Originally posted in বাংলা ট্রিবিউন on 5 June 2021
কোভিড পরবর্তী বিশ্বে বাংলাদেশ কেমন অবস্থানে থাকবে, ২০২১-২২ অর্থবছরেই তার একটা ইঙ্গিত হয়তো পাওয়া যাবে। এজন্যই ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট এতটা তাৎপর্যপূর্ণ। করোনাভাইরাস আঘাত না হানলে এই বছরের বাজেটকে আমরা অন্যভাবে মূল্যায়ন করতাম। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের ৫০তম বাজেটকে একটা মাইলফলক হিসেবেই বিবেচনা করা যেত। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে একে কোভিড-১৯ প্রেক্ষিত বিবেচনায় নিয়েই করতে হচ্ছে। সত্যিকার অর্থেই এবারের বাজেট মূল্যায়ন হবে কোভিডের কারণে সৃষ্ট স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা হিসেবে। এই বাজেট মূল্যায়নে আমাদের প্রত্যাশাকে এবং প্রাপ্তির কাঠামোতে বিশ্লেষণ করতে হলে গত এক বছরের অভিজ্ঞতা কতখানি কাজে লাগানো হলো, সেটা নির্ধারণও জরুরি। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১-২২ অর্থবছরের কিছু বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা যায়।
প্রথমত, এবারের বাজেটের সঙ্গে ঘোষিত সামষ্টিক অর্থনীতির যে কাঠামো উপস্থাপন করা হয়েছে, তার সঙ্গে বাস্তবতার সংশ্লিষ্টতা নেই। জিডিপি প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ, বা ব্যক্তি খাতে ঋণ প্রবাহের মতো গুরুত্বপূর্ণ সূচকের প্রক্ষেপণ দেখে মনে হয়েছে এ বিষয়ে খুব মনোযোগ দেওয়া হয়নি। প্রতি বছরেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের সামষ্টিক অর্থনীতির কাঠামো আরও বেশি বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। নিঃসন্দেহে এই প্রক্ষেপণের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় বা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সঙ্গে সমন্বয় নেই।
দ্বিতীয়ত, বাজেটের প্রস্তাবিত আর্থিক কাঠামো, অর্থাৎ সরকারি আয় এবং বরাদ্দের লক্ষ্যমাত্রা গতানুগতিকভাবে তৈরি হয়েছে। চলমান অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নের অগ্রগতি বা অভিজ্ঞতা আমলে নেওয়া হয়নি। ফলে মূল লক্ষ্যমাত্রাগুলো অতিমূল্যায়িত থেকে গেছে। গত এক দশকে বাজেট বাস্তবায়নের হার কমছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গড়ে ৮০% বাজেট বাস্তবায়ন করা গেছে। চলমান অর্থবছরের (২০২০-২১) ক্ষেত্রে এর বড় পরিবর্তন হয়তো হবে না। যেমন, রাজস্ব সংগ্রহের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১০.৭% ধরা হলেও প্রকৃতপক্ষে এটা ৩০% হতে পারে, যা কর ছাড়ের যে নির্দেশনা এসেছে তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না। ফলে আর্থিক কাঠামোর বাস্তবায়ন কঠিন হবে।
তৃতীয়ত, বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে কোভিড বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে প্রাধিকার বিবেচনায় আনা হয়েছে কিনা তা স্পষ্ট নয়। মোট সরকারি ব্যয়ের অংশ হিসেবে স্বাস্থ্য বা কৃষির বরাদ্দ কমেছে। স্বাস্থ্য খাতে কোভিড মোকাবিলায় নতুন কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বর্ধিত বরাদ্দের বড় একটি অংশ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোনও পরিকল্পনা এখনও ঠিক হয়নি বলে বাজেট নথিতে বলা হয়েছে। ফলে মাঠ পর্যায়ে এর প্রস্তুতি নেওয়া সহসা সম্ভব হবে না। সামনের অর্থবছরে প্রণোদনা প্যাকেজের ক্ষেত্র বৃদ্ধির বা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা খুঁজে পাওয়া যায়নি।
চতুর্থত, বাজেটে অধিকাংশ রাজস্ব (কর) পদক্ষেপ ব্যবসা ক্ষেত্রে সহায়তা দেবে। দেশীয় উৎপাদন ব্যবস্থাকে সহায়তা দেওয়ার প্রচেষ্টা এখানে স্পষ্ট। এটা বর্তমান পরিস্থিতিতে ইতিবাচক। তবে এতে কর আদায়ে ছাড়ের ক্ষতি কীভাবে পুষিয়ে নেওয়া হবে তা স্পষ্ট নয়। সার্বিক কর ছাড়ের কারণে কতখানি রাজস্ব হারাতে হবে তা উল্লেখ করলে বাজেটে আরও স্বচ্ছতা আসতো। এবারের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুবিধা দেওয়ার প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসা গেছে। এটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক।
পঞ্চমত, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাজেট বাস্তবায়নে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতি রোধ। এক্ষেত্রে বাজেট বক্তৃতায় আরও গুরুত্ব আশা করেছিলাম।
সবশেষে, বাজেটে সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে আরও গুরুত্ব থাকবে বলে আশা করেছিলাম। এক্ষেত্রে গতানুগতিক রিপোর্ট করা ছাড়া তেমন কিছু নেই।
নিঃসন্দেহে, এই বাজেট বাস্তবায়নে অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাইরে সরকারের অন্যান্য সংস্থার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে অন্যান্য অংশীজনের সহায়তাও প্রয়োজন। বাজেটে এসব বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে জোর না দেওয়া হলেও বাজেট বাস্তবায়ন পর্যায়ে উদ্যোগ থাকতে হবে।
লেখক: সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, সিপিডি