Published in দৈনিক সংগ্রাম on Monday, 11 June 2018
এইচ এম আকতার
ভুলে ভরা প্রস্তাবিত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট বক্তব্য। এতে করে জনমনে নানা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। প্রস্তাবিত বাজেটে ভ্যাটের স্তর নয় থেকে পাঁচটিতে নামিয়ে আনা হয়েছে। বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত সর্বনিম্ন ভ্যাটের হার ঘোষণা করেছেন, সর্বনিম্ম ২ ও সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ। যদিও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বলছে, ভ্যাটের সর্বোচ্চ হার ১৫ শতাংশ রেখেই স্তর নির্ধারণ করা হয়েছে ছয়টি। এ হারেই ভ্যাট আহরণ করবে তারা। অর্থমন্ত্রী ও এনবিআরের দুই ধরনের তথ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ এতে হয়রানি বাড়বে।
বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে ৪ শতাংশ টার্নওভার ভ্যাট দেয়া প্রতিষ্ঠানের ভ্যাটহার নিয়েও। একইভাবে বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে অনলাইনে কেনাকাটার ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় নিয়েও। বাজেট ব্ক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেছেন,অনলাইনে কেনাকাটায় ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। অথচ এনবিআর বলছে, অনলাইনে কেনাকাটায় কোন ভ্যাট দিতে হবে না। এটি প্রিন্টিং মিসটেক হয়েছে।
একইভাবে বাজেটে কালো টাকার কথা উল্লেখ্য নেই। এখানে সরকার একটি বিভ্রান্তিমূলক কৌশল অবলম্বন করেছেন। বাজেট বক্তব্যে কোন পন্য কিংবা সেবার কথা উল্লেখ্য না থাকলে বুঝতে হবে তা পূর্বের অস্থায় বহাল রয়েছে। বিদায়ী অর্থ বছরে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ ছিল। শর্ত সাপেক্ষে তা বিনিয়োগ করার সুযোগ রাখা হয়েছিল। গত বছরের মত এবারও কালো টাকা রিয়েল স্টেট বা আবাসন খাতে ব্যবহারের সুযোগ রাখার দাবি জানয়েছিলেন রিহ্যাব। কিন্তু বাজেট বক্তব্যে সরকার কি কারণে তা পাশ কাটিয়ে গেলেন তা বুঝা যাচ্ছে না।
মূলত অর্থনীতিবিদদের সমালোচনা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য এ কৌশল অবলম্বন করেছেন। এতেও জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। অর্থমন্ত্রী তার বাজেট পেশের আগে এক বক্তব্যে বলেছিলেন কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাজেটে থাকবে না। কিন্তু বাজেট বক্তব্যে তিনি তা উল্লেখ্য না করে নিজের দেয়া বক্তব্য থেকে সরে এসেছেন। তিনি কালো টাকা সাদা করার সুয়োগ রাখলেন।
পণ্য ও সেবাভেদে বর্তমানে নয়টি স্তরে সর্বনিম্ন দেড় থেকে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ পর্যন্ত ভ্যাট আদায় করে এনবিআর। বাজেট প্রণয়নের আগে ভ্যাটের হারকে দুটি স্তরে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। একটি ১৫ শতাংশ ও অন্যটি ৫ কিংবা ১০ শতাংশ করার কথা বলেছিলেন তিনি। কিন্তু বাজেট বক্তৃতায় ভ্যাট বহুস্তর রেখেই মূল্য সংযোজন কর নীতিমালা ঘোষণা করেন অর্থমন্ত্রী।
বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, এনবিআরের আহরিত রাজস্বের মধ্যে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট খাতের অবদান সবচেয়ে বেশি। আগামী অর্থবছরেও ভ্যাট খাতে সর্বোচ্চ রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ভ্যাট বর্তমানে নয়টি সংকুচিত হারে আরোপ করা আছে। এবার এ হার হ্রাস করে পাঁচটিতে নামিয়ে এনেছি। হারগুলো হলো,২, সাড়ে ৪, ৫, ৭ ও ১০ শতাংশ।
যদিও প্রকৃতপক্ষে ভ্যাটের হার ছয়টি বলে জানিয়েছেন এনবিআরের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, ভ্যাটের বিদ্যমান ১৫ শতাংশ সর্বজনীন হারের পাশাপাশি সংকুচিত মূল্যের ক্ষেত্রে বাজেটে ঘোষিত হার প্রযোজ্য হবে। এনবিআরের ভ্যাট বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ভ্যাটহারের ক্ষেত্রে বিদ্যমান নয়টি স্তরের স্থলে পাঁচটি ঘোষণা করা হলেও ভ্যাট মূলত হবে ছয় স্তরে। ১৫ শতাংশের সর্বজনীন হারের পাশাপাশি নতুন পাঁচটি স্তরে ২, সাড়ে ৪, ৫, ৭ ও ১০ শতাংশ হারে ভ্যাট আহরণ করা হবে। বিদ্যমান ১ দশমিক ৫, ২ দশমিক ৫, ৩, ৪, ৪ দশমিক ৫, ৫, ৬, ৭ দশমিক ৫ ও ১০ এ নয়টি হারকে মূলত পাঁচটিতে একীভূত করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় প্রস্তাবিত সংকুচিত পাঁচটি স্তরের ঘোষণা এলেও সর্বজনীন স্তরটি ভুলক্রমে আসেনি।
জানতে চাইলে এনবিআর চেয়ারম্যান ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, সাধারণভাবে ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ। ভ্যাটের সংকুচিত যে হার বাজেট বক্তৃতায় এসেছে, তাতে ১৫ শতাংশের বিষয়টি হয়তো ভুলবশত আসেনি। আমরা স্বাভাবিকভাবে ১৫ শতাংশ হারেই ভ্যাট আদায় করব। এর বাইরে বাকি যে পাঁচটি স্তর ঘোষণা করা হয়েছে, সেখানে পণ্য ও সেবাভেদে সংকুচিত হারে এ ভ্যাট আদায় করা হবে। এ বিষয়ে এসআরও জারি করা হয়েছে। বাজেট বক্তৃতায় ১৫ শতাংশের বিষয়টি হয়তো কোনোভাবে বাদ গেছে।
একইভাবে অনলাইনে কেনাকাটায় ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অনলাইন কেনাকাটায় কোন ভ্যাট নেই। এটি বাজেট বক্তব্যে উল্লেখ্য করা হলেও তা সঠিক না। আসলে এটি আমাদের প্রিন্টিং মিসকেট।
একই সাথে ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব অর্থাৎ ভাসচ্যুয়াল মিডিয়ার ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাটারোপ করা হয়েছে। বাজেট বক্তব্যে তা উল্লেখ নেই তা উদ্যোক্তা পর্যায়ে না গ্রাহক পর্যায়ে দিতে হবে। এতে এক ধরনের বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। বাজেট পরবর্তী সাংবাদিক সম্মেলনে এনবিআরের চেয়ারম্যান বলেছেন, এটি আসলে ভুল হয়েছে গ্রাহক পর্যায়ে নয়। উদ্যোক্তা পর্যায়ে তা দিতে হবে।
অর্থমন্ত্রী ও এনবিআরের দুই ধরনের তথ্যে বিভ্রান্তিতে পড়েছেন ব্যবসায়ীরাও। তারা বলছেন, বাজেট জাতীয় সংসদে পেশ করা হয় মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদন সাপেক্ষে। এখানে যে ঘোষণা আসে, তা নিয়েই ব্যবসায়ীরা তাদের পরিকল্পনা সাজান। বাজেট প্রস্তাবনায় কোনো কিছু উল্লেখ না করে এসআরওর মাধ্যমে আরোপ করলে তা ঠিক হবে না। তবে কর ও ভ্যাটের ক্ষেত্রে এনবিআরের এসআরও প্রধান বিবেচ্য বলে মানছেন তারা।
জানা গেছে, বাজেটে অনেক বিষয় গোপন(হাইড) রেখে পরবর্তীতে তা এসআরও জারি করে কার্যকর করা হয়। এতে করে ব্যবসাযীরা হয়রানির শিকার হন। গ্রাহক পর্যায়ে ভ্যাট আদায় করতে তাদের কষ্ট হয়। বাজেট বক্তব্যে উল্লেখ থাকলে তা জনগন জেনে যায়। কিন্তু এসআরও জারি করলে তা জনগন জানে না। এতে করে জনগণ এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়ে থাকে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা ও বাজার প্রভাব বিশ্লেষণ ছাড়াই অর্থমন্ত্রী অনেক ঘোষণা দিয়ে থাকেন। এতে ব্যবসায়ী ও ভোক্তা পর্যায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বাজেট প্রস্তাবনায় অর্থমন্ত্রী যে বক্তব্য দেন, তা এক ধরনের দলিল হিসেবে চিহ্নিত। দেশে ভ্যাটের হার কোনোভাবেই ১০ শতাংশের ওপরে হওয়া উচিত নয়। বিশ্বের সব দেশই তাদের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে ভ্যাটহার নির্ধারণ করে। আমাদের দেশেও তাই হওয়া উচিত।
এদিকে ভ্যাটের হারের পাশাপাশি এটিভির হার বাড়ানোর কারণে টার্নওভার ট্যাক্স নিয়েও এক ধরনের অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে। বর্তমানে সুপারশপ ও রিটেইল ব্যবসায়ীরা ৪ শতাংশ হারে টার্নওভার ট্যাক্স প্রদান করেন। এনবিআর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টার্নওভার ট্যাক্স এটিভি হিসাবে আদায় করে বিধায় এর হার নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে তাদের মধ্যে। এনবিআরকে ৫ শতাংশ হারে এটিভি প্রদান করলে চূড়ান্তভাবে ভ্যাটও তাই হয় এসব ক্ষেত্রে। যদিও টার্নওভার বাড়ানো হয়নি এবারের বাজেটে।
চেইনশপ মীনা বাজারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শাহীন খান বলেন, সুপারশপগুলোর কাছ থেকে বর্তমানে ভ্যাট বাবদ ৪ শতাংশ হারে টার্নওভার ট্যাক্স আদায় করে এনবিআর। এটিও অগ্রিম ব্যবসায় ভ্যাট বা এটিভি হিসাবে আমাদের কাছ থেকে কেটে রাখা হয়। এখন এটিভি বাড়ানোর কারণে আমাদের টার্নওভার ট্যাক্স কী হবে, তা নিয়ে এক ধরনের অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে। কর ও ভ্যাটের ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতার চেয়ে এনবিআরের এসআরও আমাদের কাছে প্রধান বিবেচ্য। এনবিআর কী নির্দেশনা দেবে, তা গতকাল রোববার (আজ) জানতে পারব আমরা।
উল্লেখ্য, ভ্যাট নিয়ে জটিলতা এবারই প্রথম নয়। চলতি অর্থবছর থেকেই ১৫ শতাংশের একক ভ্যাটহার চালু করতে চেয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। এক স্তরের ভ্যাটহারে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়া ও ব্যবসায়ীদের ভোগান্তি বাড়ার যুক্তি দেখিয়ে এর বিরোধিতা করতে থাকেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে শেষ পর্যন্ত নতুন আইন কার্যকর ২০১৯ সাল পর্যন্ত পিছিয়ে দেয় সরকার। একই সঙ্গে একক ভ্যাট হারের স্থলে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১ দশমিক ৫, ২ দশমিক ৫, ৩, ৪, ৪ দশমিক ৫, ৫, ৬, ৭ দশমিক ৫, ১০ ও ১৫ শতাংশের পৃথক নয়টি স্তর নির্ধারণ করা হয়।
সরকার রাজনৈতিক কারণে এক স্তরে ভ্যাট আইন প্রয়োগে তৈকে সরে আসেন। এতে বলা হয় আগামী অর্থ বছর থেকে এ আইন কার্যকর করা হবে। এতে করে সারা দেশে সব ধরনের সেবা এবং পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এনিয়ে সরকার একটি কৌশল গত দিক অবলম্বন করেছেন। সামনে নির্বাচন রয়েছে এ কারণেই তারা এই আইন বাস্তবায়ন থেকে কিছুটা পিছু হটছেন। জনগণের স্বার্থে নয় ভোটের স্বার্থে তারা এ আইন বাস্তবায়ন থেকে পিছু হটছেন।
এবারের মত এত বেশি ভুল আর অতীতে দেখা যায়নি। একদিকে প্রিন্টিং মিসটেক অন্যদিকে এনবিআরের সাথে অর্থমন্ত্রীর দেয়া বক্তব্যের কোন মিল নেই। একই সাথে অনেক বিষয় বাজেট বইতে উল্লেখ্য নেই। পরে এসআরও জারি করে তা কার্যকর করা হবে। এভাবে বিভ্রান্তির কৌশল জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ বিভ্রান্তি দুর করে আরও স্বচ্ছ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাজেটে টেকনিক্যাল সমস্যা রয়েছে। সম্পূর্ণ বাজেটটি করা হয়েছে ৮২ টাকা ডলার দিয়ে। তবে এরই মধ্যে বাজারে ডলার ৮৩-৮৪ টাকা হয়ে গেছে। যার কারণে টাকার অংকে পরবর্তীতে মিল থাকবে না।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এই মুহূর্তে আমদানি ২৪ শতাংশের ওপরে চলছে আর ১২ শতাংশ ধরা হয়েছে আগামী বছরের জন্য। অথচ বিদেশ থেকে টাকা আসবে ৬-৭ বিলিয়ন ডলার যেগুলো বড় বড় প্রকল্পের জন্য ব্যবহার করা হবে।এই বিষয়গুলোর অনেক কিছুই নাই। বিষয়গুলো টেকনিক্যাল দিক থেকেও খুবই দুর্বল। বাজেটের এই বিষয়গুলো নিয়ে হায় আফসোস থাকবে অনেকেরই যারা নীতি বিশ্লেষক।
তিনি বলেন, আমাদের এবারের বাজেটে প্রত্যাশাটি সংযত করার ব্যাপার ছিল। প্রথম থেকেই আমরা বলে এসেছি বাজেটে নতুন কিছু ঢুকানো বাতুলতা মাত্র। তবে যে বিষয়গুলো অমীমাংসিত অবস্থায় রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে আমদানির কথা বলেন বা তা বাস্তবায়নের কথা বলেন অথবা সমাবেশ বা ব্যাংকিং এর কথা বলা হোক, এই বিষয়গুলো সাথে থাকবে, যে সরকারই থাকুক। যেহেতু বিষয়গুলো থাকবে সেজন্য আলোচনাও অব্যাহত থাকবে। জায়গা যতই সংকোচিত হোক তার ভেতরে রাখতে হবে।