Published in ইনকিলাব on Tuesday, 13 February 2018
মূলধন সঙ্কট ব্যাংক সচলে আবার টাকা দিচ্ছে সরকার
অর্থ মন্ত্রণালয়ে বুধবার বৈঠক : লাগামহীন খেলাপি ঋণই কারণ – বিশেষজ্ঞদের অভিমত
হাসান সোহেল
খেলাপি ঋণের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে মূলধন ঘাটতি ক্রমেই বাড়ছে। আর তাই ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলোকে সচল রাখতে মূলধন (টাকা) যোগান দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান কাল বুধবার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক ডেকেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, রাষ্ট্রায়ত্ত (সরকারি) ব্যাংকগুলো প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। এর মধ্যে সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি ৭ হাজার ৬২৬ কোটি ২৩ লাখ টাকা। আর বিশেষায়িত দুই ব্যাংকের ঘাটতি ৮ হাজার ২৮২ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জনগনের করের টাকা থেকে সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে মূলধনের যোগান দিয়ে থাকে। যা কাম্য নয়। অর্থনীতিবিদদের মত, ব্যাংকগুলো পরিচালনায় অদক্ষতা, অনিয়ম, দুর্নীতি করে প্রতি বছর লোকসান গুনবে আর তাদের কে সরকার মূলধন যোগান দেবে তা হতে পারে না। ব্যাংকগুলো যাতে নিজেরা ভালো করে এবং সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসতে পারে তার জন্য লক্ষ্য বেধে দেওয়ার পরামর্শ আসে তাদের কাছ থেকে। এছাড়া লাগামহীন খেলাপি ঋণই ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতির অন্যতম কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আর্থিক অনিয়ম, কেলেঙ্কারি, দুর্নীতির কারণে ব্যাংকিং খাতে চরম অব্যবস্থাপনা চলছে। তাই অপাত্রে বিনিয়োগে খেলাপী হচ্ছে ব্যাংকগুলো, যার ফলশ্রæতিতে মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে দেশের আর্থিক খাত হুমকির সম্মুখীন হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। মির্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সরকারের উচিত বছর বছর ব্যাংকগুলোকে নতুন করে মূলধনের যোগান না দিয়ে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা। যার ফলশ্রæতিতে ব্যাংকিং খাতে সুদিন ফিরবে।
সূত্র মতে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান কাল বুধবার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক ডেকেছে। সচিবালয়ে ডাকা ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ ইউনুসুর রহমান। বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, সোনালী ব্যাংক, রূপালি ব্যাংক, কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব), বেসিক ব্যাংক ও গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে থাকতে এরই মধ্যে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
নিয়মানুসারে মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হওয়ার অর্থ হচ্ছে ব্যাংক পরিচালনায় ঝুঁকি মোকাবেলার সামর্থ্য সীমিত না থাকা। ব্যাংকগুলোর সম্পদ (ঋণ) বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বাড়ে। ঋণের মান অনুযায়ী ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ নির্ণয় করা হয়। যে ব্যাংকের গুণগত মানসম্পন্ন ঋণ বেশি তার ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ কম। খারাপ ঋণের কারণে ব্যাংকগুলো যেন পরিচালনার ক্ষেত্রে বড় ধরনের সংকটে না পড়ে এজন্য আন্তর্জাতিক নিয়মানুসারে মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। যে ব্যাংকের মূলধন যত কম তার সংকট মোকাবেলার সামর্থ্যও তত কম। আর্ন্তজাতিক মানদন্ড ব্যাসেল-৩ অনুসারে মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। এর পাশাপাশি অনাঙ্খিতভাবে কোন ঝুঁকির ফলে সম্ভাব্য ক্ষতি মোকাবেলায় আরও ১ দশমিক ২৫ শতাংশ মুলধন হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, সরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূলধন ঘাটতি রয়েছে সোনালী ব্যাংকের। এই ব্যাংকের ঘাটতি ৩ হাজার ১৪০ কোটি টাকা। বেসিক ব্যাংকের ঘাটতি ২ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। এছাড়া জনতা ব্যাংকের ঘাটতি ১ হাজার ২৭৩ কোটি। রুপালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৬৯০ কোটি টাকা। জনতা ব্যাংক প্রথম বারের মতো ঘাটতিতে এসেছে। সরকার মালিকানাধীন বিশেষায়িত খাতের কৃষি ব্যাংকের ঘাটতি ৭ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। আর রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) ঘাটতি ৭৪২ কোটি। তবে সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) ও অগ্রণী ব্যাংকে কোনো মূলধন ঘাটতি নেই। সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি তৈরি হলে বাজেট থেকে তার যোগান দিতে হয়।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বছরের পর বছর ব্যাংকগুলোর মূলধন যোগান দেওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা লোকসান বা ক্ষতির রাষ্ট্রীয়করণ করছি। এতে রাষ্ট্রের কোনো উপকার হয় না। কিছু ব্যক্তিবিশেষ লাভ করেছে। এক অর্থে বলা যায়, মূলধন যোগানের মধ্য দিয়ে লাভের বিরাষ্ট্রীয়করণ আর ক্ষতির রাষ্ট্রীয়করণ করা হচ্ছে।