Originally posted in কালের কণ্ঠ on 10 January 2023
বৈশ্বিক মন্দা
বৈশ্বিক চাপ প্রতিরোধে অর্থনৈতিক সংস্কার জরুরি
অলংকরণ : নাজমুল আলম মাসুম
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি মোটাদাগে দ্বিবিধ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি—একটি হলো কভিড থেকে উত্তরণকালীন অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জ, অন্যটি হচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতপ্রসূত বৈশ্বিক অর্থনীতির বিকাশমান অভিঘাত মোকাবেলার চ্যালেঞ্জ। বিশ্বের প্রধানতম অর্থনীতিসমূহে মন্দাজনিত প্রলম্বিত কালো ছায়াও এই দ্বৈত চাপ সামলানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য একটি বাড়তি সমস্যার সৃষ্টি করেছে, বিশেষত রপ্তানি চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে। এই ত্রিমুখী সংকটের কারণে ২০২২ সালের দ্বিতীয় ভাগ ছিল বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি ব্যতিক্রমী সময়, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে এককথায় ছিল অভূতপূর্ব। আর এসব সংকট থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই বাংলাদেশকে অগ্রসর হতে হবে ২০২৩ সালে, যার মূলে থাকতে হবে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে গুণগত মান ও উৎকর্ষ বৃদ্ধি এবং উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে সুশাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি। আর এই লক্ষ্যে একদিকে চলমান সমস্যাগুলো দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিতে হবে, অন্যদিকে কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা ও দুর্বলতা অতিক্রম করতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার কর্মসূচিকে ২০২৩ সালে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
বিগত সময়ে বিশ্বায়নপ্রক্রিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতির সম্পৃক্ততা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অর্থনীতির শক্তি ও সক্ষমতার পরিচয় বহন করে। এই সম্পৃক্ততা জোরদার হয়েছে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধি করে বৈদেশিক পণ্য ও সেবা বাণিজ্যের উত্তরোত্তর সম্প্রসারণের মাধ্যমে, বৈশ্বিক শ্রমবাজারে ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণের মাধ্যমে, বড় আকারে বৈদেশিক সহায়তা আকর্ষণ এবং উন্নয়ন অংশীদারদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সম্পর্কের বহুধাকরণের মাধ্যমে। বিশ্বায়নপ্রক্রিয়ায় শক্তিশালী অবস্থান থেকে অংশগ্রহণের এই সক্ষমতা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বহুমাত্রিক ও ইতিবাচক অবদান রেখেছে।
তবে বর্তমানের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মোকাবেলার পরিপ্রেক্ষিতে একই সঙ্গে এটাও স্বীকার্য, যেসব দেশের অর্থনীতি বিশ্বায়নপ্রক্রিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত রয়েছে সেসব দেশের সবার ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অভিঘাত এক রকম নয়। সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, যেসব দেশের অর্থনৈতিক ভিত মজবুত তারা বিশ্বায়নপ্রক্রিয়ার সুফল যেমন নিচ্ছে, তার কারণে উদ্ভূত ঝুঁকিও তুলনামূলকভাবে বেশি সফলতার সঙ্গে মোকাবেলা করতে সক্ষম হচ্ছে।
বাংলাদেশ যে বিগত সময়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আর্থ-সামাজিক সূচকের নিরিখে ধারাবাহিকভাবে উল্লেখযোগ্য উন্নতি অর্জন করেছে তা আজ ব্যাপকভাবে স্বীকৃত ও প্রশংসিত। কিন্তু এসব অর্জন বাংলাদেশের জন্য নতুন নতুন চ্যালেঞ্জেরও জন্ম দিচ্ছে, যেগুলোকে ‘দ্বিতীয় প্রজন্মের চ্যালেঞ্জ’ বলা যেতে পারে। বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সম্পৃক্ততার প্রেক্ষাপটে এই দ্বিতীয় প্রজন্মের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার সক্ষমতার ওপর আগামী দিনে বিগত সময়ে অর্জিত সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা ও টেকসই করা অনেকাংশে নির্ভর করবে। আর চলমান অর্থনৈতিক সংকট এটাই দেখাচ্ছে যে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অনেক কিছু করার আছে। তথ্য-উপাত্ত-গবেষণাভিত্তিক নীতিমালা প্রণয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাভিত্তিক বাস্তবায়ন ও সুশাসনভিত্তিক উন্নয়ন দর্শন—এই তিনটি হতে হবে উল্লেখিত দ্বিতীয় প্রজন্মের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার মূল অস্ত্র। আর এই তিন করণীয়কেই আগামী দিনে প্রাধান্য দিতে হবে বাংলাদেশকে।
উদাহরণস্বরূপ, চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির নিরিখে বাংলাদেশের বৈদেশিক বিনিময় হার ব্যবস্থাপনার বিষয়টি প্রাসঙ্গিক। দেশের অর্থনীতিবিদরা বেশ কয়েক বছর ধরে বলে আসছিলেন যে বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার মান অতিমূল্যায়িত অবস্থানে আছে, যার কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য প্রতিযোগিতাসক্ষমতা হারাচ্ছে এবং রেমিট্যান্সের একটি অংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক চ্যানেলে চলে যাচ্ছে। এই আশঙ্কা যে একেবারে অমূলক ছিল তা বলা যাবে না। আমদানীকৃত মূল্যস্ফীতি মোকাবেলার জন্য মুদ্রা সরবরাহসহ আর্থিক নীতির অন্যান্য হাতিয়ার, এবং তার সঙ্গে আমদানি শুল্ক, রাজস্বনীতি, ভর্তুকি ও সামাজিক সুরক্ষা নীতির সমন্বয়ে মূল্যস্ফীতির চাপ হ্রাস এবং প্রান্তিক ও স্থির আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে যখন মূলত বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি হলো, তখন কিন্তু টাকার একটা বড় ধরনের অবমূল্যায়নের সিদ্ধান্তই গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হলো। যে আমদানীকৃত মূল্যস্ফীতির চাপের ভয় করা হচ্ছিল সেটা ভর করল দ্বিবিধ শক্তি নিয়ে বৈশ্বিক বাজারে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধজনিত মূল্যবৃদ্ধির চাপ, যার সঙ্গে যুক্ত হলো টাকার বিনিময় হারের অবমূল্যায়নজনিত মূল্যবৃদ্ধির চাপ। খাপ খাইয়ে নেওয়ার যে সুযোগ ও সময় অর্থনীতির প্রয়োজন ছিল তার অনুপস্থিতিতে মূল্যস্ফীতির চাপ ভোক্তাস্বার্থ ও বিনিয়োগ—দুটির ওপরই নেতিবাচক প্রভাব ফেলল।
দ্বিতীয় বিচার্য বিষয় হলো, এ ধরনের প্রেক্ষাপটে অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের উচ্চহার হতে পারত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার অন্যতম হাতিয়ার। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার বৃদ্ধির পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ এবং রাজস্ব-জিডিপি ও কর-জিডিপি হার বৃদ্ধির জন্য যে সক্রিয় উদ্যোগের প্রয়োজন ছিল সে ক্ষেত্রে দুর্বলতার কারণে তা লক্ষ্যমাত্রার অনেক নিচে থেকে গেছে। সপ্তম ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত ১৪ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও প্রকৃত হার ৯ শতাংশের আশপাশেই বেশ কয়েক বছর ঘুরপাক খাচ্ছে। মনে রাখা দরকার, দক্ষিণ এশিয়ায় এই গড় হার বাংলাদেশের প্রায় দ্বিগুণ। পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলে বাজেট ঘাটতি রাখা যেত শূন্যে, অথবা সরকারি ব্যয় যা জিডিপির ১৫ শতাংশের কাছাকাছি এবং প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম, সেটা অনেকাংশে বৃদ্ধি করা যেত। বৈশ্বিক অর্থনীতির টানাপড়েন এবং আমদানীকৃত মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দিতে যে বর্ধিত অর্থায়ন, সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি ও অতিরিক্ত ভর্তুকির চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে তার পরিপ্রেক্ষিতেও সম্পদ জোগান সম্পর্কীয় প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজতর হতো।
তৃতীয় বিষয়টি বাজার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত। বাজার ব্যবস্থাপনা ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে দুর্বলতার কারণে আমদানি স্তর থেকে ভোক্তা স্তর ও উৎপাদন স্তর থেকে ভোক্তা স্তরে দামের যে বৃদ্ধি তা মূল্যস্ফীতির চাপ আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর প্রতিকারে বাজার ব্যবস্থাপনা আরো দক্ষ করতে হবে, মুক্তবাজার ব্যবস্থার পথে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও কম্পিটিশন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর নজরদারি ও খবরদারি বৃদ্ধি করতে হবে। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে সর্বক্ষেত্রে ‘গুড ভ্যাল্যু ফর মানি’ নিশ্চিত করা এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ও কর্মকাণ্ডে সুশাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দুর্নীতি, অপচয়, বিলম্বিত বাস্তবায়ন ও বিনিয়োগ প্রকল্পের অযৌক্তিক ব্যয় বৃদ্ধির দুষ্টচক্রের বিরুদ্ধে ঘোষিত রাজনৈতিক অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন।
দেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা অনেক দিন ধরেই স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠন, রাজস্বক্ষেত্রে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পৃথক্করণের প্রয়োজনীয়তা, ব্যাংকের সঞ্চয় ও ঋণ-সুদ হার ও টাকার বিনিময় হারের বাজারমুখী সমন্বয়, সরকারি ব্যয় সংস্কার, ভর্তুকি ও প্রণোদনা পর্যালোচনা ও পুনর্বিন্যাসসহ বেশ কিছু পদক্ষেপের কথা বলে আসছেন। আইএমএফের শর্তের কারণে নয়, আমাদের সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে আমাদেরই প্রয়োজনে এবং আগামী দিনের অর্থনীতির চাহিদার নিরিখে। ২০২২ সালের অভিজ্ঞতার আলোকে ২০২৩ সালকে অর্থনৈতিক সংস্কার, সুশাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির বছর হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। সরকার প্রণীত ‘রূপকল্প ২০৪১’-এ বাংলাদেশকে আগামী দুই দশকের মধ্যে একটি অর্থনৈতিকভাবে উন্নত, সামাজিকভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশবান্ধব দেশ হিসেবে রূপান্তরের প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। সেই লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করে দ্বিতীয় প্রজন্মের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের এখনই সময়।