এতদিন রাজনৈতিক কারণে বিকৃত পরিসংখ্যান সরবরাহ করা হয়েছে – ড. দেবপ্রিয়

Originally posted in বণিকবার্তা on 25 August 2024

বানোয়াট পরিসংখ্যানের প্রধান পরিকল্পনাকারী লোটাস কামাল

সরকারি পরিসংখ্যান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই নানা প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পরও দেশে আশানুরূপ কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ায় অর্থনীতির মূল সূচকগুলো হয় প্রশ্নবিদ্ধ। ২০১৪ সালে পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামাল দায়িত্ব নেয়ার পর পরিসংখ্যান বিভ্রাট আরো প্রকট হয়। মূল্যস্ফীতিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ডাটা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে পাঁচ-ছয়জনের একটি সিন্ডিকেট। অর্থনৈতিক বিভিন্ন সূচকের তথ্য ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানোর অভিযোগ ওঠে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গেও বাড়তে থাকে পরিসংখ্যানগত পার্থক্য। এ প্রবণতা অব্যাহত ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের পরবর্তী সময়েও। বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যেই কেবল সাড়ে ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বেশি দেখানো হয়েছিল। এসব বানোয়াট পরিসংখ্যানের প্রধান পরিকল্পনাকারী হিসেবে মনে করা হয় লোটাস কামাল তথা তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী মুস্তফা কামালকে।

আ হ ম মুস্তফা কামাল ১৯৭০ সালে পুরো পাকিস্তানের চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অর্জন করেন। এর আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৭ সালে কমার্সে স্নাতক ডিগ্রি এবং ১৯৬৮ সালে অ্যাকাউন্টিংয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। আইন শাস্ত্রেও রয়েছে তার স্নাতক ডিগ্রি। মেধার স্বীকৃতি হিসেবে শিক্ষাজীবনেই তিনি ‘লোটাস’ উপাধি পেয়েছিলেন। তবে তার এ জ্ঞানকে ভালো কাজে ব্যবহার হয়নি বলে মনে করেন অনেকেই। ২০১৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে আবারো ক্ষমতায় এলে মিথ্যা তথ্য তৈরির পুরস্কার হিসেবে পরিকল্পনামন্ত্রী লোটাস কামালকে ২০১৯ সালে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে বসান শেখ হাসিনা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক অর্থনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল দেশের পরিসংখ্যান, যা পরিচালিত হতো শীর্ষ পর্যায় থেকে। ফলে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে মিল রেখে ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধি দেখানো হতো। কিন্তু সামষ্টিক তথ্যের সঙ্গে যার কোনো মিল ছিল না। মূলত রাজনৈতিক কারণে পদ্ধতিগত পরিবর্তন এনে সরবরাহ করা হয় বিকৃত পরিসংখ্যান। এসব ভুল তথ্যের ভিত্তিতে নীতি নির্ধারণের কারণেই ধাক্কা লেগেছে দেশের অর্থনীতিতে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পরিসংখ্যানগত পারফরম্যান্স বিবেচনায় স্কোর প্রকাশ করে থাকে বিশ্বব্যাংক। ২৫টি সূচক বিবেচনায় এমন তালিকা তৈরি হয়। ২০১৪ সালে প্রকাশিত স্ট্যাটিস্টিক্যাল ক্যাপাসিটি ইন্ডিকেটরে বাংলাদেশের স্কোর ছিল একশর মধ্যে ৮০। কিন্তু এরপর থেকে তা ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। ২০১৮ সালে সে স্কোর দ্রুত হ্রাস পেয়ে ৬২-তে নেমে যায়। ২০২০ সালে নেমে আসে ৬০-এ, যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার গড় স্কোর ছিল ৬৯। সে সময় মেথডোলজি বা পদ্ধতিগত সূচকে সবচেয়ে বড় পতনের মুখে পড়ে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে ২০১৪ সালের ৭০ স্কোর থেকে ২০২০ সালে তা অর্ধেকের বেশি কমে ৩০-এ নেমে আসে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দেশের সব ধরনের সরকারি পরিসংখ্যান তৈরি ও প্রকাশ করে থাকে। এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের পরই বিবিএসে নিজের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ সময় সংস্থাটির মাধ্যমে নিয়মিত মাসিক মূল্যস্ফীতি প্রকাশের দায়িত্বটিও তিনি নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন। পরবর্তী সময়ে বিবিএসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সিপিআই শাখার জনবলেও পরিবর্তন আনা হয়। পদায়ন করা হয় মুস্তফা কামালের আশীর্বাদপ্রাপ্তদের। তৎকালীন মন্ত্রীর এসব কাজ দেখভাল করতেন মাসুদ রানা চৌধুরী নামে অর্থনৈতিক ক্যাডারের এক বিশেষ সহায়ক। তার মাধ্যমেই মুস্তফা কামাল যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

বিবিএসের বর্তমান ও সাবেক পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত দেড় দশকে প্রতিষ্ঠানটিতে কথা বলার মতো পরিস্থিতি ছিল না। পরিসংখ্যান নিয়ে কেউ ন্যূনতম আপত্তি তুললে বা কথা বলার চেষ্টা করলে ঢাকার বাইরে বা কম গুরুত্বপূর্ণ শাখায় বদলি করে দেয়া হতো। এমনকি বিনা কারণে হয়রানির জন্য বিভাগীয় মামলাও করা হয়। আর সংস্থাটির বিভিন্ন শাখা থেকে শুরু করে উপমহাপরিচালক ও মহাপরিচালক হয়ে সচিবের দপ্তরে চলত পরিসংখ্যান ইঞ্জিনিয়ারিং। এমনকি কখনো কখনো মূল্যস্ফীতির এসব ফাইল মন্ত্রী হয়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনও নিতে হতো। অথচ বিধি অনুযায়ী বিবিএসের সব তথ্য প্রকাশের দায়িত্ব মহাপরিচালকের।

তৎকালীন বিবিএসের প্রকাশিত তথ্যের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যগত পার্থক্য বেড়েই চলছিল। ২০১৮ সালে প্রবৃদ্ধির তথ্যে বিস্তর ফারাক নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ান মুস্তফা কামাল। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। যদিও লোটাস কামাল ওই বছরের এপ্রিলে প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ হবে বলে দাবি করেন। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস ছিল, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে বড়জোর ৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এডিবির পক্ষ থেকেও সরকারের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করা হয়।

এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংকের ডাটাকে চ্যালেঞ্জ করে সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়। সেখানে মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, ‘‌আমাদের ডাটাই সঠিক।’ সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাংককে ‘আলটিমেটাম’ দিয়ে অচিরেই বিবিএসের সঙ্গে বসে ডাটা সংশোধনের জন্য সময়ও বেঁধে দিয়েছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী। এমনকি নিজে ফোন করে বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধিদের চাপ প্রয়োগ করেছিলেন তা দ্রুতই সংশোধনের জন্য।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের তৎকালীন মুখ্য অর্থনীতিবিদ ছিলেন ড. জাহিদ হোসেন। এ বিষয়ে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ওই সময়ে সরকারি প্রবৃদ্ধির হিসাব মেলানো যাচ্ছিল না। এটা নিয়ে আমরা বিভিন্ন মডেল দিয়ে ব্যাখ্যাও দিয়েছিলাম। এতে মন্ত্রী মুস্তফা কামাল ক্ষেপে গিয়ে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টরকে ফোন করেছিলেন। তাকে ডেকে নিয়ে বিবিএসের তথ্য সঠিক–এ ব্যাখ্যা করেছিলেন। ২০১৫-১৯ সালের সময়টায় সরকারি প্রবৃদ্ধির হিসাবের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশের হিসাব মিলছিল না, এমনকি এটা ব্যাখ্যার অযোগ্য ছিল। কিন্তু সম্পর্ক আরো নষ্ট হবে, তাই আমরা তখন সরাসরি এটা বলিনি। ২০২২ সালে অবশ্য আমাদের একটি রিপোর্টে বিষয়টি আকারে-ইঙ্গিতে বর্ণনা করা হয়েছিল।’

তথ্য বিভ্রান্তির পরিণাম নিয়ে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘এটা চোখ বন্ধ করে গাড়ি চালানোর মতো। ডাটা বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণা দেয়। কিসের ভিত্তিতে দেশ চালাবেন, এটা বলে দেয় পরিসংখ্যান। কিন্তু ভুল তথ্যের ভিত্তিতে নীতি নির্ধারণ করলে আপনাকে কোথাও না কোথাও ধাক্কা খেতে হবে। যেমনটা এখন দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া রাজস্ব ও রফতানিসহ সব পরিসংখ্যানের মধ্যেই দূষণ ধরা পড়ছে।’

২০২২ সালে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ‘কান্ট্রি ইকোনমিক মেমোরেন্ডাম–চেঞ্জ অব ফ্যাব্রিক’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১০ সালে বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির মধ্যে পার্থক্য বাড়তে থাকে। তবে ২০১৫-১৯ সময়ের মধ্যে প্রবৃদ্ধির এ পার্থক্য ৩ দশমিক ৭ শতাংশে উন্নীত হয়, যা ব্যাখ্যার অযোগ্য।

লোটাস কামালের সময় বিবিএস একটি গোষ্ঠীর মাধ্যমে পরিচালিত হতো বলে অভিযোগ করেন সংস্থাটির পরিচালক আব্দুল কাদির মিয়া। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্ম সচিব ড. দিপংকর রায়ের মাধ্যমে পাঁচ-ছয়জনের সিন্ডিকেটের একটি বলয় তৈরি করে বিবিএস পরিচালিত হতো। এমনকি কয়েকবার বদলির আদেশ ঠেকিয়ে এ কর্মকর্তাকে বিবিএসে রাখা হয়। কেউ তাদের কাজে প্রশ্ন তুললে বিভিন্ন রাজনৈতিক ট্যাগ দেয়া হতো। মূল্যস্ফীতি প্রকাশের দায়িত্বে থাকা সিপিআই শাখার এক উপপরিচালককে এমন ট্যাগ দিয়ে ট্রেনিং কলেজে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। ওই শাখায় দায়িত্ব দেয়া হয় মুস্তফা কামালের পরিচিতদের। তাদের একজন বিবিএসের উপপরিচালক মহিউদ্দীন আহমেদ। মূলত মাসুদ রানার মাধ্যমে কুমিল্লায় বাড়ি পরিচয় দিয়ে মুস্তফা কামালের সান্নিধ্যে আসেন তিনি। প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের রাজনীতিও করতেন। আর মাসুদ রানা পরবর্তী সময়ে মন্ত্রীর মাধ্যমে বিদেশে পোস্টিং বাগিয়ে নেন। একটি সরকারি ব্যাংকের পরিচালকও করা হয় এ কর্মকর্তাকে।’

আব্দুল কাদির মিয়া বিভাগীয় মামলা নিয়ে বিনা দপ্তরে চাকরি করেছেন। বিভিন্ন অন্যায়ের প্রতিবাদ জানানোই কাল হয়েছিল বলে মনে করছেন তিনি। মিথ্যা হয়রানি থেকে রেয়াই পেতে সম্প্রতি পরিসংখ্যান সচিবকে এ কর্মকর্তা উকিল নোটিস পাঠান। সর্বশেষ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ২০ আগস্ট এ কর্মকর্তাকে বিভাগীয় মামলা থেকে মুক্তি দেয়া হয়।

দীর্ঘ আট বছর সিপিআই শাখায় কাজ করা বদলীকৃত ওই উপপরিচালকের সঙ্গে কথা হয় বণিক বার্তার। নাম না প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমাকে নানাভাবে ট্যাগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু বদলির আদেশ আমার জন্য ভালো ছিল। ট্রেনিং কলেজে গিয়ে আমি বিদেশে ট্রেনিংয়ের স্কলারশিপ পেয়েছি। একজন নিজেকে আওয়ামী লীগের লোক দাবি করে যদি গুরুত্বপূর্ণ এ ডেস্ক দাবি করে থাকেন, তাহলে আমার তো কিছু বলার নেই। এটা আকর্ষণীয় একটি ডেস্ক ছিল। তাই হয়তো কেউ এখানে আসতে চেয়েছিলেন। আমি আমার বদলি আদেশ নিয়ে চলে গিয়েছিলাম। তবে আগে বিবিএস থেকেই মূল্যস্ফীতি প্রকাশিত হতো। মুস্তফা কামাল তা পরে নিজের অধীনে নিয়েছিলেন।’

মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, মূল্যস্ফীতির বাস্কেটে ৭৪৯টি পণ্য যুক্ত করা হয়েছে। এখানে আলমারি, ল্যাপটপ, চেয়ার-টেবিল থেকে এমন অনেক পণ্য রয়েছে; যা হয়তো কেউ জীবনে একবার ক্রয় করে। আগে ৪২০টি পণ্য ছিল। কিন্তু এখন অনেক পণ্য থাকায় নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও তা মূল্যস্ফীতিতে তেমন প্রভাব ফেলে না। যদিও অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের হিসাবে মূল্যস্ফীতি প্রকাশ করা হয়, তাহলে এটা বর্তমান হারের কয়েক গুণ হয়ে যাবে।

বিবিএসের ডাটা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বর্ণনা দিয়ে সাবেক পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘সাবেক এক উপদেষ্টা একবার আমাকে সিপিআই (মূল্যস্ফীতি) কমিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে দু-একজন মন্ত্রীও এ কাজ করেছেন। মূল্যস্ফীতি কোনো মাসেই দুই ডিজিটে যায় না। ৯ দশমিক ৬৭ কিংবা ৯২ হয়। কেন ১০ শতাংশ পার হয় না? বিভিন্ন জরিপের ক্ষেত্রে প্রশ্নপত্র তৈরিতে ইঞ্জিনিয়ারিং হয়। যে ফলাফল প্রত্যাশা করা হয় সেভাবেই সাজানো হয় প্রশ্ন। যেমন ধরেন প্রশ্ন করা হয়—আপনার বাসার টয়লেটে কি ফ্ল্যাশ আছে? উত্তর হ্যাঁ, মানেই স্যানিটারি ল্যাট্রিন ধরে নেয়া হয়। কিন্তু ফ্ল্যাশের সঙ্গে এটার কোনো সম্পর্ক নেই। মানে নির্মোহ না থেকে উদ্দেশ্যমূলক প্রশ্নপত্র করা হয়। ডাটা বিশ্লেষণের সময় ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কাজ হয়ে যায়।’

বড় বড় শুমারির তথ্য যাচাইয়ের প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেন, ‘দেশের অর্থনৈতিক ও বড় বড় কৃষিশুমারি কীভাবে হয়েছে—এসব দেখা উচিত। ভেতরে অনেক কিছু আছে। মেকানিজম করা হয়। তবে সব সময় মন্ত্রী পর্যন্ত যেতে হয় না। মহাপরিচালক ও উপমহাপরিচালক হয়ে সচিব পর্যায়ে অনেক কাজ হয়ে যায়। এসব ফায়ারওয়ালে অনেক কিছু আটকে যায়। শাহনাজ আরেফিনের মতো সরকারের একনিষ্ঠ সচিব থাকতে কেন সবকিছু মন্ত্রীর দপ্তর পর্যন্ত যেতে হবে? তিনি তো তরতর করে প্রমোশন পেয়েছেন।’

একবার তথ্য বিকৃতি ঠেকানোর অভিজ্ঞতা জানিয়ে ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিং উইংয়ের সাবেক এ পরিচালক বলেন, ‘মুস্তফা কামালের বক্তব্যের জন্য একবার ফোরকাস্ট করে তথ্য বানিয়ে দিয়েছিলেন দিপংকর রায়। সেখানে প্রবৃদ্ধি, কলকারখানার তথ্যসহ বিভিন্ন পরিসংখ্যান বাড়িয়ে দেখানো হয়েছিল। আমি বলেছিলাম এসব তথ্য উপস্থাপন হলে আপনার সম্মান থাকবে না। পরে মন্ত্রী এসব তথ্য উপস্থাপন করা থেকে বিরত হয়েছিলেন।’

২৭ বছর বয়সে বিবিএসে যোগদান করা এ কর্মকর্তা ৩২ বছরে শত অফিসারকে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিদায় জানালেও নিজের শেষ সময়ে কোনো বিদায় অনুষ্ঠান পাননি। স্পষ্টবাদী হওয়ায় এমনটা হয়েছে বলে মনে করছেন তিনি। মুস্তফা কামালের আমলসহ কয়েকবার বঞ্চিত হয়েছেন পদোন্নতি থেকেও। শেষ সময়ে তাকে বদলি করা হয়েছিল ট্রেনিং কলেজে। অভিমানে অবসরের পর একবারও যাননি বিবিএস ভবনে।

লোটাস কামালের সময় কারণে-অকারণে অনেককে ঢাকার বাইরেও বদলি করা হয়। ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিং শাখায় পরিসংখ্যান কর্মকর্তা হিসেবে দুই বছর বিভিন্ন স্থানে কাজ করে ঢাকায় এসেছিলেন সজল হায়দার। আট মাসের সন্তানসম্ভবা স্ত্রী বাসায় থাকলেও এক সকালে হঠাৎ তাকে স্ট্যান্ড রিলিজ করে বান্দরবান পাঠিয়ে দেয়া হয়। উইং পরিচালকসহ অনেক সহকর্মী চেষ্টা করেও তার বদলি ঠেকাতে পারেননি। অথচ মাঠ থেকে দুই বছর কাজ করে আসায় তখন তাকে ঢাকার বাইরে পাঠানোর কথা না। কিন্তু জুনিয়র পোস্টে থেকেও কেন তাকে এভাবে হঠাৎ বদলি করা হয়েছিল, তা তিনি আজও জানেন না। বণিক বার্তাকে সজল হায়দার বলেন, ‘তখন আমার অনেক খারাপ পরিস্থিতি ছিল। মাত্র দুই মাস পর আমার সন্তান আসতে যাচ্ছিল। মানসিকভাবেও খুব কষ্ট হয়েছিল আমার।’

দেশের বিভ্রান্তিকর পরিসংখ্যান নিয়ে ২০২২ সালে ‘‌উন্নয়ন বিভ্রম এক দশকের অর্থনীতির না বলা ইতিহাস’ শীর্ষক বই লেখেন পরিসংখ্যান বিশেষজ্ঞ জিয়া হাসান। সাড়া জাগানো বইটিতে এ প্রবাসী লেখক পদ্ধতিগত ব্যাখ্যার মাধ্যমে সরকারি পরিসংখ্যানের অসারতা তুলে ধরেন। পরিসংখ্যানগত কারসাজি নিয়ে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘দেশের শীর্ষ পর্যায় থেকেই ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি দেখিয়ে যাওয়ার একটি প্রবণতা ছিল। রাজনৈতিক অর্থনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল দেশের পরিসংখ্যান। তাই সুনিপুণভাবে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সঙ্গে প্রবৃদ্ধি দেখানো হলেও ম্যাক্রোর ডাটার সঙ্গে তার কোনো মিল ছিল না। প্রবৃদ্ধি বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়ার কথা। কিন্তু শিল্প প্রবৃদ্ধি দেখানো হলেও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি দেখানো হয়েছিল কৃষিতে। আবার কর্মসংস্থান না বাড়লে, শিল্প ব্যাপক মেকানাইজেশন হওয়ার কথা। কিন্তু সেটাও আমরা সেভাবে দেখিনি।’

সঠিক পরিসংখ্যান পেলে শেখ হাসিনা সরকারের জন্য সঠিক নীতি গ্রহণে কাজে লাগত উল্লেখ করে জিয়া হাসান বলেন, ‘ভুল ডাটার কারণে সুদের হার, মানি সার্কুলেশনের মতো বিষয়ে সঠিক কোনো নীতি গ্রহণ করা যায়নি।’

এদিকে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হওয়ার পর বৈষম্য নিরসনে বিক্ষোভ হয় বিবিএসে। সেখানে সংস্থাটির সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে অন্যায় সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সচিবকে অবরুদ্ধ করার ঘটনাও ঘটে। অন্য একটি ক্যাডার থেকে নিয়োগ পাওয়া মহাপরিচালক ও উপমহাপরিচালকদের মাধ্যমে তথ্য বিভ্রাটের যাবতীয় কাজ করা হয় বলেও অভিযোগ করেন বিবিএসের কর্মকর্তারা। তাই পরিসংখ্যান ক্যাডার থেকেই এসব পদে নিয়োগের দাবি তাদের। অস্থিরতা বাড়তে থাকায় সিপিআই শাখায়ও পরিবর্তন আনা হয়। সরিয়ে দেয়া হয় দায়িত্বে থাকা মহিউদ্দীন আহমেদকে। এ বিষয়ে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে এটার সম্পর্ক নেই।’ আওয়ামী লীগের রাজনীতিসহ সিন্ডিকেট করার বিষয়ে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘‍দুষ্টলোকেরা আমার নামে মিথ্যা-বানোয়াট অভিযোগ দিচ্ছে।’

সরকারি পরিসংখ্যানে সন্দেহ করার মতো যথেষ্ট কাজ হয় বলে স্বীকার করেছেন খোদ পরিসংখ্যান বিভাগের সাবেক সচিব রীতি ইব্রাহীম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রে মাঠ থেকে নিয়ে আসা পরিসংখ্যানের পরিবর্তে ওপর থেকে বলে দেয়া হয় সংখ্যা এটা হবে। বিশেষ করে ওপরের পর্যায় থেকে এটা করা হয়। তাই মহাপরিচালকসহ অন্যান্য পদে প্রশাসন ক্যাডারের লোকজন না রেখে পরিসংখ্যানের লোকজন নিয়োগ দিতে হবে। বিবিএস পরিচালিত হচ্ছে পরিসংখ্যানবিদ ছাড়া। তাই পরিসংখ্যানের জন্য আলাদা একটি কমিশন গঠন করে পরিসংখ্যানবিদদের মাধ্যমে সংস্থাটি পরিচালনা করা উচিত।’

সরকারের অতিরিক্ত সচিবের দায়িত্বে থাকা মাসুদ রানা চৌধুরীর সঙ্গে অভিযোগের বিষয়ে কথা হয় বণিক বার্তার। তিনি বলেন, ‘তৎকালীন মন্ত্রীর দপ্তরে অ্যাটাচমেন্টে দায়িত্ব পালন করেছি আমি। তখন কখনো বিবিএসের ফাইল দেখা হতো। কোনো বিষয়ে জানার জন্য মন্ত্রীর নির্দেশে বিবিএস কর্মকর্তাদের ফোন করে হয়তো ডাকতাম আমি। তাই আমার নাম বলা হচ্ছে। আর দক্ষিণ কোরিয়ায় আমি কমার্শিয়াল কাউন্সিলর হিসেবে পোস্টিং পেয়েছি পরীক্ষার মাধ্যমে বাছাই হয়ে। কিন্তু মনে করা হয় মন্ত্রীর জন্য এটা হয়েছে। এটা কষ্ট লাগে।’ এ সময় বিবিএস নিয়ন্ত্রণ করার কথা অস্বীকার করেন এ কর্মকর্তা।

একইভাবে পরিসংখ্যান বিভাগের যুগ্ম সচিব দিপংকর রায় সিন্ডিকেটের অভিযোগ অস্বীকার করে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অন্য জায়গায় পোস্টিং হলেও কাজের প্রয়োজনে সচিব স্যার আমি এখানে থাকি তা চেয়েছিলেন। তাই ছয়-সাত বছর ধরে এখানে আছি আমি।’

সার্বিক অভিযোগের বিষয়ে জানার জন্য পরিসংখ্যান বিভাগের সিনিয়র সচিব ড. শাহনাজ আরেফিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি বিবিএসের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। ছুটির দিনে ফোন করায় বিরক্তি প্রকাশ করে তিনি বিবিএসের মহাপরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। এসব বিষয়ে জানার জন্য সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তনের পর আ হ ম মুস্তফা কামাল দেশ ছেড়েছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে।

দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা ও করণীয় নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ উদ্যোগে অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য নেতৃত্ব দেবেন বলে জানা গেছে। শ্বেতপত্রে সরকারি পরিসংখ্যান পর্যালোচনার বিষয়টি থাকবে কিনা, জানতে চাইলে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘কমিটি গঠন হলে কী করা হবে তা বসে ঠিক করা হবে। তবে তথ্য-উপাত্তের সঠিকতা যাচাই করা খুবই প্রয়োজন। কারণ বিগত সময়ে রাজনৈতিক কারণে পদ্ধতিগত পরিবর্তনের মাধ্যমে বিকৃত পরিসংখ্যান সরবরাহ করা হয়েছে। এসব কাজের জন্য আলাদা একটি ডাটা কমিশন গঠনের প্রস্তাব করেছি আমরা। যার মাধ্যমে জিডিপির হিসাব ঠিক করতে হবে। শুধু বিবিএস না, ইআরডি ও ব্যাংকের পরিসংখ্যানও চেক করা হবে। তাছাড়া কর্মসংস্থান ও মজুরিসহ যেসব গুরুত্বপূর্ণ ডাটা আমাদের এখনো নেই সেগুলোর কাজও শুরু করা হবে।’