কোভিড সংকট থেকে তৈরি পোশাক শিল্পের দ্রুত পুনরুদ্ধার দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক গতিসঞ্চারে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একই সাথে, এ পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শুধু দেশীয় উদ্যোগের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে একে আন্তর্জাতিক সরবরাহ চেইনের সমন্বয়ে সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া দরকার। অতিমারির নানান অভিঘাত মোকাবেলায় তৈরি পোশাক খাতে যে উদ্যোগগুলো নেওয়া হয়েছে, সেগুলো তাৎক্ষণিক ও স্বল্পমেয়াদী, এবং সরকারের রাজস্ব সীমাবদ্ধতার জন্য অনেক উদ্যোগেই অপর্যাপ্ততা রয়ে গেছে। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে এ খাত চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় উদ্ভাবনী কৌশল প্রয়োজন যাতে দীর্ঘমেয়াদে বড় অভিঘাত এড়ানো যায়। আর সেজন্যই পোশাকশিল্প পুনরুদ্ধারের জন্য সরকার, ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং সরবরাহকারীদের মধ্যে বৃহত্তর সহযোগিতা ও উদ্যোগের প্রয়োজন।
১৬ই জানুয়ারি শনিবার সকালে “কোভিড-১৯ সৃষ্ট সংকট থেকে পোশাকখাতের উত্তরণ: সরবারহ চেইন-ভিত্তিক সমাধান সম্ভব কি?” শীর্ষক সংলাপে এই সমস্ত বক্তব্য উঠে আসে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)-এর আয়োজনে এই ভার্চুয়াল সংলাপটি অনুষ্ঠিত হয়। সংলাপে সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছিলো সামাজিক গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক “সাউদার্ন ভয়েস”।
সংলাপে সূচনা বক্তব্য প্রদান করে সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, শ্রীলঙ্কার ইন্সটিটিউট অফ পলিসি স্টাডিজ (আইপিএস) ও সিপিডি-র যৌথ উদ্যোগে এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে। তিনি বলেন, সরবরাহকারীদের জন্য মূল্য শৃঙ্খল ভিত্তিক সমাধান নিয়ে আলোচনা এ গবেষণায় উঠে এসেছে।
অতিমারির নানান অভিঘাত মোকাবেলায় তৈরি পোশাক খাতে যে উদ্যোগগুলো নেওয়া হয়েছে, সেগুলো তাৎক্ষণিক ও স্বল্পমেয়াদী। এ উদ্যোগগুলো প্রয়োজনীয় ভূমিকা রেখেছে। তবে সরকারের রাজস্ব সীমাবদ্ধতা ও ঋননির্ভরতার কারণে অনেক উদ্যোগেই অপর্যাপ্ততা রয়ে গেছে। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো বড় ধরনের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় স্থানীয় বাজারমুখী পদক্ষেপ নেওয়ার কথা চিন্তা করা হচ্ছে এবং অন্য দেশে যেমন ভিয়েতনামে কারখানা স্থানান্তরের চিন্তাভাবনা করছে। তবে বাংলাদেশে আপাতদৃষ্টিতে তা সম্ভব নয় রপ্তানিমুখী বাজারের জন্য। সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, পোশাক খাতের উৎপাদন চেইনে ক্রেতা থেকে শুরু করে উৎপাদক ও কাঁচামাল সরবারহকারীরা সকলেই আক্রান্ত হয়েছেন। এক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ঝুঁকি মোকাবেলায় বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে শ্রমিক ও সরবারহকারীরা বিভিন্ন অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন। মধ্যম মেয়াদে এ নিশ্চয়তা বেড়েছে—যা ক্রেতার ক্রয়াভ্যাস এবং আমদানীকারক দেশগুলীর সামগ্রিক উন্নয়নের সাথে সম্পর্কিত। এক্ষেত্রে ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এবং ক্রেতা রাষ্ট্রের (sourcing country) সরকারসহ বৃহত্তর বাজারের সকল সদস্যদের দায়িত্বশীল ব্যবসায়িক আচরণ ও নীতিমালা (আরবিপি) গ্রহণ করতে হবে। সংলাপে সিপিডি-র গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম তার উপস্থাপিত মূল প্রতিবেদনে এই তথ্যগুলো তুলে ধরেন। এছাড়াও, তিনি পোশাকখাতের পুনরুদ্ধার নিশ্চিত করতে ভ্যালু চেইন ভিত্তিক সমাধানের একটি সম্ভাব্য কাঠামো উপস্থাপন করেন।
সংলাপের প্রধান অতিথি মাননীয় বাণিজ্যমন্ত্রী জনাব টিপু মুনশি এমপি বক্তব্য রেখে বলেন, মধ্যম মেয়াদে বাংলাদেশের নতুন বাজারের সন্ধান করা উচিত, বিশেষ করে পণ্য বৈচিত্র্যের কথা মাথায় রেখে। তিনি ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান, সরবরাহকারী এবং সরকারের মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতামূলক উদ্যোগের আহ্বান জানান।
বাংলাদেশে নিযুক্ত নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত হ্যারি ভারওয়েজ সংলাপে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তিনি সিপিডির গবেষণায় উঠে আসা পর্যবেক্ষনগুলোর সাথে একমত পোষন করে, এ ধরনের বিষয়ে ভবিষ্যতে সিপিডির সাথে যৌথভাবে কাজ করার প্রয়াস ব্যক্ত করেন। এছাড়াও নেদারল্যান্ডস সরকার কীভাবে কোভিড সংকটকালীন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পাশে থেকেছে, এমনকি ডাচ ব্র্যান্ডগুলো যাতে অর্ডার বাতিল না করে সেদিকে খেয়াল রেখেছে সেই দিকগুলো মাননীয় রাষ্ট্রদূত তুলে ধরেন। তিনি মনে করেন, ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও এই অতিমারি আমাদের পোশাকশিল্পের খাতিরে একটি ইতিবাচক সুযোগ—মানবতা ও পরিবেশমুখী শিল্পের প্রসারণার জন্য।
এছাড়াও সংলাপের আরেক বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব জনাব কে, এম, আব্দুস সালাম। তিনি বলেন যে, এই জাতীয় কর্মসূচির জন্য শ্রমিকদের একটি সম্পূর্ণ তালিকা সরবরাহ করা প্রয়োজন। শক্তিশালী শ্রম ও কর্মসংস্থান নীতিমালা বাস্তবায়নের মাধ্যমে শ্রমিকদের অযাচিত ও আকস্মিক ছাঁটাই বন্ধ করা যায়।
ড. রুবানা হক, সভাপতি, বিজিএমইএ, সংলাপে সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। তিনি বাংলাদেশকে পোশাক শিল্পে স্থানীয় বাজার সরবরাহ ও চাহিদার কথা মাথায় রেখে এগোতে হবে বলে মত দেন। তিনি মনে করেন, ঋণ কর্মসূচিগুলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে না বিধায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ঝুঁকির মুখে রয়েছে।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন আইএলও সাউথ এশিয়ার ডিসেন্ট ওয়ার্ক টেকনিক্যাল টিমের ওয়ার্কার্স অ্যাক্টিভিটিস স্পেশালিস্ট সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ। তিনি জাতীয় পর্যায়ে সামাজিক নিরাপত্তা তহবিল গঠনের আহবান জানান। এছাড়াও সংলাপে বক্তব্য প্রদান করেন আমিরুল হক আমিন, সভাপতি, জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন, কল্পনা আক্তার, নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটি (বিসিডব্লিউএস), জিয়াউর রহমান, রিজিওনাল কান্ট্রি ম্যানেজার (বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইথিওপিয়া), এইচ এন্ড এম প্রমুখ।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান, চেয়ারম্যান, সিপিডি, আশা প্রকাশ করেন, আগামীতে ব্র্যান্ড এবং সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার বেকারত্ব বীমা চালু করতে সহায়তা প্রদান করবে।
সংলাপটি সঞ্চালনা করেন অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি। সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে তিনি অনুষ্ঠানটি শেষ করেন। বিশেষজ্ঞদের আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তর পর্ব অনুষ্ঠিত হয়।