Published in আমাদের সময় on Tuesday, 19 September 2017
চালের দাম বেড়েছে ৩৭ শতাংশ
নয় মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে বৃদ্ধি ৬ শতাংশ
– রুমানা রাখি ও গোলাম রাব্বানী
নয় মাসে বাংলাদেশে চালের দাম বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। এ সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে মাত্র ৬ শতাংশ। অন্যদিকে অনেক দেশে চালের দাম কমলেও দেশের বাজারে প্রতিদিনই বাড়ছে। সরকারি হিসাবেই দেশে প্রতিকেজি মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫২ টাকায়। চালের এই দরও দেশের মধ্যে নতুন রেকর্ড। এই একই চাল বছরের শুরুতে বিক্রি হয়েছে ৩৮ টাকায়।
চালের দাম পর্যবেক্ষণকারী সরকারি তিনটি সংস্থার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এক বছর ধরেই ধারাবাহিকভাবে চালের দাম বেড়েছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে নয় মাসে মোটা চালের দর বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। গত এক বছরে হয়েছে দেড় গুণ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, একের পর এক ভুলনীতি গ্রহণ ও সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়ায় চালের দাম এত বেড়েছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্ন থেকে এই প্রথম চালের দাম এত বেড়েছে। এর পেছনে যথাযথ বাজার নিয়ন্ত্রণ না করা ও চালের চাহিদা নিয়ে পূর্বপরিকল্পনা না থাকাকে দায়ী করছেন তারা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে সামনে চালের দাম আরও বৃদ্ধি পাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, চালের দাম যে বৃদ্ধি পেয়েছেÑ এ নিয়ে গত কয়েকদিনে অনেক কথা বলেছি। শুধু দেশের বাজারে নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও চালের দাম বেড়েছে। এ নিয়ে কোথাও কোনো কথা হচ্ছে না।
ইতিহাসে এই প্রথম চালের দাম এত বেশি হওয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, বন্যা, কৃষিজমি কমে যাওয়া ও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধিতে বাজার কিছুটা অস্থিতিশীল। তবে এটি নিয়ে এত কথা বলার কিছু নেই। একই সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাসে চালের দাম এত বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।
দেশে চালের দাম সর্বোচ্চ : খাদ্যনীতি নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রির) হিসাবে, ২০১৬ সালের অক্টোবরে দেশের মধ্যে প্রতি কেজি চালের দর ৩৮ টাকায় উঠেছিল। যা দেশের সর্বোচ্চ চালের দাম। এর আগে ২০০৮ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রতিকেজি মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ৩৬ টাকা। এরপর ২০০৯ অবশ্য চালের দাম কমে যায়। ২০১২ সালে প্রতিকেজি চাল ২৬ টাকায় নেমে আসে। ২০১৪ সালে ৩০ এবং ২০১৫ সালে ৩৩ টাকায় ওঠে চালের দাম। ২০১৬ সালে মোটা চাল ৩৪ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
দেশের চালের বাজার : জানুয়ারি মাসে মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ৩৮ টাকায়, মিনিকেট বিক্রি হয়েছে ৪৬-৪৮ টাকা। ফেব্রুয়ারি মাসে মোট চাল ৩৮-৪০ টাকা থাকলেও দাম বেড়ে যায় মিনিকেটের। এ সময় মিনিকেট বিক্রি হয় ৫০-৫২ টাকায়। মোটা চালের দাম মার্চ মাস থেকে বাড়তে শুরু করে। মার্চে মোটা চালের দাম হয় ৪০ টাকা। এ সময় মিনিকেটের দাম হয় ৫০ থেকে ৫৩ টাকা। এপ্রিলে মোটা চালের দাম আরও ২ থেকে ৩ টাকা বেড়ে হয় ৪২ থেকে ৪৩ টাকা, মিনিকেটের দাম হয় ৫২ থেকে ৫৫ টাকা। মে মাসে মোটা চালের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫ টাকা, মিনিকেটের দাম ৫৬ টাকা। দাম বৃদ্ধির এই ধারা অব্যাহত থাকে জুন মাসেও। এই সময় মোটা চাল বিক্রি হয় ৪৮ টাকায়, মিনিকেট ৫৬ টাকায়। তবে জুলাই মাসে চালের দাম কিছুটা কমে যায়। মোটা চাল বিক্রি হয় ৪৬ টাকা ও মিনিকেট ৫৬ টাকায়। আগস্টেও দাম কমে ২ টাকা করে। এই সময় মোটা চাল ৪৪ টাকায় ও মিনিকেট বিক্রি হয় ৫৪ টাকায়; কিন্তু সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে এসে কেজিপ্রতি দাম বৃদ্ধি পায় ৮ থেকে দশ টাকা। বর্তমানে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫২ টাকায় আর মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৬৪ টাকায়।
চালের আন্তর্জাতিক দর : জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অরগানাইজেশনের (ফাও) মতে, জানুয়ারি মাসে ভিয়েতনামে প্রতিকেজি চাল বিক্রি হয়েছে ২৫.৭৬ টাকায়। ভারতে বিক্রি হয়েছে ২৭ টাকায়। পাকিস্তানে বিক্রি হয়েছে ২৭ ও থাইল্যান্ডে বিক্রি হয়েছে ২৯ টাকায়; কিন্তু বাংলাদেশে বিক্রি হয়েছে ৩৮ থেকে ৪০ টাকা দরে। একইভাবে ফেব্রুয়ারি মাসে ভিয়েতনামে, ভারত, থাইল্যান্ড ও পাকিস্তান চাল বিক্রি করেছে ২৬ থেকে ২৮ টাকা দরে। সেখানে বাংলাদেশে মোটা চালের দাম ছিল ৩৮ থেকে ৪০ টাকা। সর্বশেষ আগস্ট মাসে এসব দেশের চালের দাম ২৯ থেকে ৩০ টাকা থাকলেও বাংলাদেশে মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ৪৪ টাকা কেজিতে।
এদিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ‘এগ্রি মার্কেট’ এপ্রিল মাসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে চাল উৎপাদন হয়েছিল ১৭ কোটি ১৩ লাখ টন। এ অর্থবছরে তা কমে ১৭ কোটি ৭ লাখ টন হতে পারে। ফলে তিন বছর ধরে যেখানে চালের দর ছিল কমতির দিকে, এ বছর তা বাড়তে শুরু করেছে।
বৃদ্ধির কারণ : দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে সরকার থেকে বলা হয়েছে, দুটি বন্যা ও ব্লাস্ট রোগে দেশে ২০ লাখ টনের মতো চালের ক্ষতি হয়েছে। এতে স্বাভাবিকভাবে চালের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তবে এ ঘাটতি পূরণ করতে দুই ধাপে চালের আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২ শতাংশে আনা হয়। এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে বেসরকারি পর্যায়ে ছয় লাখ টন চাল আমদানি করা হয়েছে। আরও ১৭ লাখ টন চাল আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, শুধু বেসরকারি পর্যায়ে যে চাল আমদানি হয়েছে, তাতে কোনো সংকট হওয়ার কথা নয়। দেশে যথেষ্ট চাল আছে; কিন্তু সেই চাল ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে মজুদ রেখেছে। সরকারের মজুদ কমে যাওয়ায় চালের বাজারের পুরো নিয়ন্ত্রণ এখন অসাধু ব্যবসায়ীদের হাতে। চালের বাজারে এই অস্থিরতার পেছনে আমদানিকারক, পাইকারি ব্যবসায়ী ও মিলারদের হাত রয়েছে বলেও দাবি তাদের।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, দেশের প্রকৃত জনসংখ্যা, খাদ্যশস্য উৎপাদন ও মজুদের যথাযথ তথ্যের সমন্বয় দরকার। তাহলে আমরা চাহিদার কথা বুঝতে পারব। এখন যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়, তা মূলত ২০১১ সালের আদমশুমারির ওপর ভিত্তি করে। এ ছাড়া গত বছরই আমরা শ্রীলংকায় চাল রপ্তানি করলেও এখন সংকটে ভুগছি, যা যথাযথ পরিকল্পনার অভাবে হয়েছে।
আরও বাড়তে পারে দাম : সংশ্লিষ্টদের দাবি, এলসি খোলার পর থাইল্যান্ড থেকে চাল আমদানিতে সময় লাগে ২০-২৫ দিন। ভারত থেকে সময় লাগে ৭-১০ দিন। এদিকে সামনে আসছে দুর্গাপূজা। শোনা যাচ্ছে, এ সময় তাদের রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। ফলে চাল আসা শুরু হলেও তা আবার সাময়িকভাবে বন্ধ থাকতে পারে। এতে বাজারে চালের সরবরাহে আবারও চাপ বাড়তে পারে, যা দামকে উসকে দিতে পারে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ রাইস মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি জাকির হোসেন রনি বলেন, পরিস্থিতি এখন পাল্টেছে। প্রতিদিন বিভিন্ন বন্দর দিয়ে চাল আমদানি হচ্ছে। রবিবারই বাবুবাজার ও বাদামতলীতে পাইকারি মোটা চালের দাম কমেছে কেজিপ্রতি ২-৩ টাকা। এটি খুচরা বাজারে শিগগিরই প্রভাব পড়তে শুরু করবে। তিনি দাবি করেন, চালের দাম কমবে। তবে সেটি পাইকারি বাজারেই ৪২-৪৪ টাকার নিচে নামার সুযোগ কম। কারণ চালের আমদানি দাম ও পরিবহনখরচ বেশি পড়ছে। ব্যবসার পরিচালন ব্যয়ও বাড়ছে।