Originally posted in দেশ রুপান্তর on 9 February 2023
শর্তের মাশুল ভোক্তার ঘাড়ে
নতুন করে কোনো খাতেই আর শুল্ক ও ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া যাবে না। বর্তমানে যেসব খাতে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া আছে, তা কমাতে হবে বা তুলে নিতে হবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এসব শর্ত মেনেই ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ। শর্ত না মানলে ঋণের কিস্তি দেওয়া বন্ধ করে দিতে পারে প্রতিষ্ঠানটি।
অর্র্থনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, যেসব খাতে বা পণ্যে শুল্ক ও ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা আছে অর্থাৎ শুল্ক-ভ্যাট আরোপ নেই বা কম ধরা হয়েছে, সেসব খাত থেকে এ সুবিধা কমানো বা তুলে নেওয়ার মানেই হলো নতুনভাবে শুল্ক-ভ্যাট যোগ হওয়া। নতুন শুল্ক-ভ্যাট যোগ হওয়া মানেই হলো উৎপাদন ও আমদানিতে খরচ বাড়বে। যা শেষ পর্যন্ত পণ্যের মূল্যের সঙ্গে যোগ হবে এবং ক্রেতাকেই দিতে হবে। বৈশি^ক অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে দেশের পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির যে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা তা আরও বাড়বে, যা ভোক্তার দুর্দশা আরও বাড়াবে।
বৈশি^ক অর্থনীতির মন্দার প্রভাবে দেশের অর্থনীতিতেও অস্থিরতা চলছে। ডলার সংকট বাড়ছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে। এলসি বা ঋণপত্র খোলায় কড়াকড়ি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দেশের রিজার্ভ তলানিতে। আর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠতে আইএমএফের কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার অংশ হিসেবে রাজস্ব খাত সংস্কারের কথা রয়েছে। এখানে সেখানে শুল্ক ও কর অব্যাহতি না দেওয়া বা কমানোর শর্তটি অন্যতম।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা রহমাতুল মুমিন সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন বলেন, ‘যেকোনো চ্যালেঞ্জ নিয়েই আমরা কাজ করি। তবে আইএমএফের কথামতো এখনই সব ভ্যাট অব্যাহতি তুলে দেওয়া সম্ভব নয়। পর্যায়ক্রমে তা বাস্তবায়নে চেষ্টা করা হবে।’
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তৈরি প্রতিবেদন অনুসারে, বর্তমানে কৃষি, পশুসম্পদ, মৎস্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনপ্রশাসন, প্রতিরক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা সেবা খাতে কোনো ভ্যাট নেই। অর্থাৎ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ অবদান রাখে, এমন খাতগুলোতে ভ্যাট আরোপ করা নেই। উৎপাদন খাতে পোশাকশিল্পে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া আছে। এ ছাড়া বিদেশি পণ্যের নির্ভরতা কমিয়ে দেশি শিল্পের বিকাশ, টেকসই শিল্পায়ন ও বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, এয়ারকন্ডিশনার, লিফট, মোটরসাইকেল, মোবাইল ফোনসেট ও গৃহস্থালি সরঞ্জাম (হোম অ্যাপ্লায়েন্স) উৎপাদন প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাঁচামাল আমদানি ও উৎপাদন পর্যায়ে এবং ক্ষেত্রে বিশেষে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ প্রতিষ্ঠানগুলোকে শর্ত সাপেক্ষে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া আছে। ওষুধের প্রাথমিক কাঁচামাল উৎপাদনে এপিআই এবং সাবান ও শ্যাম্পুর প্রাথমিক কাঁচামাল উৎপাদনে শুল্ক ও ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর বিভিন্ন পণ্য যেমন কম্পিউটার, ল্যাপটপ, সার্ভার, মাদারবোর্ড এ জাতীয় পণ্য উৎপাদনে এবং সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টে একই সুবিধা দেওয়া হয়েছে। পলিব্যাগের পরিবর্তে জিওব্যাগ ব্যবহার উৎসাহিত করতে কাঁচামাল হিসেবে পিপি ও পিপি স্ট্যাপল ফাইবার, রিসাইক্লিংয়ের লক্ষ্যে ওয়েস্ট পেপার/কটন/পুরাতন ব্যাটারি/স্ক্র্যাপ, সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল ও ফটো-ভোল্টাইক, সেলে ভ্যাট অব্যাহতি আছে। পাইকারি/খুচরা ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ভ্যাট অব্যাহতি প্রাপ্ত পণ্যের ব্যবসা সংশ্লিষ্ট এবং ভ্যাটের আওতাবহির্ভূত। পরিবহন সেবায় একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পণ্য পরিবহন ও সাধারণ যাত্রী পরিবহনসংশ্লিষ্ট হওয়ায় ভ্যাটের আওতামুক্ত।
হিসাব করে দেখা গেছে, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক আইন ২৯১২ এর প্রথম তফসিল অনুযায়ী ৪৮৯ এইচএস কোডভুক্ত প্রাথমিক পণ্য, জীবনধারণের জন্য মৌলিক পণ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া আছে। এ ছাড়া একই তফসিল অনুযায়ী প্রায় ৫০টি সেবার ওপর ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। প্রজ্ঞাপন দ্বারা প্রায় ৫০০ পণ্যকে বিভিন্ন স্তরে ভ্যাট অব্যাহিত দেওয়া হয়েছে। এভাবে জিডিপির প্রায় ৫০ শতাংশ পণ্য সেবা ভ্যাট অব্যাহতির আওতাভুক্ত।
এনবিআর বলছে, এ সুবিধা থাকায় ভ্যাট জিডিপি তথা কর জিডিপি অনুপাত সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নীত হচ্ছে না।
এনবিআর সূত্র জানায়, রাজস্ব খাতে আইএমএফের শর্ত পূরণ করতে হলে আগামী তিন অর্থবছরে বাংলাদেশকে অতিরিক্ত ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করতে হবে। এর মধ্যে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরেই আদায় বাড়াতে হবে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব আদায়ে তিন খাতের মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ খাত হলো ভ্যাট, যা পরোক্ষ কর। এ করপণ্যের মূল্যের সঙ্গে ক্রেতা পরিশোধ করে। আদায়কৃত ভ্যাট ব্যবসায়ী বা বিক্রেতারা সরকারের কোষাগারে জমা দিয়ে থাকেন। আইএমএফের হিসাবে, প্রতি অর্থবছরে শুধু আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়ায় সরকার গড়ে ৪৪ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা রাজস্ব কম আদায় করে। এ ছাড়া অন্যান্য খাতের ভ্যাট অব্যাহতিতেও এ অর্থের সমান আদায় কম হয়। এসব অর্থ নিশ্চিত আদায়। তাই এখানেই হাত দিয়েছে ঋণদানকারী সংস্থাটি।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আইএমএফের সিদ্ধান্তগুলো যাচাই-বাছাই করেই মানতে হবে। ভ্যাট অব্যাহতি তুলে নেওয়ার মতো সক্ষমতা এখনো আমরা অর্জন করিনি। এতে দেশি শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাজারে পণ্যের দাম বাড়বে। এতে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।’
এনবিআর সূত্র আরও জানায়, রাজস্ব খাতে সংস্কারের মাধ্যমে আইএমএফ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের কর-জিডিপির অনুপাত দশমিক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৩ করার শর্ত দিয়েছে। এ শর্ত পূরণ করতে গেলে বর্তমানে আমাদের যে রাজস্ব আয় আছে, তার থেকে প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত আয় করতে হবে। এরপরের অর্থবছর অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষে কর-জিডিপির অনুপাত দিয়েছে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে রাজস্ব থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে অতিরিক্ত আয় করতে হবে ৭৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির সর্বশেষ বছর অর্থাৎ ২০২৫-২৬ অর্থবছরে কর-জিডিপির অনুপাতের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে বলেছে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। এ অর্থবছরে এনবিআরকে বর্তমান আয়ের তুলনায় অতিরিক্ত আরও ৯৬ হাজার কোটি টাকা আয় করতে হবে। সব মিলিয়ে আগামী তিন অর্থবছর শেষে ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করতে হবে।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এনবিআরকে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা বেশি। আগের অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৩ লাখ ২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছে এনবিআর। লক্ষ্য ছিল ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এরই মধ্যে চলতি অর্থবছরের গত সাত মাসে ঘাটতি রয়েছে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা জানি যে পণ্য বা সেবার উৎপাদন বা আমদানি যে কোনো পর্যায় থেকে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা তুলে নেওয়ার মানেই হলো নতুন ভ্যাট যোগ হওয়া। যা উৎপাদকরা বা আমদানিকারকরা শেষ পর্যন্ত পণ্যের মূল্যের সঙ্গে যোগ করে দেয়। তাই আইএমএফের শর্ত মেনে যেসব পণ্য থেকে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা কমানো বা তুলে নেওয়া হবে তার প্রতিটি ক্ষেত্রের সেবা নিতে হলে ভোক্তাকে বেশি দাম দিতে হবে। ভ্যাট অব্যাহতি কমানো বা তুলে নেওয়া প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়বে। বর্তমান জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েই চলেছে। এমন পরিস্থিতিতে শুধু ঋণ নেওয়ার জন্য পণ্যের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি সাধারণ মানুষকে কষ্টে ফেলবে।
তিনি আরও বলেন, ‘রাজস্ব আদায়ে যে হিসাব দিয়েছে আইএমএফ তা অবাস্তব বলে মনে করি। এসব হিসাব বাস্তবায়ন করতে গেলে সাধারণ মানুষ কষ্টে পড়বে।’