Originally posted in ডেইলি বাংলাদেশ on 23 January 2024
দ্রব্যমূল্য কেন বাড়ছে, কোন পথে সমাধান
নতুন বছরের শুরু থেকেই নানা কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার আগামী মার্চেই শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজান। এ অবস্থায় দেশের অর্থনীতিবিদসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ মনে করছেন, নতুন সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জিং হলেও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। তবে আশার কথা হলো- সরকারসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বিষয়টি নিয়ে জোরালোভাবে কাজ করছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন।
অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে জরুরি সভা করেছেন। খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার কথা বলেছেন। বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছেন, দেশে কোনো সিন্ডিকেট থাকতে পারবে না। আমরা অর্থ, খাদ্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একযোগে কাজ করছি।
মোটকথা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার একটা জোর প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কোন পথে বা কোন পদ্ধতিতে এর সমাধান সম্ভব- এমন প্রশ্নও উঠেছে বেশ জোরালোভাবে। এক্ষেত্রে দেশের অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বেশ কয়েকটি সমস্যা ও তার সমাধান সামনে এনেছেন।
তারা বলছেন, সরকারের কাছে বাজার নিয়ন্ত্রণে তিনটি হাতিয়ার রয়েছে। সেগুলো হলো- ১. পণ্যের ওপর শুল্ক-কর কমানো। ২. খোলাবাজারে পর্যাপ্ত পরিমাণে পণ্য বিক্রি বাড়ানো ও বাজার তদারকি জোরদার করা এবং ৩. বিদেশি ডলারের মজুত বাড়ানো।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে রাখতে চায় সরকার। তাই আসন্ন রমজানে নিত্যপণ্যের আমদানি সহজ করতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ডলার সরবরাহ করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ করা হয়েছে। এছাড়া চলতি সপ্তাহের শেষদিকে ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে নামানো হবে।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোও বলছে, রমজানের সময় খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। সেই লক্ষ্যে বহুমুখী পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে চায় সরকার। এগুলো হচ্ছে- বাজারমূল্য ও আয়ের মধ্যে সঙ্গতি প্রতিষ্ঠা করা, যেসব পণ্যের বাজার দেশীয় উৎপাদন ও সরবরাহকারীর ওপর নির্ভরশীল, সেগুলোর ন্যায্যমূল্য প্রতিষ্ঠা এবং ন্যায্যমূল্যে ভোক্তাদের কাছে পৌঁছানোর সর্বোচ্চ উদ্যোগ অব্যাহত রাখা, পণ্যমূল্য কমাতে উৎপাদন ব্যয় কমানোর জন্য উন্নত প্রযুক্তির সহজলভ্যতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা উৎসাহিত করা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে দ্রব্যমূল্য সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা, মুদ্রা সরবরাহ ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রধান উপায়-উপকরণ হিসেবে নীতি সুদহার ব্যবহার করা এবং নতুন পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে শুল্ককর রেয়াত ও প্রণোদনা পুনর্বিন্যাসের উদ্যোগ নেয়া। সরকারি এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নের মাধ্যমেই দ্রব্যমূল্য কমানো সম্ভব।
দেশে উৎপাদিত পণ্য, আমদানি ও চাহিদা:
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বছরে পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ২৫ লাখ টন। তার মধ্যে রোজায় চাহিদা থাকে চার থেকে সাড়ে চার লাখ টন। ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয় ছয় থেকে সাত লাখ টন। ভারত বর্তমানে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ রেখেছে। রোজার আগে ভারত পেঁয়াজ রফতানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা না তুললে দাম আরো বাড়তে পারে।
বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদা প্রায় ২০ লাখ টন। রোজায় চাহিদা থাকে পৌনে ৩ লাখ থেকে ৩ লাখ টন। স্থানীয়ভাবে ২ লাখ টনের কিছু বেশি উৎপাদিত হয়। বাকি ১৮ লাখ টন আমদানি করতে হয়। গত বছরের নভেম্বর থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০ লাখ টন ভোজ্যতেল আমদানি করা হয়েছে।
বছরে পরিশোধিত চিনির চাহিদা ১৮ লাখ টন। রোজার মাসে চাহিদা থাকে ৩ লাখ টন। সবমিলে বছরে ১৯ লাখ টন চিনি আমদানি করতে হয়। এবার ডলার সংকটের কারণে চিনির আমদানি কম হয়েছে। তবে গতবছর অক্টোবর-ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ লাখ টন চিনি আমদানি করা হয়েছে। আরো এলসি খোলা হয়েছে।
বছরে মশুর ডালের চাহিদা ৫ লাখ টন। রোজায় চাহিদা থাকে ৭০ হাজার টন। গত বছর জুন -ডিসেম্বর মাসে ৩ লাখ টন আমদানি করা হয়েছে। আরো এলসি খোলা হয়েছে।
প্রতিবছর এক লাখ টন ছোলার চাহিদার মধ্যে রোজার মাসেই লাগে ৮০ হাজার টন। স্থানীয়ভাবে সাড়ে ৬ হাজার টন ছোলা উৎপাদন হয়। গত অক্টোবর-ডিসেম্বরে ৫০ হাজার টনের মতো ছোলা আমদানি করা হয়েছে। আরো ১৫ হাজার টন ছোলা আমদানির এলসি খোলা হয়েছে। সরকার ছোলা আমদানিতে ভ্যাট কমিয়েছে। তারপরও বাজারে এর কোনো ইতিবাচক প্রভাব নেই। গত এক মাসে ছোলার দাম কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়ে ১০০ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
দেশে বছরে খেজুরের চাহিদা প্রায় ১ লাখ টন। এর মধ্যে শুধু রোজার মাসেই চাহিদা থাকে ৫০ থেকে ৫৫ হাজার টন। চলতি মাসের ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ৩০ হাজার টনের এলসি আমদানি হয়েছে। আমদানির পথে রয়েছে ১০ হাজার টন।
খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে মোট খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ২৮ লাখ ৯৬ হাজার মেট্রিক টন আর ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে উৎপাদন ছিল ৪ কোটি ৭৭ লাখ ৬৮ হাজার মেট্রিক টন। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে সারাদেশে বিভিন্ন জাতের উন্নতমানের ধান, গম, আলু, ভুট্টা, পাট, ডাল, তেল, সবজি ফসল ও মশলাবীজসহ ৪ কোটি ৮৫ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশষ্য বিএডিসির চুক্তিবদ্ধ চাষিদের মাধ্যমে উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে।
২০০৮-০৯ অর্থবছরে চাল উৎপাদন হয় ৩ কোটি ১৩ লাখ ১৭ হাজার টন। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ৪ কোটি ১ লাখ ৭৬ হাজার টন চাল। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ৪ কোটি ৪ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। ২০০৮-০৯ সালে ভুট্টার উৎপাদন ছিল ৭ লাখ ৩০ হাজার টন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা দাঁড়ায় ৬৪ লাখ ২২ হাজার টন। বর্তমানে কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবনের কারণে ধানসহ সব ধরনের ফসল উৎপাদন বেড়েই চলছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর-২০২৩ এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে আলু উৎপাদন দ্বিগুণ, ডাল উৎপাদন চারগুণ ও সবজি উৎপাদন বেড়েছে ১ কোটি ৯৬ লাখ টন। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে যেখানে সবজি উৎপাদন হয় ২৯ লাখ ৯ হাজার টন আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ২ কোটি ২৫ লাখ ৪১ হাজার টন। ২০২৩ সালে বোরোতেও বাম্পার ফলন হয়। ঐ বছর ৪৯ লাখ ৯৯ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ করা হয়। যেখানে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ কোটি ১৫ লাখ টন। এ হিসাবে বোরো উৎপাদন ২ কোটি ১৫ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে গেছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে মাংসের উৎপাদন এখন প্রায় ৭৬ লাখ মেট্রিক টন। মাছের উৎপাদন ৪৪ দশমিক ৮৮ লাখ মেট্রিক টন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, চলতি মাসের ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত খাদ্যশস্যের সরকারি মজুদ রয়েছে ১৬ লাখ ৭৯ হাজার ৯৯০ মেট্রিক টন। এর মধ্যে চাল ১৪ লাখ ৩৯ হাজার ১৯১ টন। গম ২ লাখ ২৩ হাজার ৭২৭ টন এবং ধান ১৭ হাজার ৭২ টন।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের নতুন পরিকল্পনা:
কোনো পণ্যের দাম বেশি নেয়া হলে জাতীয় তথ্য সেবা নম্বর ৩৩৩-এ অভিযোগ করা যাবে। ৩১ জানুয়ারির মধ্যে এই সেবা চালু হবে। প্রচলিত সেবার সঙ্গে ৩৩৩-এ এ সেবাটি নতুন যুক্ত হবে। নতুন একটি বাটন দেওয়া হবে। ৩৩৩ এ ফোন করে ঐ বাটন চেপে অভিযোগ জানানো যাবে। এরপর অভিযোগটি অভিযোগকারীর এলাকায় (ঘটনার এলাকা) ভোক্তা অধিদফতর, ম্যাজিস্ট্রেট, মোবাইল কোর্ট বা পুলিশের কাছে পাঠানো হবে। তারা আইন মতো ব্যবস্থা নেবেন। অভিযোগকারীকে পুরো নাম-ঠিকানা ও ফোন নম্বরসহ অভিযোগ করতে হবে। অভিযোগের ডকুমেন্ট বা প্রমাণ থাকতে হবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের আরো একটি পরিকল্পনা হচ্ছে নতুন একটি ওয়েবসাইট খোলা। সেখানে পণ্যের দাম, মজুতসহ বিভিন্ন তথ্য থাকবে বলে।
জানা গেছে, সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে নতুন একটি ওয়েবসাইট খোলা হবে। সেখানে পণ্যের দাম, মজুতসহ বিভিন্ন তথ্য থাকবে। আবার বাজারদর জানতে ও কোনো অভিযোগ থাকলে তা জাতীয় তথ্য সেবা নম্বর ৩৩৩-এ করা। প্রচলিত অন্য সেবার সঙ্গে ৩৩৩- সেবাটি নতুন যুক্ত হবে। নতুন একটি বাটন দেওয়া হবে। ৩৩৩-এ ফোন করে ওই বাটন চেপে অভিযোগ জানাতে পারবে ক্রেতাসাধারণ। এ সেবাটি ৩১ জানুয়ারির মধ্যে চালু হওয়ার কথা রয়েছে।
ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণে অর্থ, বাণিজ্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং খাদ্য- এই চারটি মন্ত্রণালয় একসঙ্গে কাজ করছে। এছাড়াও কাজ করছে খাদ্য অধিদফতর, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর এবং কৃষি বিপণন অধিদফতর। এই তিন প্রতিষ্ঠান অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি রোধে এবং এ সংক্রান্ত অপরাধে অপরাধীদের শাস্তি দিতে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৫৬, ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ এবং কৃষি বিপণন আইন ২০১৮ আইন কার্যকরের দায়িত্বে নিয়োজিত আছে।
মূল্যস্ফীতিতে দাম বৃদ্ধি, জনজীবনে যেভাবে প্রভাবিত করে:
ধানমন্ডির বাসিন্দা আমির হোসেন ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, গত বছর এই সময় চাল কিনেছি ৫৬ টাকা কেজি দরে। একই চাল এখন কিনতে হচ্ছে ৭২ টাকায়। বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ১ হাজার টাকা, যাতায়াতের খরচও বেড়েছে। এমন অবস্থায় সংসার চালাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে। মাস শেষের আগেই টাকা শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আয় বাড়েনি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির সর্বশেষ যে হিসাব দিয়েছে, তাতে দেখা যায়, গত বছরের ডিসেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ৯.৪১ শতাংশ হয়েছে। এটা গত সাত মাসে সর্বনিম্ন। এই সময়ে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। গত অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৯৩ শতাংশ। নভেম্বরে কমে হয় ৯.৪৯ শতাংশ। গত এপ্রিলে ছিল ৯.২৪ শতাংশ। কিন্তু মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯.৯৪ শতাংশ। ডিসেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে হয়েছে ৯.৫৮ শতাংশ, আগের মাসে যা ছিল ১০.৭৬ শতাংশ। কিন্তু চালের দাম বাড়তে থাকায় মূল্যস্ফীতি যে সামান্য কমে স্থিতিশীল হয়েছে, তা কতটা ধরে রাখা যাবে তা নিয়ে সংশয় আছে।
চলতি মাসের গত দুই সপ্তাহে চালের দাম রকমভেদে ২ থেকে ৬ টাকা বেড়েছে। ঢাকার বাজারে এক সপ্তাহ আগে আগে যে মোটা চালের কেজি ৫০-৫২ টাকা ছিল, তা এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৪-৫৫ টাকায়। মাঝারি মানের চালের কেজি ৫৫-৫৮ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬০-৬২ টাকা। আর মিনিকেট ও নাজিরশাইলের মতো সরু চাল ৬২-৭৫ টাকা থেকে বেড়ে ৬৮ থেকে ৮০ টাকা হয়েছে। কিছু বিশেষ ধরনের সরু চাল বিক্রি হচ্ছে আরো বেশি দামে।
এদিকে ভরা মৌসুমে শীতের সবজির দাম বেশ চড়া। গোল আলুর কেজি ৮০ টাকা। বেগুনের কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকা, বড় আকারের লাউ প্রতিটি ১০০ টাকা, টমেটোর কেজি ৬০ থেকে ৯০ টাকা, শিম ৯০ টাকা কেজি, মটরশুটি কেজি ১৫০ টাকা কেজি, ফুলকপি বড় সাইজ ৬০ থেকে ৭০ টাকা প্রতিটি, কাঁচামরিচ ১০০ টাকা কেজি, নতুন দেশি পেঁয়াজ কেজি ১০০ টাকা। গরুর মাংসের কেজি ৭০০ টাকা।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সভাপতি মো. গোলাম রহমান ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টানতে হবে। এ কাজটি শুধু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওপর নির্ভর করে না। মূলত, মুদ্রাস্ফীতির নিয়ন্ত্রণের প্রধান দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। এটি অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্ব রয়েছে।
তিনি বলেন, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিলে সিন্ডিকেট আপনা-আপনি ভেঙে যাবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। আশা করি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ মুদ্রানীতি, আর্থিক নীতি এবং রাজস্বনীতি পলিসির দ্বারা সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টেনে ধরবে। ফলে মুদ্রাস্ফীতি কমে ক্রেতার নাগালে আসবে এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসবে।
যেসব কারণে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি হয়:
উৎপাদন ও সরবরাহ কম থাকা, বাজার ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা, যথাযথ গুদামজাতকরণ না করা, আধুনিক সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থার অভাব, অতিরিক্ত আমদানিনির্ভরতা, ডলার সংকট এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মাত্রাতিরিক্ত অবমূল্যায়ন, সমগ্র সরবরাহ ব্যবস্থা গুটিকয়েক বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়া, মানসম্পন্ন ব্যাংকিং ব্যবস্থার অভাব এবং বাজারে নিয়ম ভঙ্গকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিদানের অভাব।
এ বিষয়ে অর্থনীতি সমিতির চেয়ারম্যান আবুল বারকাত চাল এবং আটার উদাহরণ টেনে ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, এ দুটি পণ্যের সঙ্গে সবজি, মাছ-মাংস ইত্যাদি মিশিয়ে মানুষ খায়। এতে চাহিদা বেড়ে যায় এবং সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণে দামও বেড়ে যায়। ফলে চাল ও আটার তুলনায় পরিমাণে কম ব্যবহৃত হলেও সেগুলোর দাম বেশি বেড়ে যাওয়ার কারণে সার্বিক খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে। এতে জনজীবনে বিরূপ প্রভাব বিস্তার পড়ছে।
তার মতে, দেশে গত ৫০ বছর ধরে শুধু চাল উৎপাদনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। বাকি খাদ্য পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিতে খুব একটা নজর দেওয়া হয়নি। ফলে বিশেষ কোনো খাদ্যের চাহিদা বেড়ে গেলেই সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়। এ কারণে দামও বেড়ে যায়।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো, গবেষক ও অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে প্রথমত সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকতে হবে। যাতে উৎপাদন, ক্রেতা ও সরবরাহের মধ্যে বেশি ফারাক না থাকে। পণ্যের সংকট দেখা দিলে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যবসায়ীদের রেজিস্ট্রারভুক্ত থাকতে হবে। সব ধরনের লেনদেন ব্যাংকের মাধ্যমে করতে হবে ও রশিদ রাখতে হবে।
দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতির জন্য ডলার সংকটকে দায়ী করে এই গবেষক বলেন, ডলার স্বল্পতার কারণে এলসি খুলতে সমস্যা হচ্ছে। অনেকেই এলসি খুলতে পারছেন না। ফলে বাজারে সবসময়ই সরবরাহ ঘাটতি থাকছে, যা পণ্যের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি করে চলেছে। আবার এই ডলার সংকটের কারণে ক্রমাগত টাকার অবমূল্যায়ন ঘটে চলেছে, যা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির অন্যতম একটি কারণ। কেননা, আগে যে পণ্যটি এক ডলার দিয়ে আমদানি করলে বাংলাদেশি মুদ্রায় ৮০ টাকা হতো, এখন সেটি দাঁড়ায় ১২০ টাকা। টাকার যত অবমূল্যায়ন হবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ততই অব্যাহত থাকবে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন না হওয়ায় আমাদের দেশের ব্যাংকের ইস্যু করা এলসি উন্নত বিশ্বের রফতানিকারকরা গ্রহণ করতে চান না। ফলে আমদানিকারকদের হংকং, সিঙ্গাপুর বা ব্যাংককে অবস্থিত মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে যেতে হয়। এ সুযোগে মধ্যস্বত্বভোগীরা পণ্যের মূল্যের ওপর নিজেদের ফি বসিয়ে দেয়। ফলে আমাদের দেশের আমদানিকারকদের বেশি ডলার দিয়ে পণ্য কিনতে হয়। অর্থাৎ আমদানিকারক যেখানে সরাসরি এক লাখ ডলার দিয়ে যে পণ্য আমদানি করতে পারতেন, সেই একই পণ্য মধ্যস্বত্বভোগীর মাধ্যমে আমদানি করায় এক লাখ ১০ হাজার ডলার লাগছে, যা পণ্যের আমদানি খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। প্রকারান্তরে দেশে দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতির পথে হাঁটছে।
সার্বিক বিষয়ে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, এবার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকারমূলক নির্দেশনা। আমরা সেভাবেই কাজ করছি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা খাদ্য উৎপাদন এবং আমদানি মনিটরিং করছি। এজন্য অর্থ, বাণিজ্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ এবং খাদ্য- চার মন্ত্রণালয় একসঙ্গে কাজ করছি। প্রয়োজনীয় খাদ্য আমদানিতে যাতে কোনো সমস্যা না হয়, কোথাও যেন কোনো সংকট সৃষ্টি না হয় সেসব আমরা দেখছি। রমজানের আগেই ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে নামবে। ভোক্তা অধিদফতর আরো সক্রিয় হচ্ছে। খাদ্য মজুত যাতে ঠিক থাকে সে ব্যবস্থা করা হবে।
তিনি বলেন, এবার আমরা রোজার আগে এবং রোজার মাঝামাঝিতে এক কোটি পরিবারকে ন্যায্যমূল্যে পাঁচটি ভোগ্যপণ্য দেবো। আমাদের খাদ্য মজুত ঠিক আছে। কোনো সংকট নেই। আমরা আমদানিকারক, সরবরাহকারী- সবার সঙ্গে প্রতি মাসেই বসবো। দেশে খাদ্য মজুত ঠিক রাখতে যা যা দরকার তা করা হবে। রমজানকে সামনে রেখে যারা মজুত করে পণ্যের দাম বৃদ্ধির চেষ্টা করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ক্যাবের সুপারিশ:
দ্রব্যমূল্য নিন্ত্রয়ণে রাখতে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরেছে। সেগুলো হলো- ১. সারাদেশে সরকারি ব্যবস্থাপনায় খাদ্যপণ্য ও খাদ্যশষ্য সরবরাহে পরিবহনের ব্যবস্থা করা। ২. যেসব খুচরা ব্যবসায়ী ছয় বা তিন মাসের ব্যবধানে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করবেন না তাদের কর সুবিধা দেওয়া। ৩. স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণের সুবিধা দেওয়া। এ ব্যাপারে একটি অনলাইন পোর্টাল ব্যবহার করা যেতে পারে, যেখানে ক্রয় করা পণ্যের মেমো সরবরাহ করার সুযোগ থাকবে। ফলে এই পোর্টালের মাধ্যমে কোন কোন ব্যবসায়ী কখন কী মূল্যে পণ্যসামগ্রী বিক্রি করছেন, তার একটি রিপোর্ট থাকবে। এক্ষেত্রে নগদবিহীন কেনাবেচা উৎসাহিত এবং জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। ৪. সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বিভাগ- যেমন অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং রাজস্ব বোর্ড ও ব্যবসায়িক সংগঠন মিলে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা, সেটি বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে। ৫. সংরক্ষণের অভাবে বছরে ৩০ শতাংশ খাদ্যপণ্য নষ্ট হয়ে যায়। যাতে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর চাপ পড়ে। এতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা হিসেবে কাজ করে। এ অবস্থায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাপ কমাতে পচনশীল খাদ্যপণ্য- যেমন আলু, মরিচ, বেগুন, পটলসহ বিভিন্ন সবজি যথাযথ সংরক্ষণের জন্য উপজেলাভিত্তিক হিমাগার স্থাপন করতে হবে। যথাযথভাবে এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হবে।