিদ্র্যের মাত্রা কৃষিকাজে নিয়োজিত বিভিন্ন ধরনের সেবা, যেমন পরিবহন শ্রমিক- মূলত অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে যুক্ত মানুষের জন্য বেশি। অশিক্ষিত ও স্বল্প শিক্ষিতের মধ্যে দারিদ্র্যের প্রকোপ বেশি।

যেসব পরিবারে সদস্য সংখ্যা বেশি, সেখানে দারিদ্র্যের প্রকোপ বেশি। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডবহুল অঞ্চলের তুলনায় চর, প্রত্যন্ত এলাকায় দারিদ্র্য বেশি। যেখানে শিল্পের বিকাশ ঘটছে না কিংবা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘন ঘন ঘটে, সেখানে দরিদ্র মানুষ বেশি। কর্মসংস্থানের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। হয় নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকতে হবে কিংবা অন্যের প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ থাকতে হবে। কেবল কাজের সুযোগ থাকলে হবে না, কাজের জন্য চলার মতো আয়ও থাকতে হবে। অন্যথায়, হতদরিদ্রের সারিতে হবে অবস্থান। দেখা গেছে, বরিশাল ও রংপুর বিভাগে দারিদ্র্যের মাত্রা বেশি। সুতরাং সাম্প্রতিক দারিদ্র্য পরিস্থিতির উন্নতির জন্য, অধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির জন্য সুনির্দিষ্ট সামাজিক কর্মসূচি প্রসারের পাশাপাশি কৃষিকাজের সুযোগ ও মজুরি বৃদ্ধি, কৃষি সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো নির্মাণ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ। কৃষিপণ্য উৎপাদন বাড়লে, কিন্তু তা সংরক্ষণের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকলে কাক্সিক্ষত সুফল মেলে না। এ প্রসঙ্গে আমরা ইলিশ মাছের কথা বলতে পারি। গত কয়েকদিনে নদী-সমুদ্রে ইলিশ মাছ বেশি ধরা পড়ছে। বাজারে দাম কমে এসেছে; কিন্তু পাশাপাশি এ চিত্রও সংবাদপত্রে দেখছি- ক্রেতা না পেয়ে জেলেরা মাছ ফেলে দিচ্ছে খোলা স্থানে।

এটা লক্ষণীয় যে, চরম দরিদ্র মানুষ এখনও বিভিন্ন সুনির্দিষ্ট পকেটে আটকে আছে। উপার্জন করতে না পারা বয়স্ক নারী-পুরুষ, প্রতিবন্ধী, বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্ত নারীর পরিবার, বানভাসি, উপার্জনহীন বা স্বল্প উপার্জনক্ষম ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল- এসব ক্ষেত্রে দারিদ্র্য বেশি। এ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন অপরিহার্য; কিন্তু একই সঙ্গে জরুরি হচ্ছে সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম গ্রহণ।

মনে রাখা দরকার, বিশ্বব্যাংক প্রতিবেদনে চরম দারিদ্র্যের কথা বলা হয়েছে। আমাদের রাজধানী ঢাকা এবং অন্যান্য শহরেও দারিদ্র্য রয়েছে। হতদরিদ্র মানুষ রয়েছে দুই কোটি। এর বাইরেও অন্তত দুই কোটি লোক রয়েছে, যাদের প্রতিদিনের জীবন তেমন ভালো কাটছে না। অর্থাৎ দেশের এক-চতুর্থাংশ লোক দরিদ্র (চার কোটি) রয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনটি সংস্থাটির প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরের প্রাক্কালে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতি বছর দারিদ্র্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জনকারী একটি দেশে সফর করার অংশ হিসেবে এ পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনে সফলতার চিত্র ফুটে উঠবে। এর মাত্রা যথেষ্ট কি-না সেটা নিয়ে একাডেমিক মহলে বিতর্ক চলতে পারে। কিন্তু উন্নতি হচ্ছে এবং বিশ্ব সম্প্রদায় সেটা উপলব্ধি করতে পারছে।

একই সঙ্গে ভবিষ্যতে দারিদ্র্য বিমোচনে কোন ধরনের কার্যক্রম নেয়া যাবে তারও যৌক্তিক ভিত্তি এ থেকে পাওয়া যাবে। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংক ২০১৬-’২০ সময়ে তাদের জন্য তার পার্টনারশিপ ফ্রেমওয়ার্ক প্রস্তুত করেছে, যা তৈরি হয়েছে মূলত সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আলোকে। এখানে বিশ্বব্যাংক আগামী পাঁচ বছরের সহযোগিতার জন্য দারিদ্র্য বিমোচনকে মুখ্য উপজীব্য করেছে।

আগামী দিনে যদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখা যায়, অবকাঠামো পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো যায় এবং এ লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম গ্রহণ করা যায়, উন্নয়ন সহযোগীদের কার্যক্রম দেশের চাহিদার নিরিখে অব্যাহত থাকে, তবে দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে এসডিজি-২০৩০ (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য)-এর যে লক্ষ্য, তা বাংলাদেশ অর্জনের কাছাকাছি যেতে পারবে- এটা আশা করা যায়। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে যোগাযোগ ও জ্বালানি খাতের পরিস্থিতির উন্নতির জন্য বিশেষভাবে তাগিদ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বলা হয়েছে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির কথা। হতদরিদ্রের সংখ্যা কমে আসার চিত্র উৎসাহব্যঞ্জক। উন্নতির নতুন ধাপে পৌঁছাতে হলে এখন বিষয়টিতে আরও নজর দিতে হবে। এজন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকেও আরও বেশি সহায়তা আমরা প্রত্যাশা করি। বাংলাদেশ যদি ‘উন্নতির মডেল’ হিসেবে গণ্য হয়, তাহলে এ ধারা অব্যাহত রাখতে দরকার সর্বোচ্চ সহায়তা। তবে এর অপরিহার্য শর্তও কিন্তু সুশাসন। দুর্নীতি-অনিয়ম এখনও সমস্যা হিসেবে বিরাজ করছে এবং তা থেকে নিষ্কৃতি পেতেই হবে।

 

ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম : অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)