Originally posted in বণিকবার্তা on 20 November 2023
ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলামকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। সময়টা ছিল দেশের অর্থনীতির জন্য ক্রান্তিকাল। সময়টাতে বিশ্বজুড়েই অর্থনৈতিক সংকট ছিল। তার অভিঘাত পড়েছিল আমাদের দেশেও। উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্য দিয়ে সময় পার করেছি আমরা। নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল জীবনযাত্রার মানের ওপর। প্রভাব পড়েছিল অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রেও। এমন সময় তিনি শক্ত হাতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। অর্থনীতির যে মন্দা ভাব দেখা যাচ্ছিল, সেটা থেকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তার বিশ্লেষণী সত্তা এবং প্রায়োগিক দিকের সমন্বয় করে পদক্ষেপ নিয়েছেন। অগ্রাধিকার দিয়েছেন দেশ ও মানুষের কল্যাণকে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল সেটা তার জীবন ও বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য। সে সময়টায় তার গৃহীত নীতিমালার মাধ্যমে উপকৃত হয়েছে পরবর্তী সময়ে আসা সরকার।
মির্জ্জা আজিজকে আমি অনেক দিন থেকেই চিনি। প্রথম তার সঙ্গে দেখা হয় তিনি যখন ইউএনএসক্যাপের রিসার্চ অ্যানালাইসিস ডিভিশনের পরিচালক ছিলেন। ব্যাংককে একটা সেমিনারে আমি তার প্রবন্ধ শোনার সুযোগ পাই। প্রবন্ধে তিনি এ অঞ্চলের আর্থিক বিভিন্ন নীতিমালার বিশ্লেষণ তুলে ধরেন। সেই বিশ্লেষণী ক্ষমতা দেখে আমি চমৎকৃত হই। দেশে ফিরে এসে অনেকের সঙ্গেই আলোচনা করি তার সম্পর্কে। তখন অধ্যাপক রেহমান সোবহান আমাকে বলেছিলেন, তিনি ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তী সময়ে আমরা স্যারের সঙ্গে আলাপের সময় জিজ্ঞাসা করি, ‘আপনার ছাত্রদের মধ্যে সবচেয়ে মেধাবী কে?’ তখন তিনি বলেছিলেন, ‘অনেকের অনেক গুণ আছে। কিন্তু যদি বিশ্লেষণী ক্ষমতার কথা বলা হয়, তাহলে সেখানে মির্জ্জা আজিজকে প্রথমে স্থান দেব।’
তার অনেক লেখার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। বিশেষ করে বাণিজ্য নীতি নিয়ে তার যেসব লেখা। নব্বই দশকে বিভিন্ন দেশে যে বাণিজ্যিকীকরণ নীতি গৃহীত হয়, সেখানে তার বাণিজ্য নীতি বড় ভূমিকা রেখেছে।
দেশে ফিরে তিনি বিভিন্ন জায়গায় দায়িত্ব পালন করেছেন। ব্যাংকের বোর্ড ও সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে চেয়ারম্যান হিসেবে এবং পরবর্তী সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন ধীরস্থির ও নির্মোহ। তিনি সূক্ষ্মভাবে কোনো বিষয়ের বিশ্লেষণ করেন, তারপর সেটার সঙ্গে কী নীতিমালা গ্রহণ করা যায়, সেটা দেখেন। বাস্তবায়নে কী কী প্রতিবন্ধকতা হতে পারে, সেক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে, সেটাও বিবেচনা করেন।
তিনি এসক্যাপে থাকার সময়ই বিশ্বজুড়ে আর্থিক সংকট হয়। সেটা ১৯৯৭ সালে। এসক্যাপের গবেষণা পরিচালক হিসেবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। দিয়েছিলেন নীতি ও পরামর্শ। সেগুলো সংকট থেকে উত্তরণে বিভিন্ন দেশকে সহায়তা করেছে। একইভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ছিলেন। তখনো কিন্তু বিশ্বে অর্থনৈতিক সংকট চলছিল। বাংলাদেশেও সে সংকটের অভিঘাত পড়ে। এ সময়ে তিনি সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। দুই ক্রান্তিলগ্নেই তিনি বিশেষত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সামাল দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তার যে মেধা ও ধীশক্তি, সেটার একটা প্রায়োগিক দিকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় এ সময়ই।
মির্জ্জা আজিজ সবসময় গবেষণাধর্মী লেখা লিখেছেন। বণিক বার্তায়ও কলাম লিখেছেন। সব ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের প্রতি তার সহানুভূতিশীল মননের পরিচয় পাওয়া যায়। তিনি চেয়েছেন, রাজস্ব নীতিকে সাধারণ মানুষের কাজে লাগাতে। আর্থিক নীতিমালাকে গণমুখী করতে। ঋণখেলাপি থেকে মুক্তি পেতে কোন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে, কীভাবে নির্মোহভাবে কাজ করতে হবে দায়িত্বে থাকা মানুষদের, এসব কিছু নিয়েই তিনি লিখেছেন। উদাহরণও তৈরি করেছেন। তিনি যখন ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন, সে সময় অযৌক্তিকভাবে বিভিন্ন চাপ আসে। তখন তিনি সেখান থেকে সরে যান। তার পরও আপস করেননি। সেই দিকটাও দেখার বিষয়। গবেষক হিসেবে সবসময় চেষ্টা করেছেন বাংলাদেশের উন্নয়নে আর্থসামাজিক সমস্যাকে অতিক্রম করতে। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ অনুসন্ধানের মতো বিষয়গুলো কিন্তু সবসময় তাকে নাড়া দিয়েছে। তার গবেষণা, কলাম বা মিডিয়ায় বলা কথায় দেখা যায় জনমনস্কতা এবং সাধারণ মানুষের জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণের মনোভাব।
আমার মনে হয় তাকে যে গুণীজন সম্মাননা দেয়া হচ্ছে, সেটা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কারণ এ ধরনের গুণীজনকে যদি সম্মানিত করা হয়, তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারবে। অনুপ্রাণিত হতে পারবে। বর্তমানে এটা গুরুত্বপূর্ণ। এক্সচেঞ্জ রেট, মনিটারি পলিসি, রাজস্ব নীতি নিয়ে তার বলা কথাগুলোর দিকে আরেকবার তাকানো দরকার। বিশেষ করে ২০০৩ সালে এক্সচেঞ্জ রেট পলিসি নিয়ে সিপিডিতে তিনি যে প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেছিলেন, সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখনকার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সে লেখাগুলো আমাদের সাহস দেবে। ফলে আমি মনে করি, খুবই যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে তিনি এ সম্মাননা পেতে যাচ্ছেন।
অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান: সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)