দৈনিক প্রথম আলো:
বর্তমান সরকার তার চতুর্থ পূর্ণ অর্থবছর শেষ করতে চলেছে। যদিও সরকারের পূর্ণ মেয়াদের সামগ্রিক মূল্যায়ন করার সময় এখনো আসেনি। তথাপি এ সময়কালে অর্থনীতির বেশ কিছু প্রবণতা চিহ্নিত করার সুযোগ অবশ্যই আছে। সাফল্যের সবচেয়ে বড় দিকটি হলো, সরকার অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার গড়ে ৬ শতাংশের ওপর ধরে রাখতে পেরেছে। দেশজ আয়ের অংশ হিসেবে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের পতনের ধারাকে রোধ করে ওপরের দিকে তুলতে পেরেছে, যা গত ১২ বছরের ভেতর সর্বাপেক্ষা বেশি। একইভাবে দেশজ আয়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির অংশেরও বৃদ্ধি ঘটিয়েছে। এ সময়কালের বৈদেশিক সাহায্য অবমুক্তির হার ক্রমান্বয়ে বেড়েছে, যা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির অধিকতর বাস্তবায়নে বড় ভূমিকা রেখেছে।
সরকারি বিনিয়োগের এ সম্প্রসারণে রাজস্ব আহরণের উচ্চহার একটি বড় ভূমিকা রাখে। আরও উল্লেখ্য, রাজস্ব কাঠামোতে দুটি ইতিবাচক পরিবর্তন ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট হচ্ছে। প্রথমত, রাজস্ব কাঠামোতে বৈদেশিক বাণিজ্যনির্ভর শুল্কের বিপরীতে দেশজ উৎস থেকে পাওয়া করের ভূমিকা বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয়ত, দেশজ উৎস থেকে প্রাপ্ত করের মধ্যে পরোক্ষ করের বিপরীতে প্রত্যক্ষ করের অবদান বেশি বাড়ে। অর্থাৎ মূল্য সংযোজন কর বৃদ্ধির তুলনায় আয়কর বৃদ্ধির হার ছিল বেশি।
অতিক্রান্ত সময়কালে অনাবাসী আয়ের প্রবাহ আশাতীতভাবে বৃদ্ধি পায়। বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রবাহ ছিল মোটামুটি। লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পায় বৈদেশিক মুদ্রার মজুত।
বিগত বছর মূল্যস্ফীতিও কিছুটা কমে, যদিও তা এখনো উচ্চপর্যায়ে রয়েছে। দ্রব্যমূল্যের উচ্চহারের একটি প্রতিফলন হলো তিন বছর ধরে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ের হার বাড়ছে না এবং যা গত ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। সিপিডির হিসাবে জানুয়ারি ২০০৯ থেকে এপ্রিল ২০১৩-এর মধ্যে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে ৩৮ শতাংশ।
আমরা লক্ষ করি, সরকারের উন্নয়নের ধারায় প্রথম ৩৬ মাস সময়কালে অর্থাৎ ২০০৮-০৯ অর্থবছরের শেষ ছয় মাসে, ২০০৯-১০, ২০১০-১১ এবং ২০১১-১২ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে—অর্থনীতিতে যে উদ্দীপনা ছিল তা পরবর্তী ১৮ মাসে, অর্থাৎ ২০১১-১২ অর্থবছরের শেষ ছয় মাস এবং ২০১২-১৩ সালে বেশ স্তিমিত হয়ে আসে। তাই আমরা দেখি ২০১০-১১ সালের অর্জিত ৬ দশমিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার দুই ধাপে (২০১১-১২ ও ২০১২-১৩) ৬ শতাংশে নেমে এসেছে। যদিও ২০১২-১৩ সালের জন্য ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছিল।
আমরা অনেক সময় শুনি যে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার কারণে প্রবৃদ্ধি কিছুটা কম হয়েছে বা হচ্ছে। কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে সংযুক্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির চারটি প্রধান উপাদান, যথা রপ্তানি, অনাবাসী আয়, বৈদেশিক সাহায্য ও বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ ছিল তুলনামূলক সন্তোষজনক। ২০১২-১৩ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির উৎসগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এবার কৃষি খাতের অবদান কিছুটা কমেছে—বিশেষ করে আউশের ক্ষেত্রে। এর সম্ভাব্য কারণ হলো, উৎপাদন বাড়ালেও কৃষকেরা তার যথোপযুক্ত মূল্য পাননি।
প্রাক্কলন অনুযায়ী, প্রবৃদ্ধি না হওয়ার মূল কারণ হলো ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের ধারাকে বেগবান করতে না পারা। বিদায়ী অর্থবছরে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার অনুমিত হয়েছে দেশজ আয়ের ১৯ শতাংশ, যা গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার লক্ষণ হিসেবে আমরা দেখি ঋণপ্রবাহের নিম্নগামিতা, পুঁজি পণ্যের আমদানি কমে যাওয়া এবং তৎসংশ্লিষ্ট রাজস্ব আদায় হ্রাস পাওয়া। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগকে তেজি করতে না পারার প্রথম অবস্থায় অন্যান্য কারণের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ না করতে পারা। পরে পুঁজিবাজারে ব্যাপক ধস এবং (সরকারি) বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা এ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। লক্ষণীয়, বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের হার গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
এ সময় ব্যক্তি বিনিয়োগ বাড়ানোর তথা বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নতির ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন সংস্কারমূলক পদক্ষেপ বাস্তবায়িত না হওয়ায় পরিস্থিতি রয়ে যায় হতাশাব্যঞ্জক। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ছিল পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) জন্য নির্ধারিত প্রকল্পগুলো বিন্দুমাত্র বাস্তবায়ন করতে না পারা। ফলে এ খাতে সরকারের দেওয়া বরাদ্দ বছরের পর বছর অব্যবহূত রয়ে গেছে।
সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এ সময় অভূতপূর্বভাবে ভর্তুকি ব্যয় বৃদ্ধির ফলে কিছুটা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এ ব্যয় বৃদ্ধির অন্যতম উৎস ছিল কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয় করার জন্য অর্থসংস্থানের প্রয়োজনীয়তা। দুঃখের বিষয়, বিদ্যুৎ বিভাগ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে বাজেটে প্রথমে যথাযথভাবে বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। ভর্তুকির বর্ধিত ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে সরকারকে সাময়িকভাবে হলেও ব্যাংকব্যবস্থা থেকে প্রচুর ঋণ গ্রহণ করতে হয়। এ কারণে আবার রাজস্ব ব্যয়ের মধ্যে ঋণের সুদজনিত ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে।
নতুন বাজেট
সাম্প্রতিক এসব প্রবণতার প্রেক্ষাপটে বর্তমান সরকার তার বিদায়ী বাজেট প্রস্তুত করছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তা তিনটি সরকারের অধীনে বাস্তবায়িত হবে। বর্তমান সরকার এটি প্রণয়ন করলেও একটি নির্বাচনকালীন সরকার কিছু সময় এ বাজেট ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকবে এবং নির্বাচনোত্তর সরকার এর সমাপ্তি টানবে। তাই বর্তমান সরকার যেসব বাজেটীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, এর সামান্যই বাস্তবায়নের সুযোগ থাকবে তার।
অনেকে বলেন, নতুন বাজেট হবে নির্বাচনী বাজেট। নীতিগতভাবে একটি গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতিটি বাজেটই নির্বাচনী বাজেট হওয়ার কথা। তবে শেষ সুযোগ হিসেবে এ বাজেটে সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রতীকী বরাদ্দ দেওয়ার চেষ্টা হয়তো থাকবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় কিছু নতুন প্রকল্প আসবে, অনুমোদনহীন প্রকল্পের সংখ্যাও বাড়বে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রয়োজন হলো সমাপ্তির জন্য চিহ্নিত দুই শতাধিক প্রকল্পে যথেষ্ট বরাদ্দ দেওয়া। সরকারি বেতনকাঠামোর ঊর্ধ্বমুখী পরিবর্তন ব্যয় বৃদ্ধির আরেকটি উপাদান হতে পারে। ভর্তুকি ব্যয়কে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হয়তো করতে হবে, কিন্তু দেখার বিষয় ভর্তুকি সামঞ্জস্যকরণ প্রচেষ্টায় যেন কৃষি খাত মার না খায়। বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রথাগতভাবে প্রথম কাতারে থাকবে যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। স্থানীয় সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বরাদ্দ বাড়ার কথা থাকলেও গত বছর তা কিছুটা কমে গেছে। অবশ্য এ বছর নির্বাচন সামনে রেখে এ খাতে বরাদ্দ বাড়তেও পারে। একই কারণে বাড়বে হয়তো থোক বরাদ্দ।
উন্নয়ন বরাদ্দের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো, পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য ছয় হাজার ৮০০ কোটি টাকা রাখা, যা ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বর্ধিত অঙ্কের প্রায় ৫৬ শতাংশ। বলা বাহুল্য, বছর বছর টাকার অঙ্কে বরাদ্দ দিয়ে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। উপরন্তু, এ বরাদ্দ প্রাধিকারপ্রাপ্ত খাতগুলোকে, বিশেষ করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতকে বঞ্চিত করবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বাড়লেও দেশজ আয়ের অংশ হিসেবে তা বাড়েনি, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা কমে গেছে। সরকারকে তাই অবশ্যই বৈদেশিক সাহায্য সংগ্রহ করে পদ্মা সেতু নির্মাণে একটা মিশ্র অর্থায়নের দিকে যেতে হবে। এ মুহূর্তে সরকারের হাতে রয়েছে শুধু ভারতের দেওয়া ২০ কোটি ডলার।
সরকারি চলতি উন্নয়ন ব্যয়ের সম্ভাব্য উচ্চ বৃদ্ধির বিপরীতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের সুযোগ থাকবে সীমিত। রাজস্ব-সম্পর্কিত পদক্ষেপগুলোতে কিছুটা ধারাবাহিকতা লক্ষ করা যাবে। যেমন শুল্ক-কাঠামোর কিছুটা সমন্বয় হবে যেখানে বিকাশমান দেশীয় শিল্পের কাঁচামালের ওপর আমদানি শুল্ক কমানো এবং প্রস্তুতকৃত পণ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বাড়ানো। দেখার বিষয়, ব্যক্তি বিনিয়োগ চাঙা করার জন্য কী নতুন পদক্ষেপ নেওয়া হয়। পুঁজিবাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের জন্য ভর্তুকি সুদে পুনঃ অর্থায়নের ব্যবস্থা ইতিমধ্যে ঘোষিত হয়েছে। আর নৈতিকতাবহির্ভূত ও তাৎপর্যহীন তথাকথিত “কালো টাকা সাদা” করার বিধানগুলো নির্বাচনের আগে সরকার তুলে নেবে—এটা আশা করা বোকামি।
কিন্তু আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য আনার লক্ষ্যে সরকার রাজস্ব আদায়ের হার হয়তো নির্ধারণ করবে প্রচলিত হারের বেশ ওপরে। তার পরও হয়তো ধরা হবে উচ্চাভিলাষী বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ। এরপর আয়-ব্যয়ে বাকি ঘাটতি সমন্বয় করা হবে ব্যাংক থেকে ঋণ দেখিয়ে এবং কিছুটা সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে।
নতুন বাজেটের আয়-ব্যয়ের কাঠামো অনেকটা পরাবাস্তব। কারণ, অনেক বিষয়ে ব্যয় বরাদ্দ থাকলেও তা হয়তো ব্যবহূত হবে না। ফলে অর্থের প্রয়োজন প্রকৃত বিচারে কম হবে। তাই বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। কিন্তু ভারসাম্যের এ নিম্নবিন্দুতে পৌঁছার ক্ষেত্রে রয়ে গেছে বেশ কিছু বড় ঝুঁকি। তার অন্যতম হলো রাজনৈতিক সহিংসতা, নৈরাজ্যপূর্ণ হরতাল ও নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তা। সবগুলোই বাজেট বাস্তবায়নসহ চলমান উন্নয়ন উদ্যোগকে ভবিষ্যতে বিঘ্নিত করতে পারে। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক বাজার উৎস থেকে আয় আগামী বছর ইতিবাচক থাকবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। রানা প্লাজার মতো ঘটনা বিশ্ববাজারে আমাদের নতুন প্রশ্নের সম্মুখীন করেছে। এসবের রক্ষাকবচ হয়তো বাজেটে দেওয়া সম্ভব নয়।
সামগ্রিক বিচারে একটি সংযমী, সাশ্রয়ী ও সতর্ক বাজেট হওয়াই ছিল আদর্শ। কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতার কাছে অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা হয়তো পরাভূত হবে অন্য সময়ের চেয়ে বেশি। এ পরিস্থিতিতে বাজেটপ্রণেতাদের সীমাবদ্ধতার প্রতি সহানুভূতি থাকলেও এর প্রতিফলের জন্য রয়েছে যথেষ্ট উদ্বেগ।
আশা করব, রাজনীতির বৈরী আবহাওয়াতেও ২০১৩-১৪ সালের বাজেট অর্জিত সাফল্যগুলোকে সংহত করে দেশকে উন্নয়নের পথে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: অর্থনীতিবিদ।