Originally posted in সমকাল on 9 November 2024
রপ্তানি বাড়তে পারে তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি
চীনের নেতৃত্বাধীন বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্য চুক্তি রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপে (আরসিইপি) যোগ দিতে আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ। এ জোটে যোগ দিলে কী সুবিধা পাবে বাংলাদেশ, চ্যালেঞ্জ কী– এসব নিয়ে সমীক্ষা সম্পন্ন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এতে দেখা গেছে, বাংলাদেশ এই জোটে যুক্ত হলে রপ্তানি ৩ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার এবং বিদেশি বিনিয়োগ ৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ বাড়তে পারে। আর সামগ্রিকভাবে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) শূন্য দশমিক ২৬ শতাংশ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, আরসিইপিতে বাংলাদেশের যোগ দেওয়ার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। সম্প্রতি এই জোটে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করার অনুরোধ জানিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সম্মতিপত্র পাঠিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। শিগগির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আরসিইপির পদ পাওয়ার জন্য সংস্থাটির সদরদপ্তরে আনুষ্ঠানিক আবেদন করবে বাংলাদেশ। এর আগে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় আরসিইপিতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের অনুমোদন দিয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় উপস্থাপিত এ-সংক্রান্ত সারসংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৫ দেশের বর্তমান বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্য জোট আরসিইপি। আসিয়ানের ১০টি সদস্য দেশ– ব্রুনাই, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম। আসিয়ানের এফটিএ অংশীদার তথা চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডও এ জোটের সদস্য। যাদের মোট জনসংখ্যা প্রায় ২৩০ কোটি (বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ)। সব মিলিয়ে এটি ২৬ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের বাজার।
২০২০ সালের ১৫ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে আইসিইপি চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয় এবং ২০২২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়। চুক্তিটি কার্যকর হওয়ার ১৮ মাস পর অর্থাৎ ২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে কোনো দেশ অথবা কাস্টমস অঞ্চলভুক্ত সংস্থার সদস্য আরসিইপিতে অন্তর্ভুক্তির জন্য আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে। সদস্য দেশগুলোর ক্যাটেগরি অনুসারে উন্নয়ন ও উন্নয়নশীল দেশের পাশাপাশি স্বল্পন্নোত দেশও এ জোটের অন্তর্ভুক্ত বলেও সারসংক্ষেপে উল্লেখ রয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, আওতা ও পরিধি বিবেচনায় আরসিইপি একটি উচ্চ মানের আধুনিক ও কম্প্রিহেনসিভ প্রকৃতির মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি। পণ্য ও সেবা বাণিজ্য, বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক এবং কারগরি সহায়তা, মেধাস্বত্ব, বিরোধ নিষ্পত্তি, ই-কমার্স, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ইত্যাদি এ চুক্তির আওতাভুক্ত।
বিশ্বের মোট জিডিপি ও জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ, প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের ৩১ শতাংশ এবং মোট পণ্য ও সেবা বাণিজ্যের এক-চতুর্থাংশ এ জোটের আওতাভুক্ত। জোটটি মূলত একটি ইউনিফাইড রুলস অব অরিজিন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমের শুল্ক বাধা দূর করে এই অঞ্চলে সরবরাহ চেইন তৈরির কাজ করছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আরসিইপিতে বাংলাদেশের যোগদানের বিষয়ে প্রয়োজনীয় সমীক্ষা সম্পন্ন করেছে। সমীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায়, বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় বাংলাদেশ এ জোটে সংযুক্ত হলে ৩ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি ও ৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগ বাড়তে পারে। এই রপ্তানি বৃদ্ধির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আসবে পোশাক শিল্প খাত থেকে। এর ফলে এই খাতে দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা আনুমানিক ১৮ শতাংশ বাড়বে।
সামগ্রিকভাবে এই জোটে যোগদানের ফলে দেশের জিডিপি শূন্য দশমিক ২৬ শতাংশ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে সক্ষমতা না বাড়লে দেশের রপ্তানি খাত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে পড়বে। এ ছাড়া সেবা, ই-কমার্স বিনিয়োগসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ সৃষ্টির পাশাপাশি কর রাজস্ব আদায়ে বিরূপ প্রভাব পড়বে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় প্রয়োজনীয় কার্যক্রম নেওয়ার পরিকল্পনা করছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এই চুক্তির ফলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে জোটভুক্ত দেশগুলোকে একে একে অধিকাংশ আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক তুলে নিতে হবে। সে অনুযায়ী বাংলাদেশকেও শুল্কছাড় দিতে হবে। চীন থেকে বাংলাদেশ আমদানি করে ২৪ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের পণ্য। এই আমদানিতে গড়ে ১০ শতাংশ শুল্ক থাকলেও বাংলাদেশ ২৫০ কোটি ডলার রাজস্ব আয় করে। তবে আমদানি শুল্ক কমলেও রপ্তানি ও বিনিয়োগ বৃদ্ধিসহ অন্যান্য সুবিধার কারণে সার্বিকভাবে বাংলাদেশ লাভবান হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে– আরসিইপিতে যুক্ত হলে বাংলাদেশ আসিয়ানের সদস্য দেশগুলোতে নৈকট্যজনিত সুবিধা পাবে। বাজার সুবিধা লাভের ক্ষেত্রে এই অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে আলাদাভাবে দর কষাকষির প্রয়োজন পড়বে না। ফলে বাংলাদেশ এলডিসি তালিকা থেকে উত্তরণের পরও শুল্ক সুবিধা ধরে রাখার মাধ্যমে গ্লোবাল ভ্যালু চেইনে যোগ দিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাণিজ্যিক ও কৌশলগতভাবে লাভবান হবে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ‘রুলস অব অরিজিন’ অর্থাৎ কোন দেশ থেকে পণ্য আসছে, তার নতুন সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়েছে। রুলস অব অরিজিনের সংজ্ঞায় পরিবর্তনের প্রভাব হবে অনেক বড়। বিষয়টি হলো কোনো সদস্য দেশ যদি তাদের উৎপাদিত পণ্যে ভিন্ন কোনো দেশের কাঁচামাল ব্যবহার করে, তাহলে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি থাকলেও আমদানি শুল্ক গুনতে হয়।
যেমন ইন্দোনেশিয়া যদি তাদের তৈরি কোনো যন্ত্রে অন্য কোনো দেশ থেকে আমদানি করা যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে, তাহলে আসিয়ানভুক্ত অন্য দেশে তা রপ্তানিতে শুল্ক দিতে হতে পারে। তবে রুলস অব অরিজিনের নতুন সংজ্ঞার কারণে আরসিইপি চুক্তিতে সদস্য দেশগুলো থেকে যন্ত্রাংশ কিনলে রপ্তানিতে সমস্যা হবে না। এ বিষয়টিই আসিয়ান জোটের সদস্যদের নতুন এই বাণিজ্য চুক্তিতে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। এর ফলে তারা এই জোটে যোগ দেয়।
প্রকৃত পক্ষে মুক্ত বাণিজ্যের বিশ্ববাজার অনেক বড় বিষয়। কিন্তু সেখানে প্রবেশ করার আগে নিজের ভিত শক্তিশালী করা দরকার। তা না হলে নিজের বাজার বাণিজ্য অংশীদারদের পণ্যে সয়লাব হয়ে যাওয়ার শঙ্কা থাকে। যে শঙ্কা থেকে ভারত শেষমেশ এই চুক্তিতে অংশগ্রহণ করেনি। তবে এই শতকে বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম প্রাণকেন্দ্র হতে পারে আসিয়ানসহ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো। এর ফলে এই জোটে যোগ দিলে বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে। তখন স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়বে। তবে সে জন্য নিজেদের প্রস্তুত থাকা দরকার।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান সমকালকে বলেন, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে আমাদের রপ্তানি বাড়াতে হলে নতুন বাজার দরকার। সে ক্ষেত্রে আরসিইপি জোটে যোগ দেওয়ার উদ্যোগ অবশ্যই ভালো কাজ। বাংলাদেশ ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মতো দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির বিষয়ে আলোচনা করছিল। এখন আরসিইপিতে যোগ দিলে তার দরকার হবে না; বহুপক্ষীয় বৃহৎ জোটে যোগ দেওয়া দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির চেয়ে ভালো।
কিন্তু আরসিইপিভুক্ত দেশগুলোতে তৈরি পোশাক রপ্তানির সুযোগ কম বলে মন্তব্য করেন মোস্তাফিজুর রহমান। সে জন্য বাংলাদেশের উচিত হবে রপ্তানি সক্ষমতা বাড়ানো। সামগ্রিকভাবে সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিবেশের উন্নতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের খরচ কমিয়ে আনা দরকার, যাতে বিনিয়োগ আকর্ষণ করা সম্ভব হয়।
রাজস্ব হারানো প্রসঙ্গে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের উচিত হবে দ্বিমুখী আলোচনা করা। অর্থাৎ রপ্তানির ক্ষেত্রে দ্রুত ছাড় আদায় করা এবং আমদানির ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে ছাড় দেওয়া। আসিয়ান গঠনের সময় কম্বোডিয়া, ভিয়েতনামসহ আরও দুটি দেশকে এই সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। তবে এসব আদায়ে আলোচনার সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি।
এদিকে বাংলাদেশের আরসিইপিতে যোগদান প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে অন্যান্য মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর ও আমদানি-রপ্তানিকারকসহ সরকারি-বেসরকারি অংশীজনকে নিয়ে কয়েক দফা সভা ও কর্মশালার আয়োজন করেছে। অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে এ জোটে অন্তর্ভুক্তির জন্য বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। তবে দর কষাকষিতে দেশের স্বার্থ সংরক্ষণ এবং সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের বিষয়টি বিবেচনায় রাখার তাগিদ এসেছে। তাই প্রযোজ্য ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নিবিড় গবেষণা কার্যক্রম চালানো হতে পারে।
২০১২ সালে প্রথম এই চুক্তির প্রস্তাব করা হয়েছিল। তারপর আট বছর ধরে চীনের প্রবল উৎসাহ ও উদ্যোগে শেষমেশ ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে এটি বাস্তবে রূপান্তরিত হয়। অনেকে আবার মনে করছেন, মুক্ত বাণিজ্যের এই চুক্তি এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব বিস্তারের পথে এক ধরনের অভ্যুত্থান। বাংলাদেশ গত কয়েক বছর ধরেই আরসিইপিতে যোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। ২০২১ সাল থেকেই এ নিয়ে আলোচনা চলছে। কিন্তু নানা কারণে বিগত সরকার শেষমেশ এই জোটে যোগ দেয়নি।