Originally posted in দেশ রূপান্তর on 21 April 2025
ভোজ্য তেলের বাজার
আসছে নতুন বিনিয়োগ, সিন্ডিকেট ভাঙার আশা
- আগামী বছরে বাজারে আসছে প্রাণ আরএফএল
- টিসিবির সঙ্গে সেনাকল্যাণ সংস্থার উৎপাদন বৃদ্ধি উদ্যোগ
- রাইস ব্রান ক্রুড রপ্তানিতে ২৫% শুল্ক আরোপ
দীর্ঘদিন ভোজ্য তেলের ব্যবসায় ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখলেও চট্টগ্রাম ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ ব্যবসা গুটিয়ে নেয় আওয়ামী সরকার পতনের পর। বড় এ প্রতিষ্ঠানটির অনুপস্থিতিতে মাস কয়েক ভোজ্য তেলের সরবরাহ পরিস্থিতিতে কিছুটা বিশৃঙ্খলা তৈরি হলেও বড় সক্ষমতা নিয়ে নতুন একটি প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যেই পণ্যটি বাজারজাত শুরু করেছে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য থেকে জানা গেছে।
এর সঙ্গে এ বছরের শেষদিকে বা আগামী বছরের মাঝামাঝিতে ভোজ্য তেল বাজারজাত শুরু করবে ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রাণ আরএফএল গ্রুপ। সরকার বাংলাদেশ ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) সঙ্গে সেনাকল্যাণ সংস্থার ভোজ্য তেল পরিশোধনাগারকে পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদনে নিয়ে আসতে কাজ শুরু করেছে। নতুন প্রতিযোগী বেড়ে যাওয়ায় পুরনোদের নিয়ন্ত্রণ কমে পণ্যটির বাজারে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবে। ফলে পণ্যমূল্যে একটা সুফল ভোক্তারা পাবেন বলে মনে করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য থেকে জানা যায়, গ্লোব গ্রুপ অব কোম্পানির একটি প্রতিষ্ঠান ছিল গ্লোব এডিবল অয়েল লিমিটেড। এই প্রতিষ্ঠানটি আবুল খায়ের গ্রুপের গ্রুপ চেয়ারম্যান আবুল কাশেম কিনে নিয়েছেন। তবে আবুল কাশেম প্রতিষ্ঠানটিতে বিনিয়োগ করে কোম্পানি পরিচালনার বিষয়গুলো দেখলেও এটি আবুল খায়ের গ্রুপের কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। আবুল কাশেম তার ছেলেদের নামে স্মাইল ফুড লিমিটেড নামের প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছেন, যার আওতায় ইতিমধ্যেই অধিগ্রহণ করা এই রিফাইনারিতে ভোজ্য তেলের উৎপাদন শুরু হয়েছে।
স্মাইল ফুডের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, কোম্পানিটির আওতায় এখন দৈনিক ১ হাজার এবং ৫০০ টন সক্ষমতার দুটি তেল শোধনাগার রয়েছে। আংশিকভাবে উৎপাদন শুরু হয়েছে, দ্রুতই পুরোদমে উৎপাদনে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে ভোজ্য তেলের পরিশোধনাগার দুটি।
১৯ দিনে প্রবাসী আয় এলো প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা১৯ দিনে প্রবাসী আয় এলো প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, সেনাকল্যাণ সংস্থার ভোজ্য তেলের একটি অত্যাধুনিক পরিশোধনাগার রয়েছে। আড়াই লাখ টনের বেশি উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও বর্তমানে মাত্র ২০ হাজার টন ভোজ্য তেল পরিশোধন হয় এই পরিশোধনাগারে। সরকার ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে পরিশোধনাগারটির পুরো সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেছে।
সম্প্রতি বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন সচিবালয়ে তেলের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়ার সময় বলেন, ‘ভোজ্য তেলের বাজারকে বৈচিত্র্যময় করার জন্য সরিষা ও রাইস ব্রান অয়েলের সরবরাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করছি। প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে টিসিবির সরবরাহ বাড়ানোর জন্য সেনাকল্যাণ সংস্থার পরিশোধনাগারকে পুরো সক্ষমতায় উৎপাদনে নিয়ে আসতে কাজ করছি। এ ছাড়া আরও নতুন দুটির একটি ইতিমধ্যে বাজারে এসেছে এবং অন্যটি আসছে।’
তিনি বলেন, সামনের দিনগুলোতে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে তেলের বাজারে মূল্য সহনশীল পর্যায়ে রাখা যাবে।
এর বাইরে আগামী অর্থবছরে পরিশোধনাগার তৈরির মাধ্যমে দেশের বাজারে ভোজ্য তেলের নতুন প্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবে আসার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেছে প্রাণ আরএফএল গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটি দৈনিক ৫০০ টন পরিশোধন সক্ষমতার অবকাঠামো তৈরি করতে চায়।
প্রাণ আরএফএল গ্রুপের বিপণন বিভাগের পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সম্প্রতি আমরা ভোগ্যপণ্যের কয়েকটি পণ্য বাজারজাত করা শুরু করেছি। এর সঙ্গে আগামী অর্থবছরে ভোজ্য তেল বাজারজাত করার পরিকল্পনা রয়েছে।’
এর বাইরে ছোট ছোট কিছু প্রতিষ্ঠান স্বল্প পরিসরে ভোজ্য তেলের বাজারে প্রবেশ করেছে বলে জানা গেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু পরিশোধনাগার ভাড়া ও অধিগ্রহণ করে তেল পরিশোধন করছে। এসইবি ও এসএ গ্রুপ একসঙ্গে নারায়ণগঞ্জের ভোজ্য তেল পরিশোধনের একটি কারখানা অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করেছে বলে জানা গেছে। চট্টগ্রামের সামুদা ও সীকম গ্রুপ ভোজ্য তেল উৎপাদনে বিনিয়োগ করবে বলেও জানা গেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ভোজ্য তেলের বাজারে রাইস ব্রান অয়েল বা কুঁড়ার তেলের একটা ব্যাপক উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও সেটা পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। এক লাখ টনের আশপাশে যে রাইস ব্রানের উৎপাদন হওয়ার সুযোগ সেটাও রপ্তানি হয়ে আসছিল। স্থানীয় বাজারে মাত্র ৪-৫ হাজার টন কুঁড়ার তেল বেচা-বিক্রি হয়। তবে সরকার এবার রপ্তানি সীমিত করার উদ্যোগ নিয়েছে।
রাইস ব্রান অয়েলের ক্রুড বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়ে আসছিল। এই ক্রুড রপ্তানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যাতে করে এ তেলগুলো স্থানীয় বাজারে বাজারজাত হয়। এ উদ্যোগের মাধ্যমে সামনের দিনগুলোতে এক থেকে দেড় লাখ টন রাইস ব্রান অয়েল দেশের বাজারে বিক্রির আশা দেখছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর সঙ্গে রয়েছে সরিষার তেলের বাজার, যার পুরোটাই স্থানীয় উৎপাদন। সারা দেশে এখন ভোজ্য তেল হিসেবে অন্তত দুই থেকে আড়াই লাখ টন সরিষার তেল ব্যবহার হচ্ছে এবং এটা প্রতিনিয়তই বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্টরা মনে করছে, সয়াবিন ও পাম অয়েলের বাজারে নতুন নতুন প্রতিযোগীর পাশাপাশি রাইস ব্রান ও সরিষার তেলের সরবরাহ বৃদ্ধিও বাজারকে নির্দিষ্ট কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের হাতে কুক্ষিগত হওয়ার হাত থেকে বাঁচাবে।
তবে বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা প্রতিষ্ঠার জন্য সুশাসন ঠিক করা না হলে নতুন বিনিয়োগকারীদের এনে তেমন সুফল পাওয়া যাবে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘তেলের বাজারে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন বিনিয়োগকারী আনার চেয়েও প্রতিযোগিতার পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। সেজন্য আইনি সংস্কার আগে করতে হবে।’
নতুন বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পুরনো যাদের সঙ্গে বাজারে প্রতিযোগিতা করবে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, এডিবল অয়েল লিমিটেড এবং বসুন্ধরা গ্রুপ।
ভোজ্য তেলের বাজার মূলত সয়াবিন, পাম অয়েল, রাইস ব্রান ও সরিষার তেলের ওপরই নির্ভরশীল। সব মিলে প্রতি বছর সর্বোচ্চ ২৪-২৫ লাখ টন ভোজ্য তেলের চাহিদা রয়েছে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। এর মধ্যে প্রতি বছর ৮ থেকে ৯ লাখ টন সয়াবিন তেল, ১৩ থেকে ১৪ লাখ টন পাম অয়েল, দুই থেকে আড়াই লাখ টন সরিষার তেল এবং এক থেকে দেড় লাখ টন রাইস ব্রান অয়েল বাজারে বিক্রি হয়।
এস আলম বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে ১৭-২০ শতাংশের মতো বাজার হিস্যা (মার্কেট শেয়ার) ছিল প্রতিষ্ঠানটির। যে জায়গাটা দখলে দ্রæত ব্যবসা বাড়ানোর জন্য কাজ করছে স্মাইল ফুড লিমিটেড। এর বাইরে সিটি, মেঘনা ও টিকে গ্রুপের বাজার হিস্যা গড়ে ২০ শতাংশের বেশি। এর বাইরে এডিবল অয়েলের ১০ শতাংশ ও বসুন্ধরার ৮ শতাংশ ভোজ্য তেলের বাজারে দখল রয়েছে।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘বর্তমানে বাজারের যে আকার সেখানে একটি কোম্পানি সর্বোচ্চ কত শতাংশ মার্কেট শেয়ার দখলে নিতে পারবে, সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। ফলে একটি নির্দিষ্ট কোম্পানির পুরো বাজার দখলে নেওয়ারও সুযোগ রয়েছে। এর পাশাপাশি একজন ডিলার তার মোট বিক্রির মধ্যে একটি নির্দিষ্ট কোম্পানির পণ্য সর্বোচ্চ কত শতাংশ রাখতে পারবে, সে বিষয়ে কোনো বিধান নেই।’
বাজার পরিস্থিতির ওপর তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি রয়েছে। কোন কোম্পানি কী পরিমাণ তেল আমদানি ও মজুদ করছে সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। ফলে তারা বাজার অস্থিতিশীল করে তোলার সুযোগ পেয়ে যায়। এজন্য তেলের আমদানি ও বিক্রির তথ্য ডিজিটাল মাধ্যমে উন্মুক্ত করে দেওয়ার প্রস্তাব দেন এ গবেষক।
তিনি বলেন, যতদিন না এসব সংস্কার করা হচ্ছে, ততদিন বাজারে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার পরিবেশ নিশ্চিত হবে না। যেসব কোম্পানি নতুন করে বিনিয়োগে আসছে তারা হয়তো সরকারি আনুকূল্য পাচ্ছে। কিন্তু তাদের অনেকেরই এ বাজার সম্পর্কে তেমন অভিজ্ঞতা নেই। ফলে আইনি সংস্কারের মাধ্যমে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা না হলে অনেক ক্ষেত্রে নতুন বিনিয়োগকারীরা হোঁচট খেতে পারেন।