বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে সুযোগ নিচ্ছে অসাধু চক্র – মোস্তাফিজুর রহমান

Originally posted in খবরের কাগজ on 22 August 2025

বছরের ব্যবধানে সবজির দাম প্রায় দ্বিগুণ

‘শজনে ডাঁটা ৩০০ টাকা কেজি! এত দাম কেন? আড়াই শ গ্রাম দেন। বেগুনের কেজি ২৬০ টাকা! আধ কেজি দেন।’ দাম বেশি হওয়ায় মোহাম্মদপুরের টাউন হল বাজারে এই দুই পদের সবজি কম করে কেনেন তাজমহল রোডের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম।

তিনি বলেন, ‘দাম খুবই বেশি। তাই কম করেই কিনলাম। সরকারের লোকজন তো এসি রুমে বসে মিটিং করেন। বাজারে সব কিছু লাগামহীন। তারা তো তা চোখে দেখেন না।’ এ সময় আকলিমা নামের অপর এক ক্রেতা বলেন, ‘লাউ কিনলাম, ১০০ টাকা পিস। অন্য সবজির দামও বেশি। ধুন্দুল ১০০ টাকা।’

শুধু এই বাজারেই নয়, গতকাল বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) রাজধানীর হাতিরপুল, কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, বেশির ভাগ সবজির কেজি ১০০ টাকা। কোনো কোনোটা আবার ২০০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ।

খুচরা বিক্রেতারা সবজির দাম বাড়ার পিছনে বন্যার সঙ্গে আড়তদারদের দোষারোপ করছেন। তবে আড়তদাররা বলছেন, খুচরা বিক্রেতারাই বেশি দাম নিচ্ছেন। ক্রেতারা বলছেন, গত বছরও তো বিভিন্ন জেলা বন্যায় ভেসেছে। তখন এত দাম তো হয়নি। সিন্ডিকেট করেই ভোক্তাদের কাছ থেকে বেশি দাম আদায় করছেন বিক্রেতারা। যে যার মতো দাম হাঁকাচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণে অসাধু চক্র বারবার সুযোগ নিচ্ছে।

গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর বাজার ব্যবস্থাপনা এলোমেলো হয়ে যায়। হঠাৎ করে অধিকাংশ জিনিসের দাম বেড়ে যায়। ওই সময়ে বেগুনের কেজি হয় ৮০-১১০ টাকা। কিন্তু বছরের ব্যবধানে গতকাল বেগুনের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। তাল বেগুন ২৪০ থেকে ২৬০ টাকা, সবুজ গোল বেগুন ১২০ থেকে ১৬০ টাকা ও লম্বা বেগুন ৮০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে।

অন্য সবজিরও একই দশা দেখা গেছে। গত বছরে পটোল, ঢ্যাঁড়শ, ধুন্দুল ৪০-৮০ টাকায় বিক্রি হলেও গতকাল তা ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। ৫০-৬০ টাকার শসা ৮০ থেকে ১৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ৮০-১০০ টাকার করলা ১০০ থেকে ১৪০ টাকা, ৭০ টাকার ঝিঙা ১০০ টাকা, ৭০ থেকে ৮০ টাকার বরবটি ১০০ থেকে ১২০ টাকা, ৬০-৮০ টাকার লাউ ও চাল কুমড়ার পিস ৮০ থেকে ১০০ টাকার কমে মেলেনি। শজনে ডাঁটা ও শিমের দামও বাড়তি। ২০০ টাকা থেকে বেড়ে ২৫০-৩০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে গতকাল। তবে আগের বছরের মতোই পেঁপে ৪০-৫০ টাকা, কচুরমুখী ৭০-৮০ টাকা, টমেটো, গাজর ১৫০-১৭০ টাকা, ২৫০ গ্রাম কাঁচা মরিচ ৫০-৬০ টাকা বা ২০০-২৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। সবজির দাম চড়া থাকায় শাকের দামও বাড়তি। বিভিন্ন বাজারে লাউ ও পুঁইশাকের আঁটি ৪০ টাকা, কলমি শাক, লাল শাক, পালং ও পাট শাক ২০ থেকে ২৫ টাকা আঁটি বিক্রি হয়, যা গত বছরের তুলনায় বেশি।

এদিকে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরও বলছে, এক বছরের ব্যবধানে খুচরা পর্যায়ে বেশির ভাগ সবজির দাম বেড়েছে। যেমন গত বছরের ২১ আগস্ট পটোলের কেজি ছিল ৩০ থেকে ৫০ টাকা। গতকাল তা বিক্রি হয় ৬০ থেকে ৮০ টাকায়, দাম বেড়েছে ৮০ শতাংশ। ৩০ থেকে ৬৫ টাকার শসা ৬০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, দাম বেড়েছে ৬১ শতাংশ। ৪০ থেকে ৬০ টাকার ঢ্যাঁড়শ গতকাল বিক্রি হয়েছে ৬৫ থেকে ৮০ টাকায়, দাম বেড়েছে ৮৯ শতাংশ। ৪০ থেকে ৬০ টাকার চিচিংগা ৫০ থেকে ৭০ টাকায় ভোক্তাদের কিনতে হচ্ছে, দাম বেড়েছে ৪১ শতাংশ। ৫০ থেকে ৮০ টাকার বরবটি ৮০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হয়, দাম বেড়েছে ৪২ শতাংশ। কাঁচা মরিচের কেজি এক বছর আগে ছিল ২২০ টাকা। গতকাল বিক্রি হয়েছে ২৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, দাম বেড়েছে ১৮ শতাংশ।

খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, বন্যায় দেশের অনেক জেলা তলিয়ে গেছে। তার প্রভাবে বাড়ছে সবজির দাম। টাউন হল বাজারের মো. হাবিব, হাতিরপুল বাজারের আলম শেখ ও সেগুনবাগিচা বাজারের আব্দুল বারেকসহ অন্য খুচরা বিক্রেতারাও খবরের কাগজকে জানান, বন্যায় দেশের অনেক জেলা ডুবে গেছে। এ জন্য ঢাকায় সরবরাহ কমে গেছে। বাড়ছে দাম। আবার আড়তদাররা ইচ্ছামতো দাম আদায় করছেন। তাই তাদেরও বাড়তি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।

তবে আড়তদাররা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা বলছেন, কৃষক বা ব্যাপারীর কাছ থেকে যে দামে সবজি কেনা হয়, তার সঙ্গে গাড়িভাড়া, কমিশন ও লেবার খরচ বাদ দিয়ে কেজিতে ২ টাকা থাকলে অনেক লাভ। কাজেই আড়তে সিন্ডিকেট করার সুযোগ নেই। বরং খুচরা বিক্রেতারা বেশি লাভ করছেন। তবে একই পণ্য কারওয়ান বাজারে খুচরা পর্যায়ে বিক্রির আগে কয়েকটা হাতবদল হয়। এর ফলে সেসব পণ্যের দাম বাড়ে। তা যাচাই করতে গত বুধবার রাতে কারওয়ান বাজারের মেসার্স তাওহীদ বাণিজ্যালয় আড়তে গেলে সেখানকার বিক্রয়কর্মী পরিতোষ ও আব্দুল করিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘মানিকগঞ্জ থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকা গাড়ি ভাড়া দিয়ে ৪ টন পেঁপে আনা হয়েছে। তা ১৫ থেকে ২০ টাকায় কেজি বিক্রি হচ্ছে। এর চেয়ে কম আর কী পাওয়া যাবে।’ সেই পেঁপে গতকাল কারওয়ান বাজারেই খুচরা পর্যায়ে ৩০ টাকা কেজি ও টাউন হল বাজারে ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজি বিক্রি করতে দেখা যায়। অন্য সবজিও এভাবে আড়তে অনেক কম দামে বিক্রি হলেও খুচরা বাজারে উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কাঁচামাল আড়তমালিক সমিতির সভাপতি মো. ইমরান মাস্টার খবরের কাগজকে বলেন, ‘বছরের ব্যবধানে অধিকাংশ সবজির দাম বেড়েছে। এর বিভিন্ন কারণে হতে পারে। এখনো চাঁদাবাজি একেবারে বন্ধ হয়নি। সিন্ডিকেটমুক্তও যে হতে পারেনি, তা অস্বীকার করা যাবে না। আবার জায়গা নিতেও চাঁদা দিতে হয়, সেটাও সত্য। আবার ভোক্তার কাছে যেতে কয়েক হাতবদল হয়। তার ভাগ ভোক্তাদের ঘাড়ে চড়ে। এ কারণেই পণ্যের দাম বাড়ে।’

ভোক্তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘সরকার পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে মানুষ অনেক কিছু আশা করেছিল। কিন্তু বাজারে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি। সিন্ডিকেটমুক্ত হতে পারেনি সবজির বাজার। যে যার মতো দাম আদায় করছেন।’

সরকারের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বাজার ব্যবস্থাপনায় বড় ত্রুটি আছে। ভোক্তা অধিদপ্তর, প্রতিযোগিতা কমিশন থাকার পরও বাজারে মনিটরিং না থাকায় এর সুযোগ নিচ্ছে অসাধু চক্র। তাই নজরদারি ও খবরদারি বাড়ানো প্রয়োজন। কোনো সিন্ডিকেট হচ্ছে কি না, তা দেখা দরকার। বাজারে এসব করা হলে ভোক্তারা সুবিধা পাবেন। এ ছাড়া তথ্য-উপাত্তেরও ঘাটতি আছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ হচ্ছে কি না, তা দেখা দরকার। সরবরাহ কম হলে আমদানির দিকে যেতে হবে। আবার কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন কি না, তাও দেখা দরকার। এ জন্য তাদের পণ্য সরাসরি ভোক্তাপর্যায়ে বিক্রির ব্যবস্থা করা দরকার। এতে ভোক্তারা কম মূল্যে পণ্য কিনতে পারবেন, আবার কৃষকরাও ন্যায্যমূল্য পাবেন।’