Originally posted in প্রথম আলো on 10 November 2024
সংবাদ সম্মেলনে আনু মুহাম্মদ
আওয়ামী লীগ আমলের জ্বালানি মহাপরিকল্পনা বাতিলের দাবি
জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো জলবায়ু বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞদের বাদ দিয়ে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের দিয়ে বিগত সরকার জ্বালানি মহাপরিকল্পনা তৈরি করেছে। নীতিগত জায়গা থেকে অন্তর্বর্তী সরকারকে ওই মহাপরিকল্পনা বাতিল করতে হবে। যদি পিএসসিসহ অন্যান্য সব নীতির পরিবর্তন না হয়, তাহলে বৈষম্যবিরোধী বাংলাদেশ গঠন করা যাবে না।
শনিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এ কথাগুলো বলেন। বেসরকারি সংগঠন ধরা, ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ, মার্কেট ফোর্সেস এবং ফসিল ফ্রি চট্টগ্রামের পক্ষ থেকে ‘ব্যয়বহুল এলএনজির বিস্তার: বিদেশিদের গ্যাসসংক্রান্ত স্বার্থ যেভাবে বাংলাদেশের জন্য জলবায়ু ঝুঁকি তৈরি করছে’ শিরোনামে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে আনু মুহাম্মদ বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানি এবং এলএনজির আমদানি দেশের জন্য আর্থিক বোঝা, যা দেশের প্রাণ-প্রকৃতি বিনাশের সঙ্গে জড়িত। বিগত সরকারের সময়ে জ্বালানি খাতে পরিকল্পনা করা হয় বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মতো বহুজাতিক পুঁজির স্বার্থে। বর্তমান সরকারের উচিত এসব বাদ দিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রযুক্তিগত বিকাশের জন্য কাজ করা।
অনুষ্ঠানে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ধরার উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার সভাপতিত্ব করেন। এটি সঞ্চালনা করেন ধরার সদস্য সচিব শরীফ জামিল। অনুষ্ঠানে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন মার্কেট ফোর্সেসের এশিয়া এনার্জি অ্যানালিস্ট মুনিরা চৌধুরী। এতে বলা হয়, এলএনজি প্রকল্প এবং আমদানি টার্মিনাল উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশকে প্রায় ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করতে হবে। এ প্রকল্পগুলোর কারণে দেশের অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়বে, একই সঙ্গে দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব—যেমন বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে লাখ লাখ মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হবে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যখন দেশ তীব্র তাপপ্রবাহ এবং বিদ্যুতের চাহিদার সংকটে রয়েছে, এলএনজির ওপর ৫০ বিলিয়ন ডলারের এ বিনিয়োগের পরিবর্তে বাংলাদেশ ৬২ গিগাওয়াট নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন সক্ষমতা অর্জন করতে পারে, যা দেশের বর্তমান বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতার দ্বিগুণ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রস্তাবিত ৪১টি নতুন গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে বিষাক্ত গ্যাস নির্গমন হবে, যা শ্বাসযন্ত্রের সমস্যাগুলোর প্রকোপ বৃদ্ধি করবে এবং বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যতম খারাপ অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে নিয়ে যাবে।
মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, ‘এই গ্যাস ও এলএনজি প্রকল্পগুলো আমাদের জনগণের সম্পদ দখল করে গড়ে উঠেছে। যারা এসব স্থাপনা গড়ে আমাদের সম্পদ দখল করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে; প্রয়োজনে ফৌজদারি মামলা দিতে হবে। তাদের কাছ থেকে জবাবদিহি চাইতে হবে। জনগণের ক্ষতি করে, এমন কোনো প্রকল্প আমরা চাই না। অনুমান বাদ দিয়ে, আমাদের চাহিদা অনুযায়ী বিনিয়োগ করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপ করে সরকারের নীতিমালায় এই দাবি অন্তর্ভুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।’
সংবাদ সম্মেলনে জাপানের বিশেষজ্ঞ মেগু ফুকুজাওয়া বলেন, জাপানি কোম্পানি মিৎসুই, জেরা, সুমিতামো, মিৎসুবিশিসহ জাপানি ব্যাংকগুলো এখানে যুক্ত আছে। জাইকা, আইইইজে (এনার্জি থিঙ্কট্যাংক ইনস্টিটিউট অব এনার্জি ইকোনমিকস জাপান) এই মহাপরিকল্পনা তৈরি করেছে। ভবিষ্যতের জ্বালানি চাহিদার ক্ষেত্রে হাইড্রোজেন, অ্যামোনিয়া কিংবা সিসিএস হলো অপ্রমাণিত ও মিথ্যা প্রতিশ্রুতি। ২০৫০ সালের মধ্যে শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে যেতে জীবাশ্ম জ্বালানির বিপরীতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে জাপান সরকারের অবশ্যই দায়িত্ব রয়েছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘এত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে এবং আরও পরিকল্পনা করা হয়েছে, তা দিয়ে আমরা কী করব। বিদ্যুৎকেন্দ্র যা আছে, তার মধ্যে দিয়ে চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের দরকার নেই।’ তিনি বলেন, ‘পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ২০৪১ সাল নাগাদ ৬৫ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০৫০ সাল নাগাদ আমাদের ৯০ হাজার মেগাওয়াট দরকার হবে। আসলে ২০৪১ সাল নাগাদ ২৭ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ প্রয়োজন নেই। ভবিষ্যতের জ্বালানি নীতি যেন ব্যক্তি কিংবা করপোরেট স্বার্থে তৈরি না হয় এবং জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়, সেদিকে অবশ্যই আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে।’