Originally posted in সমকাল on 16 November 2025
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো রওনক জাহান। তিনি এদেশের প্রথম নারী যিনি ষাট দশকে হার্ভার্ড থেকে পিএইচডি করেন। তাঁর গ্রন্থ ‘পাকিস্তান: ফেইলিয়র ইন ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন’ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যের স্বরূপ তুলে ধরে। দারিদ্র্য, বৈষম্য, উন্নয়ন, জেন্ডার সংবেদনশীলতা ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর গবেষণা রয়েছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাহেরীন আরাফাত

সমাজবিজ্ঞানী হিসেবে আপনি বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? এই ভিন্নমতের রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ আপনি কোথায় দেখেন?
শেখ হাসিনার ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসন, যেখানে গণতান্ত্রিক সংলাপ ও ভিন্নমতের পরিসর প্রায় বিলুপ্ত হতে বসেছিল, তাঁর পতনের পর আলোচনা, বিতর্ক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রত্যাশিত ছিল। চব্বিশের জুলাইয়ে ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম স্লোগানই ছিল, ‘কথা ক’। ২০২৪-এর আগস্টের পর থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নেতাদের জনপরিসরে উপস্থিতিতে নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে। প্রায় ১৫ বছর ধরে রাজনৈতিক অঙ্গনে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে রাখা আওয়ামী লীগ রাতারাতি দৃশ্যপট থেকে উধাও হয়ে যায়। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের শাসনামলে কোণঠাসা হয়ে পড়া তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে মাঠে হাজির হয়। জামায়াতে ইসলামী যারা আওয়ামী লীগ শাসনের সময় তাদের জনপরিসর প্রায় হারিয়ে ফেলেছিল, তারাও অন্যতম রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে হঠাৎ করেই রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করে এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার, বিশেষ করে ১৯৭২-এর সংবিধানের বড় ধরনের কাঠামোগত সংস্কার দাবি করে। তারা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তোলে।
শিক্ষার্থী এবং অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তি কর্তৃক উত্থাপিত রাষ্ট্রীয় সংস্কারের দাবিগুলো অন্তর্বর্তী সরকারকে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠনে অনুপ্রাণিত করে। এরপর একটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়, যাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন কমিশনের সুপারিশ এবং সব সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে একটি ঐকমত্য তৈরি করা। ভিন্ন মতাদর্শের রাজনৈতিক দলগুলোর সব সংস্কার প্রস্তাবে একমত না হওয়া খুবই স্বাভাবিক। আলোচনা ও বিতর্কের পরিসর নিয়ে এই মতের ভিন্নতা এবং প্রতিযোগিতা একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবেই দেখা উচিত।
আসলে আমি বিস্মিত যে, ঐকমত্য কমিশন কর্তৃক আমন্ত্রিত সব রাজনৈতিক দল গত ছয়-সাত মাস ধরে আলোচনায় অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এতগুলো সংস্কার প্রস্তাবে তারা একমত হতে পেরেছে। আমি এটিকে ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে দেখি। কয়েকটি দল এখন রাজপথে আন্দোলন শুরু করার হুমকি দিলেও তারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করারও প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে মনে হয়।
যদিও আমি রাজনৈতিক দলগুলোর এই দীর্ঘ আলোচনাকে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছি। তবে আমার কাছে যা অনুপস্থিত মনে হচ্ছে তা হলো– সংলাপ প্রক্রিয়াটি কেবল দৃশ্যপটে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পুরো সংলাপ প্রক্রিয়াটি ছিল ঢাকাকেন্দ্রিক এবং রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বকেন্দ্রিক। তৃণমূলের নাগরিকদের আসলে মতামত কী, তারা কী কী সংস্কারকে প্রাধান্য দিতে চান, তা আমরা এই আলোচনার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জানতে পারলাম না। এ ছাড়া দেশের একটি প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, দৃশ্যপটে অনুপস্থিত থাকায় সংলাপ প্রক্রিয়াতেও অনুপস্থিত ছিল। তাই সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে তাদের মতামতও জানা যায়নি। যেহেতু এসব সংস্কারে তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই, তাই ভবিষ্যতে এসব সংস্কার প্রস্তাব তারা প্রত্যাখ্যান করতে পারে।
সংস্কার প্রক্রিয়া নিয়ে কি আপনার কোনো হতাশা বা উৎকণ্ঠা রয়েছে?
গত এক বছরে আমরা সংস্কার আলোচনার যেসব বৈশিষ্ট্য দেখেছি, তা দেখে আমি কিছু কিছু বিষয়ে হতাশ হয়েছি। প্রথমত, পুরো সংস্কার সংলাপে সংবিধান, আনুষ্ঠানিক কাঠামো, আইন এবং নিয়ম পরিবর্তনের ওপর অতিরিক্ত মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। অথচ আমরা সবাই জানি, কেবল সংবিধান, আনুষ্ঠানিক কাঠামো এবং আইন পরিবর্তন করলেই মাঠ পর্যায়ে রাজনৈতিক চর্চার তেমন কোনো পরিবর্তন আসবে না। আমাদের আসল চ্যালেঞ্জ হলো, বহু বছর ধরে চলা অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চা ও সংস্কৃতির পরিবর্তন আনা। আমরা দেখেছি, আমাদের বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিগত লাভের জন্য ক্ষমতার অপব্যবহার করেন এবং নাগরিকদের কাছে কোনো জবাবদিহি ছাড়াই দায়মুক্তির সুযোগ পান। আশা করেছিলাম, ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোকে এমন কিছু পদক্ষেপের বিষয়ে একমত করাতে চেষ্টা করবে, যা নির্বাচনে টাকা ও পেশিশক্তির প্রভাব কমাতে সাহায্য করবে এবং কে জিতবে আর কে হারবে তা নির্ধারণে মূল ভূমিকা রাখবে। এর আগে আমরা বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাব করেছি, যা সংসদ সদস্যদের বিশেষ সুবিধা সীমিত করতে, আরও বেশি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে এবং ব্যক্তিগত লাভের জন্য তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করার সক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সাহায্য করবে। এই প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে– ১. সংসদ সদস্যদের শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুযোগ, বিশেষ উন্নয়ন তহবিল পাওয়া এবং তাদের নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বোর্ডের সভাপতিত্ব করার প্রথা বাতিল করা। ২. সংসদ সদস্যদের বার্ষিক আয় ও সম্পদের বিবরণী জনসমক্ষে প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা। ৩. সংসদ সদস্যদের জন্য একটি আচরণবিধি গ্রহণ করা, যার অধীনে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে সংসদ সদস্যদের স্বার্থের সম্ভাব্য সংঘাতের ক্ষেত্রগুলো ঘোষণা করা প্রয়োজন হবে। সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রী কিংবা উপদেষ্টাদের বার্ষিক আয় ও সম্পদের বিবরণী জনসমক্ষে প্রকাশ করার প্রতিশ্রুতি এর আগে কয়েকবার করা হয়েছিল। ২০০৮-এ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ এবং ২০২৪ সালে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কিন্তু এর বাস্তবায়ন আমরা কখনও দেখিনি।
বিগত সরকারের আমলে পরপর তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন হয়েছে। এবার ভিন্ন প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কেমন হতে পারে? এ ক্ষেত্রে কোনো সংকট কি দেখছেন?
যেহেতু পরপর তিনটা নির্বাচন হয়েছে, যা দেশে ও বিদেশে লোকজনের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি, যা একচেটিয়াভাবে সরকারি দল আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং বিরোধী দলকে একদমই বাইরে রাখা হয়েছে। এখন প্রধান যেটা চ্যালেঞ্জ– কীভাবে এমন একটি নির্বাচন করা যাবে, যা দেশে-বিদেশে লোকজনের কাছে বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকবে। যদি দেশের প্রধান কয়েকটি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করতে পারে কিংবা অংশগ্রহণ না করে তাহলে সেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের সম্মুখীন হবে।
এ ছাড়া আমাদের বহু বছরের অভিজ্ঞতা আছে যে ভালো নির্বাচন হলেও যারা হেরে যায়, তারাই নানা অভিযোগ তুলে নির্বাচনকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করে। এবারের নির্বাচনেও কেউ জিতবে, কেউ তো হারবে। যারা হারবে, তারা নির্বাচনকে যে বিতর্কিত করার চেষ্টা করবে না তা বলা যাবে না।
নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক ভালো হতে হবে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ এখনও কাটেনি। বহু বছর ধরে আমরা ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং দেখে অভ্যস্ত হয়েছি। যে দল হারবে তারা হয়তো বলবে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং হয়েছে। সরকার ও প্রশাসন নিরপেক্ষ ছিল না। মানুষের আস্থা অর্জন করাটাও হবে আরেকটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনের পরও অনেক সংকট সৃষ্টি হতে পারে। এর আগে আমরা কিছু নির্বাচন-উত্তর সহিংসতা দেখেছি। সব রাজনৈতিক দলকে, বিশেষ করে যে দল জিতবে তাদের অনেক সহিষ্ণু হতে হবে। নির্বাচনের পর একটা স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে আমাদের আগের চর্চা–‘উইনার টেক ইট অল’ বা যে জিতবে সব তার হবে– এই রীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আগের চর্চায় যেভাবে বিরোধী দল ও ভিন্নমতকে দমন-পীড়ন করেছে, মুখ বন্ধ করিয়ে দিয়েছে– এমন রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিহার করতে হবে।
বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতার চর্চাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? মতপ্রকাশের সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কোন গোষ্ঠী?
আমাদের দেশে যারা ক্ষমতায় নেই, তারাই আর তেমন স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করতে পারে না। তখনই তাদের নানা রকম হয়রানি কিংবা নানা কিছু ট্যাগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া আমাদের দেশে প্রান্তিক ও নাজুক গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে নারী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, জাতিগত সংখ্যালঘুরা। সমাজে সবার সমান আর্থসামাজিক ক্ষমতা নেই; আর এসব মানদণ্ডে সব মানুষের স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করার সক্ষমতা নেই। সামাজিক মাধ্যমও বেশ কিছু সংকট সৃষ্টি করছে। অনেক মিথ্যা খবর ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। যাতে রাজনীতি ও সমাজে ঘৃণা ও বিদ্বেষ বাড়ছে। রাজনৈতিক ভিন্নমতের কেউ কিছু বললেই তাকে অশালীন আক্রমণ, ট্যাগিং করা হচ্ছে। হয়রানি করা হচ্ছে, এমনকি হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। নানা কারণেই স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সংকট সৃষ্টি হচ্ছে।
রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার যুক্তি দেখিয়ে অনেক সময় মতপ্রকাশ নিয়ন্ত্রণ করা হয়?
‘রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা’ কথাটা আমাদের দেশে খুব খেলোভাবে ব্যবহার করা হয়। কেউ হয়তো সামাজিকমাধ্যমে পোস্ট করেছে কিংবা কিছু লিখেছে, তার একটা লেখার জন্য কিংবা তার মতের জন্য রাষ্ট্রের নিরাপত্তাহীনতা হচ্ছে– এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল বিষয় এবং সেটা বলতে হলে নিশ্চিত তথ্য থাকতে হবে– আসলে কী কারণে ও কীভাবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা হুমকিতে পড়েছে। আমাদের দেশে বিভিন্ন সরকার অত্যন্ত খেলোভাবে এসব কথা ব্যবহার করেছে এবং এর মধ্য দিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করেছে এবং ভিন্ন মতাদর্শী কিংবা বিরোধী দলকে নির্যাতন করেছে।
অর্থনৈতিক বৈষম্য কি সমাজকে আরও বিভক্ত করছে? অন্তর্ভুক্তির পথে এটি কতটা বাধা হয়ে দাঁড়ায়? অর্থনৈতিক বৈষম্যের রাজনৈতিক প্রতিফলন কোথায় দেখতে পান?
অর্থনৈতিক বৈষম্য নিশ্চয়ই সমাজকে আরও বিভক্ত করছে এবং সেখানে এর রাজনৈতিক প্রতিফলন স্পষ্ট। আমরা দেখছি, যে কোনো নির্বাচন করতে হলে অনেক টাকার দরকার হয়। তার মানে একমাত্র যাদের হাতে টাকা আছে, তারাই নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবে। ইউনিয়ন, উপজেলা থেকে জাতীয় সংসদে ক্রমাগত ধনী ব্যবসায়ীরা নির্বাচিত হয়ে আসতে পারছে। নির্বাচিত হয়ে আবার সেসব ধনী ব্যক্তি ক্ষমতার অপব্যবহার করে আরও ধনী হয়েছেন। অর্থনৈতিক বৈষম্য, নির্বাচন, রাজনীতির অপব্যবহারে আর্থিক দুর্নীতি– এগুলো একটা দুষ্টচক্র সৃষ্টি করেছে। আমাদের দেশে ক্রমাগত এ প্রবণতা বেড়েই চলেছে। রাষ্ট্রের সংস্কার নিয়ে কথা বলার পাশাপাশি আমাদের ভাবতে হবে কীভাবে আমরা আমাদের রাজনীতিকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে পারব, কীভাবে রাজনীতির সঙ্গে টাকা-পয়সা বানানোর সংযোগ ছিন্ন করতে পারব।
গণতন্ত্র ও অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে বৈশ্বিক ও ভূরাজনৈতিক প্রবণতা বাংলাদেশের ওপর কী প্রভাব ফেলছে?
জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে আমরা গণতন্ত্রের গুণগত উত্তরণ চাইছি। আমরা চাইছি একটা স্বচ্ছ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, স্বচ্ছ সামাজিক ব্যবস্থা। এগুলো আসলে মানুষের একটা আকাঙ্ক্ষা। তরুণ প্রজন্মের ছাত্রদের কাছেও এটা একটা আকাঙ্ক্ষা হয়ে আছে। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে তরুণ প্রজন্মের এই আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পেয়েছি সম্প্রতি নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, মাদাগাস্কার এবং আমেরিকায়।
আমরা দেখেছি গত কয়েক দশক ধরে পৃথিবীর বহু প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক দেশে গণতন্ত্রের গুণগত অবনতি হচ্ছে। সেখানকার প্রতিষ্ঠানগুলো আগের অবস্থায় থাকছে না। আমেরিকা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। সেখানে এমন এক প্রেসিডেন্ট বর্তমানে আছেন, যিনি এখন যা তা করছেন। তিনি নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী, যে কোনো লোককে হায়ার অ্যান্ড ফায়ার করছেন, ইনস্টিটিউশনগুলো দখল করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কিছুই তিনি রাখছেন না। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও আমরা সেটা দেখছি। সেখানে রাজনীতিতে হিন্দুত্ব নিয়ে তারা দেশটির সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে প্রান্তিক করে তুলছে। আসলে এখন পুরো পৃথিবীতেই উদার গণতন্ত্র সংকটে পড়েছে। এই সংকটের ফলে নাগরিক অধিকার, সমতা, ব্যক্তিস্বাধীনতার মতো বিষয়গুলো খর্ব হচ্ছে। সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বদলে ধনী আরও ধনী হচ্ছে, গরিব আরও বেশি গরিব হয়ে যাচ্ছে। একদিকে বৈষম্য বেড়ে চলেছে এবং অন্যদিকে শুধু উচ্চবিত্তের হাতে ক্ষমতা চলে যাচ্ছে। গোটা পৃথিবীতে গণতন্ত্র যে সংকটে পড়েছে, বাংলাদেশেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সেই সংকট রয়েছে। আমরা একদিকে গণতন্ত্র ও ন্যায্যতার কথা বলছি, অন্যদিকে আমাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েই চলেছে। নির্বাচনী রাজনীতি এখনও অর্থ এবং পেশিশক্তির প্রভাবমুক্ত নয়।
নতুন প্রজন্মের ভূমিকা আপনি কেমন দেখছেন?
পুরোনো প্রজন্ম পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে যাবে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের আকাঙ্ক্ষা আছে। তা বাস্তবায়ন করতে কী ধরনের নীতি ও কৌশল দরকার, সেখানে তাদের নিজেদের ভূমিকা কী রকম হবে, এটা নিয়ে তাদের ভাবতে হবে। সবার আগে নিজেদের জবাবদিহিতার ভেতরে আনতে হবে। আমরা বা আমি যে কার্যকারণ করছি, সেই কাজ আমরা কতটা ন্যায়সংগতভাবে করছি? প্রত্যেকে যার যার জবাবদিহি নিশ্চিত করলে, গণপরিসর এমনিতেই গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠে। আমরা অন্যের দায়বদ্ধতা চাইছি, কিন্তু আমি নিজেও যে দায়বদ্ধ সেই বোধ বেশি জরুরি। আমার মনে হয়, নিজের কাজ স্বচ্ছ রাখতে পারাই আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।



