বাজারের চাহিদা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ নিশ্চিতের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন – ফাহমিদা খাতুন

Originally posted in বণিকবার্তা on 29 August 2024

কর্মসংস্থান ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে মনোযোগ দিতে হবে বিনিয়োগে

দেশের অর্থনীতির নিম্নগামিতার প্রভাব পড়েছে তরুণদের কর্মসংস্থানে। বিশ্বে আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। ৮০ শতাংশের অধিক অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। তারুণ্যের সাম্প্রতিক জাগরণ কর্মসংস্থানের বিষয়টিকে আবারো সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। এর জন্য বিনিয়োগ থেকে শুরু করে সামগ্রিক বিষয়ে গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সরকারকে বিনিয়োগে মনোযোগ দিতে হবে, যা গত সরকারের সময় স্থবির ছিল। বিনিয়োগের পাশাপাশি শিক্ষার মান বাড়াতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে প্রশিক্ষণের মান। এতে দেশের ভেতরে ও বাইরে দক্ষ তরুণরা অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারবেন।

এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গত ১০ বছর থেকে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। বিদেশী বিনিয়োগ নেই। এখন মনোযোগ দিতে হবে বিনিয়োগে। বিনিয়োগই কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। তবে কোথায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। এখানে ৮০ শতাংশের ওপর কর্মসংস্থান অনানুষ্ঠানিক খাতে। মানসম্মত কাজ এবং মানসম্মত বেতনের জন্য প্রয়োজন হবে প্রশিক্ষণের। একদিকে চাকরি নেই, অন্যদিকে আবার কর্তৃপক্ষ বলে তারা প্রশিক্ষিত লোক পায় না। এর মানে শিক্ষার মান ও প্রশিক্ষণ দরকার পড়বে। তবে জিডিপির মাত্র ২ শতাংশের মতো শিক্ষার বাজেট। শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে হবে। এজন্য শিক্ষকের গুণগত মান বৃদ্ধি করতে হবে। প্রশিক্ষণ সেন্টারগুলোয় বাজারের চাহিদা অনুযায়ী প্রশিক্ষণ নিশ্চিতের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতিটা যেহেতু সবাইকে চাকরি দেয়ার মতো বৃহৎ না, তাই উদ্যোক্তা হওয়ায়ও মনোযোগ দিতে হবে। এজন্য প্রয়োজন পুঁজির। এক্ষেত্রে সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে। অর্থাৎ কর্মসংস্থান তৈরির জন্য সামগ্রিক বিষয়গুলো নিয়ে এখন কাজ করা জরুরি। যেমন শুধু বিনিয়োগ করা হলো কিন্তু প্রশিক্ষিত লোক নেই তাহলে হবে না। এছাড়া প্রবাসী শ্রমিকদেরও প্রশিক্ষণ দিয়ে উচ্চ বেতনের চাকরিতে পাঠাতে হবে। যেমনটি ভারত, ফিলিপাইন ও শ্রীলংকায় হয়ে থাকে।’

বাংলাদেশ শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের ৬০ দশমিক ৬ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। আর উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্নদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরতের হার ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ। আবার সরকারি চাকরির প্রতি তরুণদের ঝোঁকের প্রমাণ মিলেছে বিভিন্ন নিয়োগের ক্ষেত্রে। সরকারি চাকরির নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ক্ষেত্রে নিজেদের শিক্ষাগত যোগ্যতার তুলনায় অনেক কম যোগ্যতাসম্পন্ন চাকরিতেও আবেদন ও যোগদান করছেন তরুণরা।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানে বিশ্বে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। তালিকা অনুযায়ী প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের দিক থেকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে মাদাগাস্কার। দেশটির মোট কর্মসংস্থানের ৯৬ দশমিক ১ শতাংশ হয়েছে অনানুষ্ঠানিক খাতে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে সুদান ও নাইজেরিয়া। সুদানে ৯৪ দশমিক ৪ শতাংশ ও নাইজেরিয়ায় ৯৩ দশমিক ৯ শতাংশ শ্রমশক্তি অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত। চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে লাওস, জাম্বিয়া ও বলিভিয়া। দেশগুলোয় অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত রয়েছে মোট শ্রমশক্তির যথাক্রমে ৯০ দশমিক ৫ শতাংশ, ৮৫ দশমিক ৬ ও ৮৪ দশমিক ৯ শতাংশ।

বাংলাদেশের বিগত দুটি শ্রমশক্তি জরিপ তুলনা করে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে দেশে আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান বেড়েছে মাত্র দশমিক ২ শতাংশীয় পয়েন্ট। শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ সালে দেশে আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান ছিল ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ। আর ২০২২ সালে আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের হার ১৫ দশমিক ১ শতাংশ। অন্যদিকে এ সময়ে উচ্চ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বেড়েছে ৩ দশমিক ৫ শতাংশীয় পয়েন্ট। ২০১৬-১৭ সালে উচ্চ শিক্ষিত জনগোষ্ঠী ছিল ৪ দশমিক ২ শতাংশ, যা ২০২২ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়েমা হক বিদিশা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তরুণদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ তরুণ তো সমজাতীয় না। ফলে গ্রামীণ তরুণদের জন্য এক ধরনের পরিকল্পনা এবং শহরের তরুণদের জন্য নিতে হবে অন্য রকমের পরিকল্পনা। সেক্ষেত্রে গ্রামীণ তরুণদের জন্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) এবং সেই সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনার দিকে জোর দিতে হবে। যেমন কৃষিভিত্তিক শিল্পায়নে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে, যাতে করে তারা তাদের কাছাকাছি এলাকায় কর্মসংস্থান করতে পারে। এখন হয়তো পুরনো কৃষিতে তরুণরা আগ্রহী হবে না। তাই কৃষি থেকে কিছুটা উন্নত হলে সেখানে গুরুত্ব দিতে হবে। শহরের তরুণদের জন্য যারা ফ্রিল্যান্সিং করতে চায় কিংবা উদ্যোক্তা হতে চায় তাদের জন্য থোক বরাদ্দসহ বিভিন্ন সুযোগ তৈরি করতে হবে। এর পাশাপাশি ব্যক্তি খাতের তরুণদের আরো বেশি আগ্রহী করার জন্য ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিক সংযোগটা আরো শক্তিশালী হতে হবে। শিক্ষার মানে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে বেসিক বিভিন্ন দক্ষতা বৃদ্ধির বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।’

এদিকে গত ডিসেম্বর থেকে মার্চের মধ্যে দুই ধাপে ২ হাজার ১৭২ জন ওয়েম্যান নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। চতুর্থ শ্রেণীর (১৯তম গ্রেড) ওয়েম্যান পদের মূল কাজ রেলপথ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। এছাড়া রেললাইনের নাটবল্টু টাইট দেয়াসহ ছোটখাটো রক্ষণাবেক্ষণের কাজটিও তারাই করে থাকেন। কায়িক পরিশ্রমনির্ভর পদটিতে আবেদনের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করেছে এসএসসি বা সমমান। তবে সর্বশেষ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ধাপ পেরিয়ে যারা ওয়েম্যান হিসেবে চাকরি পেয়েছেন, তাদের সবার শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল স্নাতকোত্তর বা মাস্টার্স পাস।

শুধু রেলওয়ে নয়, একই ঘটনা ঘটছে এ ধরনের অন্যান্য সরকারি চাকরিতেও। আবেদনকারীরা বলছেন, বেসরকারি চাকরিতে অনিশ্চয়তার কারণেও তারা নিম্নপর্যায়ের পদে হলেও সরকারি চাকরিতে যোগদান করতে চাচ্ছেন। এমনই এক শিক্ষার্থী শামীম ইসলাম (ছদ্মনাম)। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শেষ করে তিনি একই বিশ্বিবিদ্যালয়ে ১৬তম গ্রেডের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার টাইপিস্ট পদে যোগদান করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী পদটিতে শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল এইচএসসি পাস।