পোশাক শ্রমিকের মজুরির বর্তমান হারের যথাযথ ব্যবহার না হওয়ার পেছনে বাড়ি ভাড়া ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিরঃ ড. মোয়াজ্জেম

Published in বণিকবার্তা on Saturday, 31 December 2016

লিভিং ওয়েজ রিপোর্ট

পোশাক শ্রমিকের মজুরি ঢাকার দারিদ্র্যসীমার নিচে

labor-wages

দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের ৮০ ভাগেরও বেশি কারখানা ঢাকা শহর ও ঢাকার উপকণ্ঠ শহরগুলোয় স্থাপিত। সবচেয়ে শ্রমঘন এ খাতে কাজ করেন প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক, যাদের প্রায় সবাই ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় গ্রাম থেকে শহরে এসেছেন। কিন্তু সেখানে দিন-রাত কাজ করেও দারিদ্র্য তাদের পিছু ছাড়ছে না। সম্প্রতি প্রকাশিত এক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, পোশাক শ্রমিকের মজুরি ঢাকার দারিদ্র্যসীমার নিচে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা শহরে দারিদ্র্যসীমা মজুরি ধরা হয়েছে মাসিক ৭ হাজার ১৭২ টাকা। অর্থাৎ কারো মাসিক মজুরি ৭ হাজার ১৭২ টাকার কম হলে তাকে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করতে হবে। অথচ পোশাক খাতে একজন শ্রমিকের মজুরি (গ্রেড-৪) ৬ হাজার ৪২০ টাকা। সে হিসাবে মজুরির দিক থেকে ঢাকার দারিদ্র্যসীমার নিচেই আছেন পোশাক শ্রমিকরা।

আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল সোস্যাল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল অ্যাক্রেডিটেশন অ্যান্ড লেবেলিং (আইএসইএএল)-এর আওতায় গ্লোবাল লিভিং ওয়েজ কোয়ালিশনের জন্য তৈরি করা হয়েছে ‘লিভিং ওয়েজ রিপোর্ট ঢাকা, বাংলাদেশ অ্যান্ড স্যাটেলাইট সিটিজ; কনটেক্সট: দ্য গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি। এতে বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকের বিদ্যমান মজুরি হার মূল্যায়ন করা হয়েছে।

সোস্যাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি ইন্টারন্যাশনালের (এসএআই) নেতৃত্বে তৈরি এ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে লিভিং ওয়েজ (জীবননির্বাহ মজুরি) হার হিসাব করে পোশাক শ্রমিকের মজুরির চিত্র দেখানো হয়েছে। ‘বাংলাদেশের মজুরি হারের সিঁড়ি’ শীর্ষক একটি লেখচিত্রের মাধ্যমে পোশাক শ্রমিকের মজুরি ও জীবননির্বাহ মজুরির তুলনামূলক পর্যালোচনা করা হয়েছে এ প্রতিবেদনে।

দেশের পোশাক শিল্পের মজুরি কাঠামোয় শিক্ষানবিশ ছাড়াই শ্রমিকদের মোট গ্রেড আছে সাতটি। সপ্তম গ্রেডের একজন শ্রমিক খাদ্য, যাতায়াত, চিকিত্সা, বাড়ি ভাড়া ও মূল বেতনসহ মোট ৫ হাজার ৩০০ টাকা মজুরি পান। আর গ্রেড ৪ ও ৩-এর শ্রমিকরা পান যথাক্রমে ৬ হাজার ৪২০ এবং ৬ হাজার ৮৫০ টাকা। পোশাক শ্রমিকদের এ মজুরি প্রতিবেদনে উল্লিখিত ঢাকার দারিদ্র্যসীমা মজুরির চেয়ে কম।

ঢাকার দারিদ্র্যসীমা মজুরি ছাড়াও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে অন্যান্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার দারিদ্র্যসীমা মজুরি হার। এতে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাংকের দারিদ্র্যসীমা মজুরি ৭ হাজার ৪১৮ টাকা। দেশের উত্পাদন, নির্মাণ, কৃষি ও মত্স্য খাতের শ্রমিকদের মজুরি এর চেয়ে বেশি। এসব খাতের গড় মজুরি ৮ হাজার ৮৪৬ টাকা। সেই হিসাবে পোশাক শ্রমিকরা তাদের চেয়ে মজুরিতে পিছিয়ে আছেন।

এ বিষয়ে সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণে মানসম্পন্ন আবাসন, পুষ্টি এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ বিবেচনায় নেয়া হয় না। সেজন্যই পোশাক শ্রমিকের মজুরির হার দারিদ্র্যসীমার নিচে দেখা যাচ্ছে। পোশাক উত্পাদন আয়ের অধিকাংশই পান ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে কারখানা পর্যন্ত মধ্যস্বত্বভোগীরা। সেখানে শ্রমিকরা পান খুব সামান্যই, যা পোশাকের পিসপ্রতি মাত্র ১৮ সেন্ট। এই যখন অবস্থা, তখন দারিদ্র্যসীমার নিচে তাদের মজুরি হার থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) স্বীকৃত অ্যাঙ্কর মেথডলজি ব্যবহার করে ঢাকা ও ঢাকার উপকণ্ঠে কর্মরত পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির আনুমানিক হিসাব করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে ৪০ লাখেরও বেশি শ্রমিক কর্মরত। সুন্দর কর্মপরিবেশে সঠিক ব্যবস্থাপনায় এ শ্রমশক্তি হতে পারে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি। এ শ্রমিকরাই বাংলাদেশকে দিতে পারে মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা। অথচ বর্তমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল ভোগ করতে পারছেন না এসব শ্রমিক। মজুরি এবং কর্মপরিবেশ তাদের ঠেলে দিচ্ছে দারিদ্র্যচক্রের মধ্যে।

এ-বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বার্ষিক মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রতি বছরই বাড়ে। সর্বশেষ মজুরি কাঠামো অনুযায়ী এটি করা হচ্ছে। শ্রমিকের মজুরি দারিদ্র্যসীমার নিচে— এমন তথ্য আমার কাছে যথার্থ মনে হচ্ছে না। কারণ আমরা জরিপ করে দেখেছি, বর্তমান মজুরি হারে একজন শ্রমিক মাস শেষে স্বল্প হারে হলেও সঞ্চয়ের সামর্থ্য রাখেন।

প্রতিবেদনে অ্যাঙ্কর মেথডলজি অনুসরণে গ্লোবাল লিভিং ওয়েজ কোয়ালিশন (জিএলডব্লিউসি) কর্তৃক সর্বসম্মত ‘লিভিং ওয়েজ’-এর সংজ্ঞা তুলে ধরা হয়েছে। সে অনুযায়ী লিভিং ওয়েজ হলো— ‘নির্দিষ্ট স্থানে (ও সময়ে) একটি আদর্শ কর্মসপ্তাহে একজন শ্রমিকের অর্জিত পারিশ্রমিক, যা তার ও তার পরিবারের মানসম্পন্ন ও সুন্দর জীবনযাপনের জন্য যথেষ্ট।’ ঢাকা ও ঢাকার উপকণ্ঠের বসবাসরত শ্রমিকদের লিভিং ওয়েজ হিসাব করতে মিরপুর, ঢাকার পার্শ্ববর্তী নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, আশুলিয়ার শ্রমিকদের দৈনন্দিন খরচের মাঠপর্যায়ে তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। মানসম্পন্ন ও সুন্দর জীবনযাপনের জন্য খাদ্য, পানি, আবাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, পরিবহন, পোশাক, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা মোকাবেলা এবং অন্যান্য অপরিহার্য প্রয়োজনকেও বিবেচনায় আনা হয়েছে এ প্রতিবেদনে।

আনুমানিক হিসাব করে প্রতিবেদনে ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের লিভিং ওয়েজ তুলে ধরা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, ঢাকার লিভিং ওয়েজ হার মাসিক ১৬ হাজার ৪৬০ টাকা। আর ঢাকার উপকণ্ঠের শহরগুলোর লিভিং ওয়েজ হার মাসিক ১৩ হাজার ৬৩০ টাকা। বাংলাদেশের বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) হিসাবে লিভিং ওয়েজ ১৭ হাজার ৭৮৬ টাকা।

৩০ বর্গমিটারের আবাসনে চার সদস্যবিশিষ্ট একটি শ্রমিক পরিবারের জন্য মজুরির এ হার প্রযোজ্য বলে ধরে নেয়া হয়েছে এ গবেষণায়। এ হার পোশাক খাতের বর্তমান ন্যূনতম মজুরির দ্বিগুণের বেশি। মজুরির এ হার হিসাব করতে খাদ্য, আবাসন, জরুরি প্রয়োজন ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য স্বল্প হারে সঞ্চয়কে বিবেচনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে গৃহস্থালির আয় ও ব্যয়কেও বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে একজন শ্রমিকের খাদ্য ব্যয় হিসাব করা হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বীকৃত ন্যূনতম ২ হাজার ১৮৮ ক্যালরি ধরে। বেঁচে থাকতে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন এ পরিমাণ ক্যালরিসম্পন্ন খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। এ খাবার গ্রহণে ঢাকার উপকণ্ঠ শহরগুলোয় দিনপ্রতি ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৯ দশমিক ৭৪ টাকা। আর ঢাকার মিরপুরে একই পরিমাণ ক্যালরিসম্পন্ন খাদ্য গ্রহণে ৬৫ দশমিক শূন্য ৬ টাকা ব্যয় হয় বলে হিসাব করা হয়েছে।

শ্রমিকের আবাসন ব্যয় হিসাব করতে শ্রমঘন শিল্প এলাকার বাড়ি ভাড়া হিসাব করা হয়েছে। এলাকাভেদে আবাসন ব্যয়ের হিসাবে ভিন্নতা উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। লিভিং ওয়েজ হিসাবে ঢাকার মধ্যে ন্যূনতম ১০ হাজার টাকা হলেও গাজীপুর ও অন্য এলাকাগুলো মিলিয়ে বাড়ি ভাড়ায় ন্যূনতম ৭ হাজার টাকা প্রয়োজন বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। এছাড়া পরিবারের সদস্য সংখ্যাভেদে গাজীপুর এলাকায় ৫ হাজার ৭০০ টাকায় আবাসন সম্ভব বলে প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে।

সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এ প্রসঙ্গে বলেন, পোশাক শ্রমিকের মজুরির বর্তমান হারের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না বলে দাবি করছেন শ্রমিক প্রতিনিধিরা। এর কারণ বাড়ি ভাড়া ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। সরকার বর্তমান হারের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে শ্রমিক-মালিক দুপক্ষের জন্যই ভালো হতো। তবে এটি ঠিক যে, বর্তমান হার আরো বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে মজুরির হার বিশ্লেষণে আরো অনেক বিষয় বিবেচনা করা দরকার।