Originally posted in The Business Standard on 1 May 2025
বিনিয়োগ ও সরবরাহ শৃঙ্খল সম্পর্ক জোরদারে বাণিজ্য চুক্তির প্রস্তাব দিয়েছে চীন
চীনের এ প্রস্তাব বাংলাদেশের নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর মাধ্যমে চীনা বিনিয়োগ আকর্ষণের প্রচেষ্টার সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন আরোপিত শুল্কের প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক অস্থিরতা মোকাবিলায় শিল্পখাতের সরবরাহ শৃঙ্খল স্থিতিশীল এবং বাণিজ্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে বাংলাদেশের সঙ্গে একযোগে কাজের প্রস্তাব দিয়েছে চীন।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, রপ্তানি সম্প্রসারণ এবং বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশাধিকার বাড়াতে বেইজিং দুটি সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) প্রস্তাব দিয়েছে। এসব প্রস্তাবের লক্ষ্য—তৃতীয় দেশের আরোপিত বাণিজ্যগত বিধিনিষেধ মোকাবিলা, অবাধ ও উন্মুক্ত বাণিজ্যকে উৎসাহ দেওয়া এবং সরবরাহ শৃঙ্খলকে ‘রাজনীতিকরণ বা অস্ত্রীকরণ’ থেকে বিরত রাখা।
আগামী জুনে বাংলাদেশ-চীন যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের ১৫তম বৈঠকে প্রস্তাবিত স্মারক দুটির স্বাক্ষরের আশাবাদ ব্যক্ত করেছে চীন। এর একটি স্মারক প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ সহযোগিতাকে ঘিরে, অন্যটি শিল্প সরবরাহ ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা ও স্থিতিস্থাপকতা জোরদার-কেন্দ্রিক। ইআরডি কর্মকর্তারা মনে করছেন, এ চুক্তিগুলো দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যসংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
চীনের এ প্রস্তাব বাংলাদেশের নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর মাধ্যমে চীনা বিনিয়োগ আকর্ষণের প্রচেষ্টার সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ। চলতি মাসেই ঢাকায় আসছে চীনের একটি ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদল। তারা বাংলাদেশে উৎপাদন স্থানান্তরের সুযোগ-সুবিধা যাচাই করবে। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কের কারণে চীনা কোম্পানিগুলোর বিদেশে উৎপাদন স্থানান্তরের প্রবণতা বাড়ায় এ সফর গুরুত্ব পাচ্ছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের কৌশলগত স্বার্থের ক্ষেত্রগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।’ তিনি বলেন, সমঝোতা স্মারকের আওতায় সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো—যেমন মানবসৃষ্ট তন্তু, হালকা প্রকৌশল, ওষুধ, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, কোল্ড চেইন লজিস্টিকস ও অবকাঠামো উন্নয়ন—যেন জাতীয় অগ্রাধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
তিনি আরও বলেন, চীন থেকে স্বল্প সুদে অর্থায়নের বিষয়টিও চুক্তির আওতায় বিবেচনায় আনা যেতে পারে। তবে এটি যেন অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বিদ্যমান সম্পর্কের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
গত ২৩ মার্চ ঢাকায় চীনা দূতাবাস ইআরডির কাছে প্রস্তাবিত দুটি খসড়া স্মারক পাঠায়। এরপর ২৩ এপ্রিল অতিরিক্ত সচিব মিরানা মাহরুখের সভাপতিত্বে আন্তঃমন্ত্রণালয় পর্যায়ে এসব খসড়া পর্যালোচনা করা হয়। চীন ১৯৯৬ সালের বাংলাদেশ-চীন বিনিয়োগ সুরক্ষা চুক্তি হালনাগাদ করার প্রস্তাবও দিয়েছে।
চীনের বিশাল বাজার থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের রপ্তানি সেখানে এখনও সীমিত। ২০২২-২৩ অর্থবছরে চীনে রপ্তানির পরিমাণ ছিল মাত্র ৭১৫ মিলিয়ন ডলার, যা মোট রপ্তানির মাত্র ১.৬১ শতাংশ। বিপরীতে, চীন থেকে আমদানি ছিল প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের মোট আমদানির প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। এসব আমদানির বড় অংশই শিল্প কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতিনির্ভর।
অর্থনৈতিক সহযোগিতায় জোর
বাণিজ্য সহযোগিতা বিষয়ক খসড়া স্মারকে সরবরাহ শৃঙ্খলে সংযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে বাণিজ্য সুবিধা, ডিজিটালাইজেশন এবং পরিবেশবান্ধব বাণিজ্যের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে। দ্বিতীয় স্মারকে তৃতীয় পক্ষের বাণিজ্য বিধিনিষেধ মোকাবিলা এবং দ্বিপাক্ষিক শিল্প সহযোগিতা জোরদারের বিষয়টি উঠে এসেছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান ড. এমএ রাজ্জাক বলেন, ‘কৃষিভিত্তিক কোল্ড চেইন লজিস্টিকসে চীনের আগ্রহ থাকলে, এ খাতে বাংলাদেশের রপ্তানি সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে পারে।’
বাংলাদেশ-চীন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক মহাসচিব আল মামুন মৃধা বলেন, শুল্ক ও অশুল্ক বাধা অনেক সময় বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তার মতে, জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ এসব সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। পাশাপাশি অবকাঠামোগত অর্থায়নের ক্ষেত্রে আরও অনুকূল শর্ত নিয়ে আলোচনা করাও সম্ভব হবে।
চীনের জন্য তিনটি অর্থনৈতিক অঞ্চল
আরও চীনা বিনিয়োগ আকর্ষণে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) চট্টগ্রামের আনোয়ারায় একটি চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চলের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। এছাড়া, চাঁদপুর ও ভোলায় আরও দুটি চীনা অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। গত মাসে বিনিয়োগ শীর্ষ সম্মেলনে চীনের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং ইউনান প্রদেশের গভর্নর ওয়াং ইউবোর সফর দেশটির আগ্রহকে আরও জোরদার করেছে।
আগামী মে মাসে চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াং ওয়েন্টাও ২০০ সদস্যের একটি ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদল নিয়ে বাংলাদেশ সফরে আসবেন বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এবং বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন সম্প্রতি বলেন, ‘যথাসময়ে প্রয়োজনীয় সহায়তা নিশ্চিত করা গেলে, চীনা কোম্পানিগুলো দ্রুত বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।’
এছাড়া চীন বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের পরবর্তী দুই বছরের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ আসিয়ান জোট ও চীন নেতৃত্বাধীন রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি)-এ যোগদানের আবেদন করেছে। ভবিষ্যতে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির সম্ভাবনা নিয়ে দুই দেশ একটি যৌথ সম্ভাব্যতা সমীক্ষাও চালাচ্ছে।